November 22, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

আমার জগতে নারীবাদ কেন মারাত্মক এক অপরাধ?

সুপ্রভাত সুইট।। আমাদের সমাজে ফেমিনিজম এখনও মারাত্মক অপরাধ।

আমি খুব সাধারণ পরিবারের একটি মেয়ে, বলার মতো বা পরিচয় দেবার মতো আমার কিছুই নেই। বলতে গেলে গ্রাম পর্যায় থেকেই আমার উঠে আসা। অল্প কিছুদিন হচ্ছে ঢাকা শহরের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার পড়াশোনা করার সুযোগ হয়েছে। এটাই আমার কাছে অনেক বলে আমি মনে করি। কারণ আমি একটি ধার্মিক পরিবার থেকেই এসেছি। বাস্তব জীবনে কাছের মানুষদের মধ্যে তেমন কাউকে খুঁজে পাইনি বা ছিল না যাদের কাছ থেকে নারীবাদ বা নারী আন্দোলন ও মুক্তভাবে চিন্তা করার কৌশল শিখতে বা জানতে পারবো। নারীবাদ ও মুক্তচিন্তা সম্পর্কে খুব একটা জানতে পারার মতো পথ আমার কাছে পৌঁছতে অনেক সময় নিয়েছে।

অল্পস্বল্প করে যখন প্রথম প্রথম ইন্টারনেট ব্যাবহার করা শুরু করলাম তখন থেকেই নারী আন্দোলনবিষয়ক লেখাগুলো আমাকে ভীষন ভাবে টানতো যা এখানে প্রকাশ করে বোঝাবার মতো ভাষা আমার এই মুহুর্তে নেই। আমার গল্পগুলো হয়তো মালালা ইউসুফ জাই অথবা কিছুদিন আগের বহুল আলোচিত সৌদি তরুণী রাহাফ আল মুহাম্মদের মতো নয়। তবে আমিও যে এই বাংলাদেশে তাদের মতই ছোট ছোট সংগ্রাম করে আজ আপনাদের মাঝে এসে আমার অনুভূতি প্রকাশ করছি সেটা কিন্তু সঠিক। নারীবাদ নিয়ে যারাই লেখেন তাদের প্রত্যেকের লেখা খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ার চেষ্টা করি। বিশেষ করে সমাজ গবেষনা নিয়ে লেখাগুলো আমাকে বেশি টানে।

আমি একজন নারী হয়ে আমার ব্যাক্তিজীবনে মফস্বল থেকে বেরিয়ে এসে একটি আধুনিক শহরে পড়াশোনা করার সুযোগ তৈরি করে নিতে যা করেছি তা আমাদের দেশের এই ধর্মান্ধ সমাজ ব্যাবস্থাতে আমার জন্য এক প্রকারের সংগ্রাম করা। আমার মত হয়ত অনেক মেয়েই আছে যারা আজও সেই জায়গা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। আজও তাদের কাছে এবং তাদের পরিবারের কাছে মনে হয় নারীবাদ বা ফেমিনিজম হচ্ছে মেয়েদের জন্য মারাত্মক একটি অপরাধ।

আমার গ্রামের মেয়েদের এবং তাদের পরিবারের, বিশেষ করে মায়েদের এমন একটি ধারনা আছে যা হচ্ছে নারীবাদ বা ফেনিজম মানেই একটি অপরাধ। তাদের মতে নারীদের আবার কীসের আন্দোলন। তারা অল্পস্বল্প পড়াশোনা করে বিয়ে করে স্বামীর ঘর করলেই হল, এর বেশি তাদের আর চিন্তা কীসের। আমি বলতে একটুও দ্বিধাবোধ করিনা আমার নিজের মায়ের মনোভাবই আজও এরকম।

নারীবাদ মানেই মারাত্মক একটি অপরাধ এমন ধারনার জন্ম তাদের মনে কেনো হয়েছে তার একটি কারণ আমি  খুঁজে বের করেছি। আমাদের দেশের মোল্লা হুজুর আর মাদ্রাসা পড়ুয়া সম্প্রদায় গ্রামাঞ্চলের পরিবারগুলোতে বিভিন্নভাবে ছড়াতে থাকে নারীবাদী নারী মানেই হচ্ছে তারা চটরপটর করে যৌন আবেদনময় কথা বলবে, যাদের পোশাকের কোন ঠিক নেই, পরপুরুষদের সাথে খোলামেলা আলাপ করবে, যার তার সাথে রাত্রিযাপনের মানসিকতা রাখবে, তারা হচ্ছে যৌনবিদ্বেষী, সমাজের প্রথা মানে না, পুরুষবিদ্বেষী ইত্যাদি এরকম আরো অনেক কিছুই। আর যারা গ্রামাঞ্চলে বসবাস করে তাদের জন্য এসব জানার পরে নিজেকে একজন নারীবাদী ভাবা বা নারীর স্বাধীনতা নিয়ে চিন্তা করাটাও অপরাধ বলেই মনে হবে যা শুরুতে আমারও হত।

আমার জানামতে আমার অনেক বান্ধবীর মধ্যে অনেকেই আছে যারা আজও সেই সৌদি তরুণী রাহাফের মতো মাথার চুল সামান্য ছোট করে কাটার কারণে মার খেয়ে রক্তাত্ত হয় নিজের পরিবারের কাছে। তারা কেন আজ তাদের স্বাধীনতার কথা চিন্তা করতে পারছেন না জানেন ? আমার মনে হয় নারীবাদ সম্পর্কে আমাদের এই ভ্রান্ত ধারনারগুলোর কারনে। আমার মতে তসলিমা নাসরিন যে ভুলটি করেছিলেন অতীতে যার কারনে আজ আমরা এই বিশ্ব বরেণ্যে লেখিকাকে নিজের দেশ থেকে হারিয়েছি সেই ভুলটি আজও অনেক নারীবাদী করেন, যার কারনেই গ্রামাঞ্চলের নারীদের নারীবাদ সম্পর্কে এমন মনোভাব। এবং যে কারণেই তারাও আজ নিজেদের স্বাধীনভাবে চিন্তা করার থেকে বন্দি করে রাখার ইচ্ছা পোষন করছে।

আমি বলতে চাচ্ছি, আমরা তো সবাই জানি একজন শিশুকে কীভাবে খাবার খাওয়ানো শেখাতে হয়। প্রথম ৬ মাসের মাথায় তাকে একটু একটু করে নরম খিচুড়ি জাতীয় খাদ্য এরপরে আস্তে আস্তে শক্ত খাবার এবং একটা পর্যায়ে গিয়ে সে স্বাভাবিক সব খাবার খাওয়ার জন্য উপযুক্ত হয়ে উঠে। আমাদেরও ঠিক সেভাবেই বাংলাদেশের মুমিন সমাজ ও আমার মায়ের মত নারীদের মনে আগে জায়গা করে নিতে হবে। সেটা না করে যদি আমরা আগেই আর সব কিছু নগন্য মনে করে শুধু পুরুষের মত নারীর বহুগামীতার দাবি করি, তাহলে কিন্তু আমার মত অনেক মেয়ের পরিবারের কাছেই মনে হওয়াটা স্বাভাবিক যে নারীবাদ বা ফেমিনিজম মানেই হচ্ছে চরম ও মারাত্মক একটি অপরাধ।

সুপ্রভাত সুইট: শিক্ষার্থী ও অনলাইন এক্টিভিস্ট

 

[ফেমনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব মতামত]