November 2, 2024
সাহিত্যগল্পফিচার ২

চিত্রাঙ্গদা

সাবরিনা শারমীন বাঁধন।। অবাঙালি মেয়ে, কিন্তু দারুন বাংলা বলতে পারতো। রবীন্দ্রনাথ ভালবাসতো খুব, ভাল রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতো। নামকরা ওস্তাদজীদের কাছে তালিমও নিয়েছিল। ক্লাসিকাল শিখলেও রবীন্দ্রসঙ্গীতের জন্য ওর কণ্ঠে আলাদা একটা দরদ ছিল। সাহানা বাজপেয়ী ছিল তার অলটাইম ফেবারিট। ওর সমস্ত গান মুখস্ত ছিল।সময়-অসময়ে গাইতোও।

ঘন কালো কোকড়া চুল, শ্যামবর্ন, চোখ কথা বলত। লেখাপড়ার এভারেজ ছিল। আমি যেখান থেকে হোটেল ম্যানেজমেন্ট পাশ করেছি সেইখান থেকে সে একই সাবজেক্টে পাশ করেছে, কিন্তু আমার অনেক জুনিয়র। আমি পাশ করারও অনেক পরে ও ভর্তি হয়। বয়সে কম করে দশ/বারো বছরের ছোট তো হবেই!

প্রথম দেখলাম ইন্টারভিউ বোর্ডে, আমি যে হোটেলের এইচআর হেড ছিলাম সেই হোটেলে ও হাউসকিপিং ম্যানেজার পোস্টের জন্য ইন্টারভিউ দিতে আসে। সিভি হাতে নাম দেখেই আমি একটু নড়েচড়ে বসি। অবাঙালি মেয়ের নাম চিত্রাঙ্গদা সিং!

ইন্টারভিউ খুব সাবলীলভাবেই ক্র্যাক করেছিল। নলেজ বেশ ভাল।

চাকরির শুরুতেই নিজের কাজের দক্ষতা দেখাতে সক্ষম হওয়ায় প্রমোশনে অসুবিধে হয়নি কখনো।

এরই মাঝে ওর সাথে আমার বন্ধুত্ব হতে লাগলো।

ওর পরিবার, বাড়িঘর সব গল্পই শোনা শেষ। মনে হল, সৎ মানুষ, সরল,প্যাঁচালো নয়। চাইলে পাঁচটা বানিয়েও বলতে পারত পরিবার নিয়ে অথচ না, সাবলীলভাবেই বলল কত লড়াই করে তাকে এই অব্দি আসতে হয়েছে। বোঝা গেল হাই অ্যাম্বিশাস মেয়ে। কাজের সাথে নো কম্প্রোমাইজ।

সত্যি বলতে মেয়েটার প্রতি ততদিনে আমার আগ্রহ বাড়তে লাগল, বলা যায় প্রেমেই পড়ে গেছি কিন্তু বলতে পারছিনা। আর বন্ধু মহলেও জানাতে পারছি না ওর কথা। কেননা সবাই জানত আমি সন্ন্যাসী গোছের মানুষ। সেখানে প্রেম ট্রেমের কথা জানতে পারলে এমন পেছনে লাগবে সকলে!

আমার মা বাবা দুজনাই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। আমি তাদের একমাত্র সন্তান। শখ করে নাম রেখেছিলেন এস্রাজ আর বাবা- মা’র টাইটেল এক থাকায় চ্যাটার্জী। এই হল এস্রাজ চ্যাটার্জী।

বাড়িতে থরে থরে বই ছিল। সপ্তাহান্তে বাবা-মায়ের বন্ধুরা আসত, বই নিয়ে আড্ডা বসত। বাড়িতে রবীন্দ্র জয়ন্তী হত। হত পহেলা বৈশাখ। পূজো আচ্চার কোন বালাই ছিল না। কিন্তু পূজো কি বড়দিন বা ঈদে আমরা আনন্দ করতাম। বাড়িতে অতিথি আসতো জম্পেস খাওয়া-দাওয়া হত। বছরে এক-দুবার বেড়াতে যেতাম।

মা-বাবা জানতেন আমার বিয়ে নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা নেই। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে বিদেশ থেকে পড়ে ফিরে যখন মা জিজ্ঞেস বললেন, একটা মেমও তো আনতে পারতি!

