May 16, 2024
কলামফিচার ২

বাণিজ্য আকাঙ্ক্ষায় রাজপথ যখন করোনা মিছিল

মাসকাওয়াথ আহসান।। ব্যবসায়ীদের সরাসরি রাজনীতিতে অংশগ্রহণ; রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে দায়িত্ব পালন জনস্বার্থের জন্য ক্ষতিকর। ব্যবসায়ী সবসময় তার নিজের ব্যবসায়িক স্বার্থ দেখে। তার কাছে জনস্বার্থ তার নিজের স্বার্থের চেয়ে বড় কখনো নয়। তাই ব্যবসায়ীর সরকারি দায়িত্বপালন, কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট তৈরি করে।
 
ঠিক এ কারণেই সেই পলাশীর যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌল্লার পতনের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী শাসনভার নিয়ে নিলে আক্ষেপ করে বলা হতো, বণিকের মানদণ্ড দেখা দিলো রাজদণ্ড হিসেবে।
 
বাংলাদেশের সাংসদদের শতকরা ৬২ ভাগের বেশি ব্যবসায়ী। মন্ত্রীসভাতেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্যবসায়ী রয়েছে। ফলে রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণে স্বাভাবিকভাবেই জনস্বার্থের চেয়ে ব্যবসায়িক স্বার্থ বেশি প্রাধান্য পায়। ব্যবসায়ী রাজনীতিকদের মাঝে কেউ কেউ জনমুখী। কিন্তু তাদের এই সততা সামগ্রিক বাস্তবতায় খুব বেশি ইতিবাচক প্রভাব রাখতে পারে না। দুর্নীতির মহাসাগরে কয়েক বিন্দু সুনীতির বুদবুদের বেশি কিছু নয় তা।
 
রবিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনা সংকটে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণার পর; তার ব্যবসায়ী অর্থমন্ত্রী মোস্তফা কামাল ধন্যবাদ জ্ঞাপনের সময় যা বললেন তাতে হারিয়ে যাওয়া উচ্চ জিডিপি হার ফিরিয়ে আনার আকুতিটাই লক্ষ্যণীয় ছিলো।
 
অন্যদিকে রাজনীতিক শেখ হাসিনার বক্তব্যে কেবল ‘মানুষ বাঁচানোর আকুতি’ ছিলো। এখানেই রাজনীতিবিদ আর ব্যবসায়ী রাজনীতিবিদের চিন্তার ও অগ্রাধিকারের পার্থক্য স্পষ্ট।
 
বিশ্বের অনেক দেশেই করোনা সংকটে ‘মানুষের জীবন বাঁচানো বনাম অর্থনীতি বাঁচানো’-র একটি বিতর্ক চলছে।
 
কেবল সেই দেশগুলোই করোনা মোকাবেলায় ব্যতিক্রমী সাফল্য পাচ্ছে যেখানে নীতি-নির্ধারণে নানা পেশার লোক রয়েছেন। বণিকের মানদণ্ড যেখানে রাজদণ্ড নয়। আপাতত জার্মানির দৃষ্টান্ত বিবেচনায় রাখা যেতে পারে।
 
করোনা মড়কের সময় মানুষের করোনাভাইরাস আর ক্ষুধার সঙ্গে লড়াই ছাড়া আর কোন ভাবনা নিতান্ত অমানবিক। করোনার মড়কের পর পৃথিবী গতানুগতিক বিলাসিতা, প্রাচুর্য, উন্নয়ন, জিডিপি গ্রোথ, গ্রামগুলোকে শহর বানানো, পদ্মা সেতুর স্প্যান লাগানোর খবর প্রাধান্য পাবে কীনা তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে।
 
চীনের উহানে করোনার প্রাদুর্ভাবের সময়; বিপদ বুঝে বিশ্বের বড় বড় ক্রেতারা সব দেশেই তাদের কেনা-কাটা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। এ সময় বাংলাদেশের গার্মেন্টস সেক্টরের উদ্যোক্তারা করোনার চেয়ে তার ব্যবসার ক্ষতি নিয়ে বেশি ভাবতে শুরু করে।
 
