November 21, 2024
ফিচার ১সাহিত্যবই নিয়ে আলাপ

পর্ব-১: শিরীন নিশাত ও যারিনা হাশমি- দ্রোহ আর স্মৃতিকাতরতা

শিল্প সমালোচক, লেখক শার্লট মালিন্সের A Little Feminist History of Art বইটি বাংলায় অনুবাদ করছেন বিশিষ্ট অনুবাদক, শিক্ষক জি এইচ হাবীব। আজ থেকে বইটির অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হবে ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে। আজ পড়ুন এর প্রথম পর্ব।।

নারীবাদী শিল্প আন্দোলনের শুরু ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে। পুরুষ-প্রাধান্যবিশিষ্ট রঙ্গমঞ্চে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়ার জন্যে সে সময় নারী শিল্পীরা তাঁদের কাজগুলোর জেন্ডারচ্যুতি ঘটাবার সংগ্রামে নামেন। এরপর থেকে সেই আন্দোলন শিল্প জগতে গোটা বিশ্বজুড়ে অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন ক’রে আসছে। ‘নন্দনতাত্ত্বিক ফরমালিযম’ ব’লে অভিহিত যুগের পর সামাজিকভাবে প্রাসঙ্গিক নানান ইস্যুতে কথা বলার জন্য ‘নারীদৃষ্টি’-র সাহায্যে নারী শিল্পীরা বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ ক’রে জেন্ডার, পরিচয় এবং ফর্মের দিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন, সমালোচনা করেছেন সাংস্কৃতিক প্রত্যাশাগুলোকে, এবং নারীকে সনাতনী দৈনন্দিন ধারণায় আটকে ফেলার ব্যাপারটিকে। সমাজের দৃষ্টি ঘোরাতে চেয়েছেন সাম্যের জন্যে নারীর সংগ্রাম, এবং নারীদেহকে পণ্য হিসেবে দেখবার মানসিকতা ও ক্রিয়াকর্মের দিকে।

“অল্প কথায় নারীবাদী শিল্প-ইতিহাস” (A Little Feminist History of Art) নামের ছোট্ট বইটিকে এই আন্দোলনের ফসল হিসেবে জাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু শিল্পকর্মের সংক্ষিপ্ত কিন্তু সারগর্ভ ভূমিকা বলা যেতে পারে। ১৯৬০-এর দশক থেকে বর্তমান কাল অব্দি পঞ্চাশটি অসামান্য কাজ নারীর জীবন ও অভিজ্ঞতাকে তুলে ধরেছে। সেই সঙ্গে, ভিয্যুয়াল সংস্কৃতির ওপর নারীবাদী আদর্শ ও রাজনীতি যে প্রভাব ফেলেছে সেটাও এই কাজগুলো মেলে ধরেছে। “অল্প কথায় নারীবাদী শিল্প-ইতিহাস” নামের এই গ্রন্থটি জেন্ডার বৈষম্য, যৌনতা, গার্হস্থ্য জীবন, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর নারী দেহের মতো বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা বিংশ শতকের সবচাইতে উচ্চাকাঙ্ক্ষী, প্রভাবশালী এবং টেকসই শৈল্পিক আন্দোলনগুলোর একটির আনন্দ উদযাপন ।

লেখক পরিচিতি 

শার্লট মালিন্স একজন শিল্প সমালোচক, লেখক এবং সম্প্রচারক। তিনি রেচল হোয়াইরিড, সেসিলি ব্রাউন, র‌্যাচেল লামসডেন,  জেনি স্যাভিল, ক্যাথে ডে মনসাউক্স, স্যু অ্যারোস্মিদ, সুজ্যান কুন, স্যুযি হ্যামিলটন এবং পলা রেগোসহ বিভিন্ন নারী শিল্পীকে নিয়ে লেখালেখি করেছেন। তাঁর রচিত ও প্রকাশিত বিভিন্ন গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে “লাইভ্স অভ্ দ্য গ্রেট আর্টিস্টস” (২০০৮) এবং “র‌্যাচেল হোয়াইহেড” (২০০৭)। তিনি বিবিসি রেডিও ফোর-এর “ফ্রন্ট রো” এবং “স্যাটারডে রিভিউ”-র নিয়মিত প্রদায়ক।

শিরীন নিশাত
(জন্ম. ১৯৫৭)

শিরীন নিশাতের ‘দ্রোহী নীরবতা’ ছবিতে কালো চাদর পরা এক নারী সরাসরি দর্শকের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তাঁর কালো চোখজোড়ায় ভয়ের লেশমাত্র নেই, বরং সেখানে দৃঢ় প্রতিজ্ঞার ছাপ। একটি বন্দুকের নল তাঁর মুখটাকে দ্বিধাবিভক্ত ক’রে আছে এবং ফারসীতে লেখা কিছু চরণ তাঁর দুই গাল আর কপাল জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে। পশ্চিমের চোখে ফারসী লেখাগুলো অপাঠ্য বা আলংকারিক মনে হতে পারে। কিন্তু যাঁরা ভাষাটির সঙ্গে পরিচিত তাঁদের কাছে সেটি তাহেরা সাফ্ফারযাদেহ-র লেখা একটি অমর কবিতার কিছু চরণ যেগুলো এই বন্দুক উঁচিয়ে ধরা নারীর গায়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি।

হিজাব এবং চাদর মুসলিম নারীকে দমিয়ে রাখে, পশ্চিমের এই ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে এই কাজটির মাধ্যমে, ঠিক যেভাবে নিশাত ইরানী সমাজের যে কোনো বাইনারি পাঠকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন তাঁর আরো বিশদ কাজ “আল্লাহর নারীগণ”-এ (১৯৯৩-৯৭)।

