November 23, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

নারীর যৌনাকাঙ্ক্ষা ও তৃপ্তি: সমাজের চাওয়া অশ্লীল অবদমন

মেহেরুন নূর রহমান।। আমি ভাবি আমাদের এই সমাজে নারীর জীবন কত কঠিন! কত ভাবে ছোটবেলা থেকে তাদের দমন করা হয়।  কীভাবে তাদের ধরিত্রীর মত সর্বংসহা হতে হবে বলে বড় করা হয়। বলা হয় তাদের নিজস্ব কোন চাওয়া পাওয়া থাকতে নেই আর সেখানে যৌন ইচ্ছা? এ কথা মুখে আনাও পাপ।

নারীর অধিকার সংক্রান্ত বিভিন্ন লেখায় নারীবাদীদের নিয়ে গালাগালি বা বাজে মন্তব্য তো থাকেই, কিন্তু তারপাশে এমন কিছু মন্তব্য থাকে যা  আসলে আমাদের এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর প্রতি যে মনোভাব তারই প্রতিফলন।  বিশেষ করে আপনি যদি নারীর যৌনআকাঙ্ক্ষা কিংবা শারীরিক আনন্দ পাবার ইচ্ছা সম্পর্কে কিছু লিখেছেন তো আপনি পৃথিবীতে সবচেয়ে অশ্লীল, অসচ্চরিত্রের মানুষ।

আপনি যদি বলেন, বিধবার যৌন জীবন উপভোগের অধিকার আছে, মানে আপনি বেহায়া, নির্লজ্জ। আপনি নারীর অর্গাজম নিয়ে লিখেছেন তো আপনি উশৃংখল অভব্য, পর্ন আসক্ত। ভাবা যায়! এই  সহজাত প্রবৃত্তির ব্যাপারটিও উপভোগ করার অধিকার নারীর নাই! অথচ পুরুষদের বেলায় এই আনন্দ পাবার অধিকার ১৬ আনার উপর ১৮ আনা। একটা সমাজ কতটা দ্বিচারী হলে এবং নারীকে কতটা তুচ্ছ মনে করলে এমন ভাবতে পারে। মনে রাখবেন, প্রকৃতি বা সৃষ্টিকর্তা যাই বলেন না কেন, সেই নারীদের এই অনুভূতি পাবার মত একটি শরীর দিয়ে তৈরি করেছে, সুতরাং পুরুষদের মতই নারীরও যৌন ইচ্ছা জাগে এবং তারও অধিকার আছে শারীরিক তৃপ্তি পাবার।

 স্ত্রী পঙ্গু কিংবা অসুস্থ বা মারা গেছে, স্বামীদের শারীরিক চাহিদা পূরণের জন্য নানা উপায় খোলা আছে। তারা আর একটা বিয়ে করতে পারে, বেশ্যালয়ে যেতে পারে, কোন অসুবিধে নেই। কিন্তু কোন নারী যদি একই পরিস্থিতিতে শারীরিক অতৃপ্তি নিয়ে সামান্য হাহাকার করে তাহলেই সে বেশ্যা, নোংরা, নারী নামের কলংক।

আমার বাবা যখন মারা যান তখন আমার মা ৩৮ -৪০ বছরের বিধবা ৭টি সন্তানসহ। কঠোর পরিশ্রম করে নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়ে তিনি আমাদের মানুষ করেছেন। কাছাকাছি সময়ে আমার বাবার এক বন্ধুর স্ত্রী মারা যান। পঞ্চাশোর্ধ ভদ্রলোক ৬ মাস যেতে না যেতেই দ্বিতীয় বিবাহ করেন। তার ৪ সন্তানের কী হবে সেটা নিয়ে তিনি খুব একটা ভাবিত ছিলেন না।  সবাই বলেছিল স্ত্রী ছাড়া একটা পুরুষ থাকে কী করে? তার শারীরিক সুখের ব্যাপারে ওই ভদ্রলোক ছাড়াও পুরো সমাজ চিন্তিত। আমার মা যদি বাবার মৃত্যুর পর কোন কারণে পুনঃবিবাহের ইচ্ছাপ্রকাশ করতেন তাহলে কি তিনি কারো সাপোর্ট পেতেন? তাঁর পরিবার কিংবা সমাজের?