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মেধাবী ব্যবসায়ী হিসেবে যাদের তার দলে সংযুক্ত করেছেন; তাদের চিন্তাজগত জুড়ে তখন কেবল ব্যবসার ক্ষতি। শেখ হাসিনা দ্রুততার সঙ্গে গার্মেন্টস সেক্টরের জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করলেন।
 
যেহেতু কিছুকাল ধরে ব্যবসায়ী ছাড়াও কিছু ‘আশার সওদাগর’ প্রধানমন্ত্রীকে উপদেশনা দেন; তারা ‘করোনায় আমাদের কিচ্ছু হবে না’ এমন একটি বাতাবরণ ধরে রাখে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে তাই শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে সবচেয়ে দেরিতে; লকডাউন হয়েছে প্রায় সব শেষে।
 
গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ যে অর্থনৈতিক উন্নতি করেছে; তাতে করোনাকালে ক্ষুধার্ত মানুষের ঘরে সামান্য খাবার সরকারিভাবে পৌঁছে দেবার সামর্থ্য দেশটির রয়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশের মানুষ প্রতিবেশী ও পরিচিতজনদের কেউ করোনাকালে ক্ষুধার্ত থাকলে; তাকে সাহায্য করবে। বাংলাদেশের সামাজিক ঐতিহ্যে এই মানবিক বোধ রয়েছে।
 
এই বোধটির অভাব ধরা পড়লো গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের মাঝে। এতোকাল যে শ্রমিকের শ্রমে ও ঘামে একজন গার্মেন্টস ব্যবসায়ী দরিদ্র অবস্থা থেকে নব্য-ধনী হয়ে উঠলো; আশা করা গিয়েছিলো, শিল্পের প্রাণ সেই সেলাই কর্মীদের করোনার এই সংকটের সময় ঘরবন্দী অবস্থায় তার বেতন ভাতা পৌঁছে দেবে কিছুকাল। এইটুকু দায়িত্ববোধের পরিচয় দিতে তারা পারলেন না।
 
ব্যবসায়ীতে টইটুম্বুর নীতি নির্ধারক মহল ‘করোনায় মানুষ বাঁচানো’র সংকল্পকে পাত্তা না দিয়ে করোনা সিজনের মাস্ক-পিপিই তৈরি ও বিভিন্ন দেশে বিক্রির মাধ্যমে করোনা জিডিপি গ্রোথের নতুন সংকল্পে থিতু হলেন।
 
নীতি নির্ধারকদের বণিকের মানদণ্ডটি, ‘রপ্তানীমুখী গার্মেন্টস কারখানাগুলো সাবধানতা অবলম্বন করে সচল থাকবে’ এমন একটি আদেশ করিয়ে নিলো। করোনার হামলা থেকে প্রাণ বাঁচাতে মার্চ ২৬-এ গ্রামের বাড়িতে পালিয়ে যাওয়া শ্রমিকদের কাছে শিল্প-নাৎসিদের হুকুম গেলো, ৪ এপ্রিল কাজে যোগদান করো।
 
চাকরি বাঁচাতে লকডাউন ভেঙ্গে প্রাণ হাতে নিয়ে শ্রমিকেরা পথে নামলো। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অনেককে একশ কিলোমিটার হাঁটতে হলো বণিকের নিষ্ঠুরতার পীড়নে।
 
রানা প্লাজা ধ্বসে পড়ে সহস্র সেলাই শ্রমিকের মৃত্যু গার্মেন্টস মালিক মহলে কোন অনুতাপ বা অপরাধবোধ তৈরি করতে যে পারেনি; তা সুস্পষ্ট ‘তাদের বাণিজ্য আকাংক্ষায় রাজপথ যখন করোনা মিছিল’।
 