নিশাতের জন্ম ইরানে। কিন্তু ১৯৭৯ সালের ইরান বিপ্লবের সময় থেকেই তিনি আমেরিকায় বাস করছেন এবং কাজ ক’রে চলেছেন। তাঁর এই দেশোত্তর অস্তিত্ব তাঁকে দুটো সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত করেছে, অথচ এর কোনোটিতেই তিনি শেকড় গাড়েননি। তাঁর কথায়, প্রতিটি ইরানী শিল্পীই, কোনো না কোনোভাবে, রাজনৈতিক। রাজনীতি আমাদের জীবনকে সংজ্ঞায়িত করেছে, মানে দিয়েছে। ইরানে বাস করলে আপনি সেন্সরশীপ, হয়রানি, গ্রেফতার, নির্যাতন এবং কখনো কখনো হত্যার শিকার হবেন। আর যদি আমার মতো দেশান্তরী হন তাহলে আপনি মুখোমুখি হবেন এক নির্বাসিত জীবনের, পরম আকুতিভরা বেদনা, আর সেই সঙ্গে আপনার পরিবার এবং প্রিয়জনদের কাছ থেকে বিচ্ছেদের।

উল্লেখ্য, শিরিন নিশাত একজন সঙ্গীতজ্ঞ এবং চিত্র পরিচালকও বটে। তাঁর পরিচালিত দুটো চলচ্চিত্র “উইমেন উইদাউট মেন” (২০০৯) এবং “লুকিং ফর উম্মে কুলসুম” (২০১৯) বিপুল প্রশংসা কুড়িয়েছে। ২০১৭ সালে সঅলযবার্গ উৎসবে তিনি গিসেপ ভার্দির বিখ্যাত অপেরা “আইডা”-র নির্দেশনা দিয়েছিলেন, এবং সে প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “কখনো কখনো আইডা আর আমার মধ্যে সীমারেখা মুছে যায়।”

চিত্র পরিচিতি: ‘দ্রোহী নীরবতা’, “আল্লাহর নারীগণ” সিরিয থেকে; ১৯৯৪

রেজিন কোটেচড প্রিন্ট এবং ইংক অন পেপার

১১৮.৪ X ৭০.১ সে.মি

 

যারিনা হাশমি
(১৬ই জুলাই ১৯৩৭ – ২৫শে এপ্রিল ২০২০)

যারিনা হাশমি (তিনি অবশ্য চেয়েছেন লোকে তাঁকে তাঁর প্রথম নামেই চিনুক) ১৯৫৮ সালে ভারত ত্যাগ করেন, এবং তাঁর কূটনীতিক স্বামীর সঙ্গে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ান। পরে তিনি নিউইয়র্কে থিতু হন, এবং সেখানেই সমস্ত কাজ করেন। কিন্তু তাঁর সেসব কাজের একেবারে কেন্দ্র হচ্ছে তাঁর শৈশবের আবাস যা ভারতভাগের সময় হারিয়ে গিয়েছিল, কারণ তখন তাঁর মা বাবা দিল্লী ছেড়ে করাচি চ’লে যান।

আবাস বা বাড়ি যখন দূরে বা যখন তার অস্তিত্ব রয়েছে কেবল স্মৃতিতে, তখনকার উদ্বাস্তু দশা বা বাস্তুচ্যুতির বোধকে কেন্দ্র ক’রে যারিনার কাজ আবর্তিত হয়েছে সব সময়। তাঁর “বাড়ি থেকে আসা চিঠিপত্র” নামের কাজে তিনি তাঁর বোন রাণীর উর্দুতে লেখা কিছু চিঠি হাতে তৈরি কোযো (Kozo) কাগজে প্রিন্ট ক’রে ব্যবহার করেছেন (এই চিঠিগুলোতে পাকিস্তানে থাকা তাঁর পরিবারের লোকজনের মৃত্যুর খবর রয়েছে)। তার ওপর বসানো হয়েছে বিভিন্ন মানচিত্র যেগুলো যারিনের আত্মজীবনীমূলক সফরের প্রতিনিধিত্বমূলক।

তিনি বলেন, “বাড়ির মানচিত্র আর স্মৃতি একজন সফরকারীর জীবনে এক অবিচ্ছেদ্য তাৎপর্য বহন করে। মানচিত্রের সাহায্যে আমি রাস্তাঘাট আর নদনদীগুলোকে চিহ্নিত ক’রে আমার চেনা শহরটিতে আবার ভ্রমণ করতে পারি। বাড়ি সবসময়ই একটা অভ্যন্তরীণ বাস্তবতা যে বাস্তবতার ভেতর দিয়ে আমি বার বার হেঁটে বেড়াতে পারি, যদি আমার কাছে সেই বাড়ির কামরাগুলোর নকশা থাকে।”

দীর্ঘ রোগভোগের পর, মাত্র দিন দশেক আগে ২৫শে এপ্রিল লন্ডনে মারা যান তিনি।

চিত্র পরিচিতি: “বাড়ি থেকে আসা চিঠি-পত্র” (২০০৪)-এর

অন্তর্গত ‘দ্বিতীয় চিঠি’ এবং ‘সপ্তম চিঠি’

সমারসেট পেপার-এর ওপর বসানো

৫৬.৫ X ৩৮.১ সে.মি (শিট সাইয)

[চলবে]

আরও পড়ুন-