May 17, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

নিজের একটা ঘর

সাফিয়াজ রাস্না।। আমাদের দেশে বেশিরভাগ নারীকে খুব গর্ব করে বলতে শুনি- আমার জামাইয়ের বাড়ি, আমার বাবার বাড়ি। উল্টোটাও রয়েছে- পুরুষদেরও তাদের স্ত্রীদের উদ্দেশ্যে বলতে শোনা যায়- আমার বাবার বাড়ি বা আমার বাড়িতে থাকছো।

এই যে আমার বাড়ি/ আমাদের বাড়ি- পৃথিবীর অন্য কোন দেশে এভাবে বলে কিনা জানা নেই আমার। শুধু এদেশেই সম্ভব এমন করে হিসেব করা।  সম্ভবত সম্পর্কের চেয়ে আমাদের কাছে গুরুত্ব পায় কারো ওপর আধিপত্য দেখানো, কাউকে ছোট বা নিচু করে কথা বলা।

ছোটবেলা থেকেই স্কুলে সব মেয়েদের মুখে শুনতাম, আমাদের বাড়িতে আসিস। কম্বাইন্ড স্কুলে পড়তাম, ফলে ছেলেদের বলতে শুনতাম- আমার বাড়িতে আসিস। তোদের বাড়িতে গেলে তো তোর বাবা মা পিটাবে। এমনকি আশেপাশের আন্টি/ কাকুদেরও বলতে শুনতাম এমন করে। কখনো প্রশ্ন আসেনি এ নিয়ে। মনে প্রশ্ন এলো যখন একটু বড় হলাম। একদিন এক ছেলে বন্ধু কোচিং শেষ করার পর বললো- আর কদিন পর তো শ্বশুরবাড়ি চলে যাবি। এখন যতটা পারিস বাপের বাড়িতে খেয়ে নে। ঘুরে দাঁড়িয়ে চড় মেরেছিলাম, মনে আছে। পরে ঐ আন্টি এসে নালিশ করেছিলো আম্মুর কাছে। বেচারার কোন দোষ নেই, পরে বুঝেছিলাম। কারণ তাকে তার পরিবার এই শিক্ষা দিয়েছে। ফলে ছেলে বন্ধুরা খুব গর্ব করেই বলতো- তাদের কখনো নিজের বাড়ি ছেড়ে কোথাও যেতে হবে না। খুব গায়ে লাগতো কথাটা, সঙ্গে এক ধরনের অপমান।

যেহেতু ছোটবেলা থেকেই শান্ত কিন্তু জেদি আমি। এটা আমার আম্মু আর আমার বোন খুব ভালো করেই জানে। ‘বাবা’ শব্দটার সঙ্গে পরিচিত হবার আগেই হারিয়েছি। সেই তখন থেকেই মনে হতো- কবে আমার একটা বাড়িঘর হবে, হোক সে ভাড়া বাড়ি- তবু নিজের। আমি বলবো- আমি আমার বাসায় থাকি। পুরুষদের মুখে শুনতে পাওয়া গেলেও, কোন নারীর মুখে এই কথাটা শুনতে পাই না। নারীরা (বেশিরভাগ) যেনো এ কথাটা বলতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে- বাবার বাড়ি, জামাইয়ের বাড়ি।

আমাদের এই সমাজে- একটি মেয়ে জন্ম নেয়া মাত্রই সেই মেয়েটির নিজস্বতা বলে যা থাকে সেটিকে খুন করে ফেলে তার পরিবার, তার আশেপাশের মানুষ আর এই সমাজ। মেয়েটি বড় হয় পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের কথামতো- কী খাবে, কী পরবে, কোথায় যাবে। সব পরিবারের কথা বলছি না। বেশিরভাগ পরিবারেই এমন। ফলে না বাবার বাড়ি, না শ্বশুরবাড়ি, কোথাও তার কোন ঘরবাড়ি থাকে না। একবারেই নেই বলবো না- তবে সংখ্যাটা খুব কম। কারণ আমাদের সমাজের পুরুষরাও সম্ভবত এটা মেনে নিতে পারেন না যে, কোন নারীর নিজস্ব ঘর থাকবে- তাদের ইগোতে বাধে। সে কারণে অনেক চাকুরীজীবী প্রতিষ্ঠিত নারীকেও দেখেছি অনেক অশান্তির পরেও সংসার ছাড়তে পারেন না, কারণ কোথায় গিয়ে দাড়াঁবেন!

পুরুষদের বলছি, এই যে আপনারা আমার বাড়ি, আমার বাড়ি করে মুখে ফেনা তোলেন, ক’জন সুখী এই ছাদের নিচে? আপনার নিজস্ব বাড়িতে? আর নারীরা- যারা জামাই বা বাবার টাকায় কেনা বাড়িতে থাকেন, আর অহংকার করে বলেন, আমার বাবার দেয়ার বাড়ি, আমার জামাইয়ের বাড়ি। একবার ভাবুন তো, আপনাদের মাথার উপরে নিজস্ব ছাদ আছে তো, যেটা নিয়ে আপনি বলতে পারেন এই আমার ঘর, এই আমার বাড়ি!

কর্মব্যস্ত দিন শেষে একটা ঘরই শান্তির শ্বাস নেয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে থাকবে ভালবাসার চাদর দিয়ে মোড়ানো সবকিছু। পুরুষ নারী- কাউকে অসম্মান করে বলছি না। সবার জন্যই কথাটা প্রযোজ্য। নিজস্বতাকে শ্রদ্ধা করুন, অনেক চিন্তাভাবনা পাল্টে যাবে। অঞ্জন দত্তের গানটা সবাই জানি তো-

‘‘চারটে দেয়াল মানেই নয়তো ঘর/ নিজের ঘরেও অনেক মানুষ পর!”

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]