আমি হেসেই খুন।

একদিন নাস্তার টেবিলে মাকে চিত্রাঙ্গদার কথা বলতেই মা বিনাবাক্যে রাজি। হয়ত ভেবেছিল, যে ছেলেটা সংসারী হোক। তারা না থাকলেও আমি একা হবো না। এটুকুই।

কিন্তু এতকিছু চিত্রাঙ্গদাকে বলার সাহস পাচ্ছিলাম না। ওর পার্সোনালিটি আমি ভয় পেতাম। ভাবলাম বয়সে আমার অনেকটা ছোট, বললে বন্ধুত্বটাও না যায় জলে!

ভাবতে ভাবতেই আমার জন্মদিন চলে এলো। রাত্তিরে ১২ টায় ফোন করে শুভেচ্ছা জানালো।

তখন সাহস করে মনের কথাটা বললাম। কিন্তু কোন উত্তর এলো না।

অনেকদিন বাদে, ওর জন্মদিনে হ্যাঁ সূচক উত্তর এলে মাকে জানালাম।

মা ওর পরিবারের সাথে আলাপ করে বিয়ে পাকা করলেন। ওদের পরিবার এতটা গোঁড়া ও রক্ষণশীল, তা ওকে দেখলে বোঝার উপায় ছিল না।

বাঙালি বাড়িতে বিয়ে দিতে রাজিই ছিল না প্রথমে। ওর দাদীই প্রতিবাদ করে বললেন, বেটি কি কিসি চিজ পে জিন্দেগিমে তুমলোগো কো নেহি পায়া, আবহি ইতনা বাত কিউ? উস্কা সাদি ইহে পে হোগি।

চিত্রাঙ্গদার ইচ্ছাতেই খুব সামান্য আয়োজনে বিয়েটা হল। আমি অবাক হলাম এ যুগের শিক্ষিত, স্মার্ট, রুচিশীল মেয়ে হয়েও আমার মায়ের বিয়ের বেনারসি আর গয়না পরে বিয়েতে রাজি হয়ে গেল! মা বাবা আর আমি বলেছিলামও, আমাদের সাথে শপিংয়ে চলো। কিন্তু রাজি হয়নি। আমি বললাম, চল আমরা দুজনে কিছু গয়না শাড়ি শপিং করি। বললো, চাইনা। শুধু ঘড়ি আর একটা আংটি আমি দিয়েছিলাম বটে বিয়ের রাতে, কারণ ও দুটো  জিনিস ওর প্রিয় আমি জানতাম।

কিন্তু চিত্রাঙ্গদা আমায় পাকরাও করে আমার বিয়ের পোশাক, মায়ের শাড়ি, বাবার পাঞ্জাবী কিনল।

কি অপরূপ লাগছিল বিয়ের দিন চিত্রঙ্গদাকে। খুব সাধারণভাবেই বিয়েটা হল। ওদের পক্ষের লোক কমই বরং আমাদের বেশি। শুধু একটা পার্টি।

ও শপিং ভালোবাসতো, কিন্তু তা নিজের সামর্থ্যে।

শাড়ি যে ওর অপ্রিয় তা নয়। কিন্তু খুব ভারি কাজ নয়, সাধারণ সুতি, কাঁথা, হ্যান্ডলুম। কলকাতায় দক্ষিণাপন ছিল ওর প্রথম পছন্দ শাড়ি কেনার জন্য। শাড়ির বাতিক ছিল। অফিসে শাড়িই পরত যদি না ফর্মাল পোশাকের ব্যাপার থাকতো।

তার প্রিয় ছিল শান্তিনিকেতন। তাই বিয়ের পর মালদ্বীপ প্ল্যান থাকলেও প্রথমে শান্তিনিকেতন গেছিলাম বেড়াতে।

খুব অল্পদিনেই আমার পরিবারের সকলকে আপন করে নিয়েছিল।

টাফ চাকরি, সংসার, গান,বইপড়া সমান তালেই চালিয়ে যাচ্ছিল।

সাহানা বাজপেয়ীর মা মারা যাবার পরে একটা নতুন গান করলেন। কেয়াফুলের আলো।

খেয়াল করেছি ওটা শুনত আর কাঁদত। কেন? জানতাম। তাই ঘাটিনি।

বছর দুই পরে এক রাতে জানালো, ও প্রেগন্যান্ট। আমি বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না।

