May 15, 2024
সাহিত্যগল্পফিচার ৩

আক্কেল দাঁত

ফারজানা নীলা।।

প্রতিদিন একটু একটু করে ব্যথা বাড়ছে। প্রথমে মাড়ি ফুলে গেলো , এরপর ব্যথা শুরু। তীব্র নয় কিন্তু চিনচিনে একটা ব্যথা। গরম পানিতে আরাম মিলে খানিক। আবার শুরু। প্রতিদিন এখন রঙ চা খাই। এতেও লাভ হচ্ছে না। কতদিনে এই দাঁত পুরোপুরি গজাবে কে জানে!

দাঁতটা ঠিক সেদিন থেকে ঠেলে উঠছে যেদিন থেকে আমি ওই ঘর ছেড়েছি। না ঠিক ছাড়ি নি, ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে। এখন আমি মা’র বাড়িতে। সপ্তাখানেক হবে মনে হয়। এই সাত দিন তেমন কিছু করি নি। ঘুমিয়েছি শুধু। আর বারবার গরম পানি কুলকুচো করেছি।

বাসার সবাই আমার দিকে কেমন যেন দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। তারা কিছু বলতে চায়। আমি এড়িয়ে যাচ্ছি। ঠিক কেন এড়িয়ে যাচ্ছি সেটির একটি ব্যাখ্যা দাঁড় করেছি মনে মনে।

আমার উচিত ছিল এসেই হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দেওয়া। সবাইকে জড়িয়ে ধরে আহাজারি করা। জনে জনে বুঝানো আমার কষ্ট কোথায়। কোথায় আমার লাগছে ভীষণ। কিন্তু এমন কিছুই করি নি। শুধু বলেছি আমি আর ঐ বাসায় ফিরে যাব না। তাদের মতে এমন কিছু ঘটে নি যার জন্য এই সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। দেখছি সবার চোখে মুখে প্রশ্নবোধক চিহ্ন। তাদের এই প্রশ্নবোধক চিহ্নের সম্মুখে আমার এখন পড়তে ইচ্ছে করছে না।

এমন কিছু ঘটে নি? সত্যি? আমি নিজেকে প্রশ্ন করি।

সত্যি কি আমি বাড়াবাড়ি করছি?

না।

আমার কি ক্ষমা করা উচিত?

না।

আমার কি আরেকবার সুযোগ দেওয়া উচিত?

না।

আমি দ্বিতীয়বার তৃতীয়বার এভাবে অসংখ্যবার নিজেকে প্রশ্ন করি। প্রতিবারই ভেতর থেকে কেউ বলে, না।

আমার দাঁতের ব্যথা বাড়তে থাকে। মাকে গিয়ে বলি, মা আমার মনে হয় আক্কেল দাঁত উঠছে। ডাক্তার দেখানো উচিত। ব্যথা করছে।

মা রুই মাছের মুড়িঘণ্ট বানাচ্ছিলেন। খুন্তি নামিয়ে আমার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ।

আমি ঠিক বুঝলাম না দাঁতের ব্যথার কথা বলাতে মা এমন করে তাকাচ্ছেন কেন?

আমি আবার বলি। মা এবার চোখ নামিয়ে রান্নায় মনোযোগ দেন। আমি গরম পানি নিয়ে চলে এলাম নিজের রুমে।

বর জাতীয় প্রাণিরা নিজেদের সবসময় স্ত্রীদের থেকে সুপিরিয়র ভাবে। তাদের মনে মগজে ঘেটে থাকে তারা যা খুশি করবে বলবে, বৌ জাতীয় প্রাণিরা সেগুলো চুপচাপ বা ক্ষেত্র বিশেষে কান্নাকাটির মাধ্যমে সয়ে যাবে।

আমিও একটি বৌ জাতীয় প্রাণি। আমিও সয়ে গেছি পাঁচটি বছর। বর জাতীয় প্রাণিদের রাগের উপর যখন কন্ট্রোল থাকে না তখন ঘর থেকে বের হয়ে যেতে বলা যেন “আমার ক্ষুধা লাগছে” এর মত সরল বাক্য। যখন তখন বলে ফেলা যায়। বার বার বলে ফেলা যায়। অসংখ্য বার শুনতে শুনতে বৌদের কানে এসব সহজ হয়ে যায়।

আমারও হয়ে গেছিল। গাল ফুলিয়ে অভিমান করে কষ্ট পেয়েও আড়ালে কেঁদে সহ্য হয়ে গেছিল সব।

সেই রাতে কেন জানি আর হলও না। কোথায় যেন শরীরে রিরি করে উঠল। কোথায় যেন ভেতরে প্রতিবাদ করে উঠল। রাতের একটা শুনশান বাড়িতে, ঘর ভর্তি লোকের সামনে যখন কেউ বলে ওঠে “গেট লস্ট” তখন মনে হচ্ছিল, আমি কেন আছি এখানে? কার জন্য? যার জন্য এই বাড়ির সাথে আমার সম্পর্ক সেই মানুষটি যখন বলে এখনই বের হয়ে যাও আমার বাড়ি থেকে। তখন কি এই সত্যটা ফুটে উঠে না, আসলে সেটি কখনই আমার বাড়ি ছিল না? কখনই সেটি মেয়েদের নিজের বাড়ি হয় না। বাড়ি তো সেটা যেখানে সবাই থাকবে নিজের অধিকারে। কেউ কাউকে বের করে দিতে পারবে না।

আমি নিশ্চল দাঁড়িয়ে ছিলাম কিছুক্ষণ। তার রাগান্বিত পাগলের মত চিৎকারে আমার কানে তালা লেগে গেছিল। বাড়ির অন্যরা অনেক বুঝানোর চেষ্টা করেছিল। বলেছিল বারবার, “ও এত রাতে কীভাবে যাবে?”

