September 20, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

ফিস ফিস! ফাস ফাস!

সান্দ্রা নন্দিনী।। আচ্ছা মনে করুন একদিন আপনার কোনও এক বন্ধুস্থানীয় নারী যদি আপনাকে এসে বলেন, প্রায় ১৫ বছর আগে তাকে ধর্ষণ করেছিল এমন একজন যে পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়লের শিক্ষক হয়েছে, যে কোনও এক বিশেষ অবদানের জন্য রাষ্ট্রীয় সম্মাননা পেয়েছে এবং বেশ কয়েকবার বিদেশে গিয়ে দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছে। তিনি যদি বলেন, এখন তিনি সবাইকে ওই ব্যক্তির সেদিনের সেই ঘৃণ্যকর্মের কথা জানিয়ে দিতে চান, আপনি তখন তাকে ঠিক কী কী বলবেন?

আপনি তাকে তখন যা যা বলবেন সেগুলো আমিই বলে দিচ্ছি-“আগে না বলে এতদিন পর এসব বলার মানে কী? তার এখন একটা সংসার আছে, বউ-বাচ্চা আছে, সমাজে একটা গ্রহণযোগ্যতা আছে, কী দরকার এতদিন পর এসব পুরনো কাসুন্দি ঘাটতে যাওয়ার?” কিংবা হয়ত প্রশ্ন তুলবেন, আসলেই সেদিনের ঘটনাটি ‘ধর্ষণ’ ছিল নাকি সেই মেয়েটিরই চূড়ান্ত আগ্রহের কারণে ঘটেছিল অথবা এতদিন পর সামাজিকভাবে সেই মহান পুরুষকে হেনস্থা করে সেই নারী কিছু হাতানোর ধান্ধায় আছে কিনা সেটা নিয়েই! আর এরপরই আপনি তাকে একটি বিশেষজ্ঞ মতামত জানিয়ে দেবেন, “তারচেয়ে এতদিন যখন চুপ করে থাকা গেছে, শুধু শুধু আর জল ঘোলা করার দরকার নেই। তাছাড়া শাস্তি তো আর তার হবে না কিছু, লোকে বরং তোমাকেই ‘খারাপ’ বলবে।”

এবারে আরেকটা উদাহরণ দেই। ধরা যাক আপনার আরেক পরিচিত এক নারী একসময় নিয়মিত থিয়েটারে অভিনয় করতেন। থিয়েটারে অনেক সময়ই বিভিন্ন দৃশ্য ও সময় বোঝানোর খাতিরে শো চলাকালেই পোশাক পরিবর্তন করতে হয়। তিনি যদি কখনো আপনাকে এসে জানান, কয়েক বছর আগে কোনও এক নাটকের শো চলাকালে উইংগসের পাশে দাঁড়িয়ে (সময়, সুযোগের অভাবে) পোশাক পরিবর্তন করার সময় তার এক পুরুষ সহ-অভিনেতা ওপারের উইংসের এককোণে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, তারিয়ে তারিয়ে তাকে দেখে গিয়েছে এবং একপর্যায়ে আপনার সেই পরিচিতার সঙ্গে তার চোখাচোখি হওয়ার পরও সে তার দৃষ্টি সরিয়ে নেয়নি? অর্থাৎ, ধরা পড়ার বিষয়টি তাকে এতটুকুও লজ্জিত বা বিচলিত করেনি!

এই ঘটনাটি জানালেই বা আপনি কী বলবেন? আগের উদাহরণের বেলায় আমি যা যা বললাম তারচেয়ে কিছুটা হলেও খুব একটা ভিন্ন কিছু তো নয়, তাই না? এসব শুনে প্রথমেই আপনি আপনার সেই পরিচিত নারীর কাছে প্রমাণ চাইবেন এবং অবশ্যই তিনি তা দিতে পারবেন না। তখন আপনি বলবেন, যদি এমন ঘটেও থাকে অর্থাৎ (‘যদি’) ঘটেও, তবে তারই আরও সাবধান হওয়া উচিৎ ছিল। আপনি ও আপনাদের মত’রা তাকে বিশ্বাস করাতে বাধ্য করবেন যে, পরিস্থিতি যাই থাকুক না কেন প্রতি ক্ষেত্রে আসলে ‘নারীদেরই’ সাবধান হওয়া উচিৎ। আর সেই নারী তখন নিজেকেই অপরাধী ভেবে ভেতরে ভেতরে আরও ছোট হয়ে যাবেন, হীন্মন্যতায় ভুগবেন। এভাবেই এক সময় তিনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাবেন যে কখনোই আর কাউকে ‘এসব’ জানতে দেওয়া যাবে না।