ধীরে ধীরে বিভিন্নজটিলতা এল। ওর এ্যজমা হল। রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে পাগল পাগল অবস্থা ওর। আর সারাদিন কাঁদত। জানতে চাইলে বলত আমার কিছু ভাল লাগছে না। হাসানোর জন্য বলতাম সাহানার গান শুনেও কান্না পাচ্ছে? তখন জড়িয়ে ধরে আরও কাঁদত। খাওয়া দাওয়া বন্ধ। শুধু অফিসের সময়টুকু কাঁদত না। একদিন এক বন্ধু  বলল ওয়াইফকে ছুটি নিতে বল। আর্লি স্টেজ তো, একদম ভাঙচুর অবস্থা ওর। তাকানো যায়না। ওদিকে ডাক্তার বললেন, বাড়িতে থাকলে কান্নাকাটি বেশি করে তাই কাজে থাকাই ভাল। ডাক্তার আরও বললেন, অনেক মেয়েই এই সময়টাতে অনেক কিছু ভাবে ফলে তাদের মেন্টাল হেল্থ খারাপ থাকে। কাউন্সিলিংয়ের জন্যও নিয়ে যেতাম।

তারপর দু’মাসের ছুটিতে বাড়ি থাকল। ডাক্তারের পরামর্শে দু’ব্যাগ রক্ত দেয়া হল। আমি অফিস টফিস চুলায় দিয়ে ওকে সময় দিতাম। সময়মত খাবার দিতাম। তখন খাওয়া শুরু করেছিল।

একদিন রাতে ওর অসুস্থ লাগতে লাগল। হাসপাতালে নিয়ে গেলে সাথে সাথেই ওটিতে নিয়ে গেল।

মেয়ের নাম রাখলাম ইচ্ছাপূরণ। ওকে দিয়ে আমাদের ইচ্ছেপূরণ হল, তাই। কোন টাইটেল থাকবে না এটা আমাদের আগের সিদ্ধান্ত ছিল, নামটাও আগেই ঠিক করা ছিল।

কমপ্লিকেশনগুলো কাটিয়ে উঠেছিল প্রবল মনের জোরে। মেয়ের দু’মাস বয়স থেকে অফিস শুরু করল। দু’জন ভিন্ন দু’দিন ডে অফ নিতাম। একদিন সাপ্তাহিক ছুটি আর চারদিন একজন মাসি মেয়েকে দেখাশোনা করতেন আর মা বাবা তো ছিলেনই।

কিন্তু হঠাৎ মা বদলে গেলেন। চিত্রাঙ্গদার অফিস, মেনে নিতে পারছিলেন না। আর গান তো চাপের চোটে নিজেই আর করতে পারছিল না। এই নিয়ে আমরা দুজনেই কষ্ট পেতাম।

একদিন মা রান্নাঘরে কাজ করতে করতে কি এক সামান্য কারণে চিত্রাঙ্গদার হাতে গরম চামচ লাগিয়ে দিলেন।আমায় এসে দেখাল। আমি বিশ্বাস করতে পারিনি, উল্টে চিত্রাঙ্গদাকেই বকাঝকা করি। ও চেঁচামেচি শুরু করলে একটা চড় দিয়েছিলাম।

পরদিন সকালে মেয়েকে নিয়ে চলে গেল চিত্রাঙ্গদা।

অফিস থেকে ফেরার পরে মা বললেন, চলে আসবে ভাবিস না। এমন হয়।

আমি তখন মাকে  কিছু বলব নাকি ওদের ফিরিয়ে আনব তা-ই মাথায় কাজ করছিল না।

আমার কোন স্যরি বা কথাই আর শুনতে রাজি ছিল না চিত্রাঙ্গদা। মেয়ের সাথে দেখা করতে পারতাম চাইলেই। বেড়াতেও পারতাম মেয়েকে নিয়ে, কিন্তু ওর মুখ আর দেখতে পারিনি। কিছুদিনের মধ্যেই অন্য একটা কোম্পানিতে আরও ভাল চাকরি নেয়। অফিস থেকে ফ্ল্যাট গাড়ি পায়। মেয়েকে ভাল স্কুলে পড়ায়। কখনো কিছু দিতে চাইলে মেয়েকে নিতে দিত, কিন্তু নিজে দেখাই করত না, আর নেওয়া তো দূর কি বাত।

মেয়ের খরচ দিলে, মেয়ের জন্য জমিয়ে রাখত, কিন্তু আমার একটা টাকাও খরচ করত না। এসব খবর আমি পেতাম।

আমি একা হয়ে গেলাম। এভাবে একা হওয়া, হেরে যাওয়া, ভালোবাসাহীন জীবন মেনে নেওয়াই আমার জীবন হয়ে গেল।

আজ এতদিন পরে বুঝলাম চিত্রাঙ্গদারা লড়াকু হয়েই জন্মায়। জীবনের নেয়া কোন পরীক্ষায় ওরা হারে না, জীবন বরং ওদের কাছে হেরে যায়।