কীভাবে যাব? আমার যাওয়াটাই তাহলে ঠিক? শুধু বাহনের অভাবে যাওয়া যাচ্ছে না?

আমি কান পেতে শুনতে চাইলাম কেউ বলে কিনা “ও কেন যাবে এই বাড়ি ছেড়ে? এটা ওর বাড়ি। ও কোথাও যাবে না।”

অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও শুনতে পেলাম না। আর সেও বলে যাচ্ছে “রাস্তায় অনেক গাড়ি। চলে যেতে পারবে।”

ভীষণ অপমানে আমি মাটির সাথে মিশে গেলাম। ঠিক যতক্ষণ ঐ বাড়িতে ছিলাম ঠিক ততক্ষণ যেন দম আটকে আসছিল। হাত কাঁপছিল। কাঁপা হাতে ফোন বের করে উবার ডাকলাম। উবার আসল। আমি গাড়িতে উঠে পড়লাম। সবাই কান্নাকাটি করছিল ঠিক। কিন্তু সেখানে থাকার জন্য আমার ভেতরে আর কোনও অনুভূতি কাজ করছিল না। যেন এটা একটা দোজখ।

ঠিক ঠিক মার বাসায় পা দিয়েই টের পেলাম উপরপাটির মাড়িতে ব্যথা করছে। বাসায় ঢুকে সবাইকে সংক্ষেপে কাহিনী বললাম এবং জানালাম সেই বাড়িতে আর ফিরছি না।

আজ ডাক্তারের কাছে গেলাম। ডাক্তার বলল, ব্যাপারটা স্বাভাবিক। আক্কেল দাঁত উঠলে ব্যথা করে। বেশি ব্যথা হলে যেন পেইন কিলার খাই। প্রেসক্রিপশন লেখার সময় আমার নাম জানতে চাইলেন। নাম বললাম। বিবাহিত কিনা জানতে চাইলেন। আক্কেল দাঁতের ব্যথার সাথে বিবাহিত অবিবাহিত কী সম্পর্ক বুঝলাম না। একটু দ্বিধা হল। কিন্তু বললাম, সিঙ্গেল।

ডাক্তার একটু তাকালেন আমার দিকে।

অফিস থেকে ছুটি নিয়েছিলাম কয়েকদিনের। এখন আর না গেলেই নয়। অফিস যাওয়া শুরু করলাম। সব কিছু স্বাভাবিক মনে হল। কোথাও কিছু থেমে নেই। কোথাও কিছু নষ্ট হয় নি। ভেঙ্গে যায় নি। কাজ-লাঞ্চ-চা-আড্ডা-কাজ- বসের বকুনি -কাজ -চা । ঠিক এক সপ্তাহ আগে যেমন ছিল তেমনই।

সন্ধ্যায় গেলাম পুরনো এক বই ঘরে। যেখানে এক সময় আমি যেতাম প্রতিদিন। এখন আর যাওয়া হয় না। কেন যাই না জিজ্ঞেস করলে ভাবি কী উত্তর দেব?

আজ এত বছর পর এসে দেখলাম সব আগের মতই আছে। যেখানে উপন্যাস থাকার কথা, সেখানে সেটি আছে। যেখানে গল্প, যেখানে কবিতা, যেখানে অনুবাদ, যেখানে প্রবন্ধ যেখানে ভিনদেশি সাহিত্য। সব ঠিকঠাক এবং সাজানো। আমি বইগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখি। কেন জানি আমার চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে।

রিকশা করে বাড়ি ফেরার সময় নিজেকে খুব ফুরফুরে লাগছিল। অথচ এই আমিই সাত দিন আগেও অফিস শেষে বাসায় ফিরতে ক্লান্তিতে ভেঙ্গে পড়তাম।

রিকশা উড়ছে। আমি ভাবি। আমার কষ্ট লাগছে না কেন? কেন আমার মধ্যে হাহাকার জাগছে না? কেন ভেঙ্গেচুরে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছি না?

আমার তো এখন মন খারাপ করে থাকার কথা। আমার তো বিচ্ছেদের যন্ত্রণা অনুভব করার কথা। আমার তো বার বার মোবাইল দেখার কথা। ওর কোনও ফোন এসেছে কি না? বা কোনও মেসেজ! এসব কিছুর প্রতি আমার আকর্ষণ কাজ করছে না। বরং ঐ যে আকাশে চাঁদ দেখা যাচ্ছে রিকশা থেকে, সেই চাঁদের প্রতি আমার আকর্ষণ বেশি। এই যে রিকশায় উড়ে যাচ্ছি- এই অনুভূতিতে সুখ পাচ্ছি ভীষণ।

বাসায় ঢুকেই বুকটা ধক করে ওঠে। সে বসে আছে সোফায়।

উঠে আসে আমার কাছে। হাত ধরে, সরি বলে।

আমি কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম ওর দিকে।

তাকিয়ে আমি কী দেখছিলাম? দেখছিলাম ওকে কি আমি এখনো ভালোবাসি? এই লোকটার প্রতি কি এখনো আকর্ষণ কাজ করে যে আকর্ষণের জোরে অপমান ভুলে ওর সাথে আবার ফিরে যাব?

না, একে আমি আর ভালবাসি না।

হাত ছাড়িয়ে নিলাম। শীতল চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, “যে বাসা থেকে আমাকে কেউ বের হয়ে যেতে বলে সে বাসা আমার না। আর যে বাসা আমার না সে বাসায় আমি আর কখনো ফিরে যাব না।”

বলেই সোজা বাথরুমে ঢুকলাম। আজ দাঁতের ব্যথা অনেক কম। মনে হয় উঠে গেছে পুরোটা।