এবার প্রাসঙ্গিকভাবেই বহুল আলোচিত বা সমালোচিত ‘#মি টু’ আন্দোলন প্রসঙ্গে আসি। অবশ্য একে আপনাদের একটা বিশাল অংশ ‘আন্দোলন’ বলে মনেই করেন না। অনেকের কাছেই এগুলো নারীর ‘গোপনীয়তা’ রক্ষা না করতে পারার এক ক্ষমাহীন ধৃষ্টতা!

২০০৬ সালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মার্কিন মানবাধিকারকর্মী টারানা বুর্কি প্রথমবারের মত ‘#মি টু’ আন্দোলনের সূত্রপাত করেন। সেসময় ছোট পরিসরের এই আন্দোলন শুরুর উদ্দেশ্য ছিলো পরিবার, সমাজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্রসহ যেকোনও জায়গায় নারীর জীবনে ঘটে যাওয়া যৌন হয়রানিমূলক ঘটনাগুলোর বিরুদ্ধে নারীকে দিয়েই মুখ খোলানো। জীবনে ঘটা এসব জঘন্য অভিজ্ঞতা যেন কেউ মুখ বুজে সারাজীবন সহ্য না করে যায় বরং অপরাধীর চেহারা যেন সবার সামনে আসে সেটিই ছিলো মূল লক্ষ্য।

শুরুতে না জানলেও ‘#মি টু’ আন্দোলনের কথা শুনে আমরা প্রথম নড়ে-চড়ে বসলাম যখন ২০১৭ সালে হলিউডের প্রখ্যাত চলচ্চিত্র প্রযোজক হার্ভে ওয়াইনস্টাইনের বিরুদ্ধে গত প্রায় ৩০ বছর ধরে একাধিক নারীকে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠে। ‘দ্য নিউইয়র্ক টাইমস’ ও ‘দ্য নিউ ওয়ার্কার’ তাদের প্রতিবেদনে প্রথম এসব ঘটনা ফাঁস করে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, সে সময় তার বিরুদ্ধে জেনিফার লরেন্স, সালমা হায়েকসহ ৮০জন অত্যন্ত স্বনামধন্য ও বিশ্বখ্যাত নারী টুইটারে তাদের সঙ্গে ঘটা এধরনের অভিজ্ঞতার বিষয়ে মুখ খোলেন। এরপর ২০১৮ সালে ওয়াইনস্টাইনকে নিউইয়র্ক পুলিশ গ্রেফতার করে এবং ২০২০ সালে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো প্রমাণিত হওয়ায় আদালত তাকে ২৩ বছরের কারাদণ্ড দেন।

হলিউডের স্রোতের তোড় একসময় যখন আমাদের প্রাচ্যেও আছড়ে পড়লো, পুরো উল্টো একটা বাস্তবতা দেখলাম সবাই। প্রথমত, এটিকে কেউ পাত্তাই দিলেন না। সাহস করে যে দু’য়েকজন নারী মুখ খুললেন, ভ্রু কুঁচকে সেই ঘটনাগুলোর সত্যতা নিয়েই প্রশ্ন তোলা হলো। এরপর সেগুলোর রগরগে বর্ণনার বিষয়েই সবাই যা একটু মনোযোগ দিলেন। সব শুনে-টুনে ছুঁড়ে দিলেন সেই বিখ্যাত মতামত, “এত কিছু যখন ঘটেছে তাহলে তখন বলেনি কেন? হুহ! যত্তসব অসভ্যতা। সম্মানীয় মানুষদের সম্মান নিয়ে টানাটানি করে কিছু সুবিধা আদায় করতে চায় আসলে। এসব নির্লজ্জ মেয়েগুলোকে ধরে উল্টো-পাল্টা থাপড়ানো উচিৎ (একথাটি আমি নিজের কানে একজনকে বলতে শুনেছি)।”