না মোটেই পেতেন না বরং নোংরা মেয়েছেলে বলে খেতাব পেতেন।

আমার কাজিন ২৭ বছর বয়েসে দু’বাচ্চা নিয়ে বিধবা হয়ে হয়ে সারা জীবন একলা থেকে গেলেন আর বাচ্চা মানুষ করে গেলেন। সবাই বলাবলি করে, আহা  কত ভালো মেয়ে! কারো চোখে পড়লো না না মেয়েটির সাথে কী অন্যায় করা হল। পারবে কোন পুরুষ ২৭ বছর বয়েসে বিপত্নীক হয়ে এভাবে থাকতো? তার পরিবারই তাকে সর্বোতভাবে সাহায্য করবে আবার বিয়ে করতে। পুরুষটি শারীরিক সুখ পাচ্ছে না এই চিন্তায় সবাই অস্থির হয়ে যাবে। আর নারীর শারীরিক সুখ? ও বাবা সেটা আবার কাছে নাকি ?

নারীদের এভাবে নিজেকে অবদমিত করে জীবন কাটানোর লক্ষ কোটি ঘটনা আছে আমাদের চারপাশে। কোন বিধবা নারী যদি কোন কারণে কোন পুরুষের সাথে কোন সম্পর্কে জড়িয়ে যায় তাহলে তাকে যে কতটা লাঞ্ছনা পোহাতে হয়!  আর পুরুষ স্ত্রী বর্তমান থাকতেও গৃহকর্মীর সাথে যৌসম্পর্ক করলে কিংবা বেশ্যালয়ে গেলেও মাফ পেয়ে যায়।

অনেক শিক্ষিত পুরুষকে দেখেছি নারীর শারীরিক তৃপ্তিকে অবহেলার চোখে দেখতে। একজনকে বলতে শুনেছিলাম শারীরিক সম্পর্কের প্রধান অবজেকটিভ হলো সন্তান উৎপাদন। চরম পুলক কনসেপ্টটা আধুনিকায়নের ফলাফল। সুতরাং অর্গাজম নিয়ে এতো যে কথা সেটাকে উনি ওভাররেটেড মনে করেন। অথচ এই ধরনের  ভদ্রলোকেররাই নিজের তৃপ্তির জন্য স্ত্রী  ছাড়াও অন্য নারীতে গমন করতে দ্বিধা করেন না।  শুধু নারীর তৃপ্তির  কথা বললেই বড় বড় ভাষণ দিয়ে তাকে চুপ করিয়ে দেবার পাঁয়তারা।

নারীদের বলি, যৌন আকাঙ্ক্ষা নিয়ে যদি আপনি কথা বলেন, তাহলে আপনি মোটেও নোংরা নন। মেয়েদের অবদমিত করে রাখার এই পুরুষতান্ত্রিক ধারণাটিই বরং অশ্লীল। পুরুষদের মতই শারীরিক সন্তুষ্টি পাবার অধিকার আপনার আছে। এ নিয়ে কথা বললে পুরুষরা  যদি নোংরা  না হন তাহলে আপনি কেন হবেন?  নিজেকে অবদমন করে ভালো মেয়ে হয়ে থেকে নিজেকে আর কতটা বঞ্চিত করবেন?  নিজেকে জানুন, নিজের শরীরকে জানুন, আদায় করে নিন আপনার অধিকার। কারো ক্ষতি না করে, এই নারীবিদ্বষী পুরুষতান্ত্রিক ইতর সমাজকে লাথি মেরে নিজের আনন্দে বাঁচুন।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]