ম্যাকিয়াভেলির ‘দ্য প্রিন্স’ নামের শাসকের গাইড বইতে লেখা আছে, ডার্টি জবের জন্য লোক রাখতে হয় শাসককে। যাতে ডার্টি জব করা হয়ে গেলে জনগণ যখন ডার্টি জব করা লোককে গালাগাল করবে; শাসককে তখন ত্রাণকর্তা হিসেবে নেমে আসতে হবে। এতে তার জনসমর্থন আরো বাড়বে।
 
‘করোনার চেয়ে ক্ষমতা বড়’ দর্শনের অনুসারী সহমত ভাইয়েরা এইক্ষণে খুঁজে পেয়েছে গার্মেন্টস ব্যবসায়ী সংস্থার নেতা ‘রুবানা হক’কে সেই দ্য প্রিন্সের ডার্টি জব করা লোকটি হিসেবে। এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের টাইম মেশিনে করে সহমত ভাইয়েরা জনগণকে নিয়ে যাচ্ছে এরশাদ আমলে রুবানা ‘যদি কিছু মনে না করেন’ টিভি অনুষ্ঠানে কীভাবে এরশাদের সহমত ভাই হয়েছিলেন তা দেখাতে। যদিও জীবিত ও মৃত এরশাদ আর তার জাতীয় পার্টি গত প্রায় এক যুগ ধরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগেরই সহমত ভাই।
 
এই লোকজ হৈ চৈ আর তা দিয়ে ডার্টি জব করা লোকটিকে গালাগাল দিয়ে; দ্য প্রিন্সকে একমাত্র পরিত্রাণদাতা হিসেবে মেলে ধরা; এই পুনরাবৃত্তিকর ভিলেজ পলিটিক্স চক্রে; আড়াল করা হয় বনিকের মানদণ্ড রাজদণ্ড হয়ে যাওয়ায়; মুনাফার লোভের গ্যাসচেম্বারে আটকে পড়া উপায়হীন মানুষদের বাড়তে থাকা ট্র্যাজেডি।
 
গোটা বিশ্ব যেখানে অদৃশ্য ঘাতক করোনা নিয়ে ভাবছে; বাংলাদেশের গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের ভাবনা তখনও তাদের ব্যবসার মুনাফা নিয়ে। এ নিয়ে সমালোচনার জবাব দিতে গিয়ে এক গার্মেন্টস ব্যবসায়ী নারী বলছিলেন, “আমরা যারা শ্রমিক পালি তাগোর চাইতে আপনারা যারা একজনেরেও ভাত দিতে পারেন না; তারা বেশি বুইঝা ফালাইছেন।”
 
সত্যিই তো ‘ব্যবসায়ী না হলেই’ আজকের উন্নয়ন সমাজে আপনি অপ্রাসঙ্গিক। আর ‘আশা-ভরসা’ ব্যবসায়ী না হলে আপনি সহমত ভাই সমাজের চোখে ‘গণশত্রু’।
 
উন্নয়ন নাৎসিদের গ্যাস চেম্বারে বসে, “রপ্তানিমুখী গার্মেন্টস শিল্প কারখানা খোলা রাখার নির্দেশক্রমে” করোনা সংক্রমণের কুরুক্ষেত্রে গার্মেন্টস শ্রমিকদের নামিয়ে দিয়ে; একশো কিলোমিটারের দাস-মিছিল করিয়ে; আবার পুলিশকে রাজধানীগামীদের বাধা দেবার নির্দেশ দিয়ে; সহস্র শ্রমিক যখন স্ব স্ব মালিকের হুকুমে ৪ এপ্রিল কাজে যোগ দেবার মৃত্যু মিছিলে; তখন আর কী বলার থাকে। কাকেই বা দোষ দেয়ার থাকে; দক্ষিণ এশিয়ার নরকে জন্ম নেয়ার নিয়তিকে ছাড়া।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব মতামত]