আমাদের দেশে ‘#মি টু’র মৃদু ধাক্কায় পড়েছিলেন নাট্যগুরু (অনেকের কাছে নাট্যবিধাতা) সেলিম আল দীন। তার কর্মক্ষেত্র জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এক ছাত্রী আনেন সে অভিযোগ। তার বর্ণিত সেসব ঘটনা পড়েও সবাই যথারীতি সেই একই প্রশ্ন তুললেন, “সেলিম আল দীন মারা যাওয়ার পর কেন এসব অভিযোগ তোলা হল, তিনি বেঁচে থাকতে কেন নয়?” অনেকের মতামত, “এগুলো আসলে এসব বাজে মেয়েদের মনোযোগ আকর্ষণ করার স্থূল চেষ্টা!”

বঙ্গদেশে ‘মি টু’র খানিকটা আঁচ পড়তে শুরু করলে আমি আমার আশেপাশের অনেককে বলতে শুনেছি, “ভাই, এখন থেকে ম্যাডামদের থেকে দূরে থাকবেন। বলা তো যায় না কখন আবার মিটু দিয়ে ফাঁসিয়ে দেয়… খ্যাক খ্যাক খ্যাক (সুড়সুড়ি পাওয়া হাসি)!”

আচ্ছা শুধু শুধু এরকম ‘মিথ্যা নাটক’ সাজিয়ে এই নির্লজ্জ ম্যাডামদের হঠাৎ কীসের এত দায় পড়লো সমাজের চোখে এরকম ‘পূজনীয়’ বা অপূজনীয় ব্যক্তিদের হেনস্তা করার? এতে তাদের লাভটাই বা কী? প্রমাণ দিতে না পারা মানে তো তার অভিযোগ ‘সত্য’ নয়। অথবা ‘এতদিন পর’ এসব ঘটনা প্রকাশ করার মানেও ওই একই। অর্থাৎ, এগুলো আদৌ কোনদিন ঘটেনি এবং ঘটেও না!

একজন নারী তার জীবনের এত গোপনীয় ও স্পর্শকাতর কিছু অভিজ্ঞতা যেগুলো মনের মধ্যে এত সংশয়, ভয় আর সমাজে নিজের ও পরিবারের গ্রহণযোগ্যতার কথা চিন্তা করে এতদিন চেপে রেখেছিল, একটু একটু সাহস জমিয়ে অনেকদিন পর হলেও সে যখন সেগুলো জনসম্মুখে আনার সিদ্ধান্ত নেয়, সে বিষয়টি আপনাদের কাছে এতই ঠুনকো, হাস্যকর, ভিত্তিহীন ও মূল্যহীন কেন মনে হয়?

সমাজে আজ আশঙ্কাজনকহারে ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে। রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্রে, এমন কি বাড়িতেও নারীকে যৌনহয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। ভিকটিম নারী যখন সেগুলো প্রকাশ করে বিচার দাবি করেন, কেন মনে হয় না এই সময় তাকে সমর্থন জানিয়ে আমাদের যে কারোরই তার পাশে থাকা উচিৎ? তাদেরকে সাহস দিয়ে, উৎসাহ দিয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করার পথটি যতখানি সম্ভব মসৃণ করতে এগিয়ে আসা উচিৎ?

এসব নিয়ে আর কোনও ‘ফিস ফাস’ নয়। ভুক্তভোগী নারী নন বরং অপরাধীরা ভয়ে কুঁকড়ে থাকবে, লজ্জা পাবে, অনুশোচনা-অপরাধবোধে ভুগে ধুঁকেধুঁকে মরলেই কেবল হবে না, আইনগতভাবে তাদের কৃতকর্মের শাস্তি নিশ্চিত করতেই হবে।

এ বিষয়ে আমরা সকলেই কি যার যার জায়গা থেকে এক ধরনের দায়বদ্ধতা বোধ করি না? না করলে তবে আর সমাজে বাঁচি কেন?

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]