May 16, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

সফল নারী মানেই ‘চরিত্রহীন’

তৌকির ইসলাম।। প্রতিটি মানুষ চায় তার ব্যক্তিজীবনে সফল হতে। আর সফল হওয়ার জন্য প্রয়োজন মানুষের শিক্ষা, মেধা, যোগ্যতা, দক্ষতা। কিন্তু আমাদের সমাজ একজন নারীর সফল হওয়ার জন্য কতটুকু সহায়ক!

আমাদের সমাজ পুরুষতান্ত্রিক আর পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর সফলতা অর্জন অনেকটা লঙ্কা থেকে সীতাকে উদ্ধার করে আনার মত। গত কয়েকদিনে ‘মুনিয়ার মৃত্যু’ এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া বুঝিয়ে দেয় যে আমরা এখনো কতটা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বসবাস করছি।

অনেক পুরুষ তার কর্মক্ষেত্রে বসদের খুশি রাখতে অবিরাম চেষ্টা করে যান। কেউ হয়তো বসের সব কথায় হ্যাঁ হ্যাঁ করেন, কেউ হয়তো বসের সবকিছুতে ভালো দেখতে পান। ফলশ্রুতিতে আসে পদোন্নতি, আসে চাকরির নিশ্চয়তা। কিন্তু একজন নারী কি শুধু এতটুকু করলেই পার পেয়ে যান! মোটেও নয়। বহু নারীকে নানান পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। কাউকে কাউকে কখনো হতে হয় বসের সফর সঙ্গী, না হয় কখনো বা বাধ্য হয়ে যেতে হয় নানা পার্টিতে। নারীর শিক্ষা, মেধা, দক্ষতা সব কিছু পড়ে রয় এক দিকে, নারীর দেহ বিবেচিত হয় আরেক দিকে। কারণ সমাজ এখনো নারীকে ৩৬/২৪ এই অংকে হিসেব করতে শিখেছে, মানুষ হিসেবে নয়।

মুনিয়ার মৃত্যুর পর তার চরিত্র নিয়ে, তার অদূরদর্শিতা নিয়ে অনেকে অনেক মন্তব্য করেছেন। কারো চোখে সে গোল্ড ডিগার আবার কেউ কেউ তার বয়সের দোষ বিবেচনায় নিয়েছেন। কিন্তু অপরাধীকে নিয়ে কিন্তু খুব একটা মাথা ব্যাথা সমাজের নেই। সংবাদে কী এলো না এলো সেটা নিয়ে কোন বিশ্লেষণ এখানে করব না। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রতিক্রিয়াগুলো পড়লে মনে হবে দোষ, ভুল, অপরাধ যা কিছুই হোক না কেন সব কিছু মুনিয়ার। আসলে এই প্রতিক্রিয়াগুলো এই কারণেই সম্ভব যে মুনিয়া একজন নারী। এটাই হচ্ছে এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে তার বড় অপরাধ।

তর্কের খাতিরে যদি ধরেই নেই যে, মুনিয়া গোল্ড ডিগার কিংবা সমাজের চোখে তথাকথিত চরিত্রহীন তাতে কি তার মৃত্যু সমর্থনযোগ্য মনে হয়! আজকে মুনিয়ার জায়গায় ভিক্টিম যদি কোনো পুরুষ হতেন আর অপরাধী যদি সমকামী হতেন তাহলে কি সমাজের প্রতিক্রিয়া একই থাকত? মোটেও নয় বরং সমাজ সমকামিতা নিয়ে অনেক বেশি প্রতিক্রিয়া দেখাত। অপরাধী এবং ভিক্টিম দুইজনেই প্রতিক্রিয়ার মুখে পড়তেন। শুধুমাত্র নারী হওয়ার কারণেই মুনিয়ার প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন। হয়তো মুনিয়া কাউকে কেন্দ্র করে সফল হতে চেয়েছিল, হয়তো সে আসলেই প্রেমে পড়েছিল কিন্তু তাতে কি তার মৃত্যুকে মেনে নেওয়া যায়!

সফল হওয়ার জন্য সমাজ একজন চাটুকার, তেলবাজ পুরুষকে বাহবা দেয়। কিন্তু নারী সফল হলে ধরেই নেয় যে শরীর দিয়ে সফল হয়েছে। আসলে নারীর জন্য সফলতার ধাপগুলো মারাত্মকভাবে পুরুষতান্ত্রিক। একজন নারীর শিক্ষা, মেধা এই সমাজে কম মূল্য পায় তার দৈহিক গঠনের তুলনায়। একটা সম্পর্কের কথাই চিন্তা করুন না। নারী শিক্ষিত, দক্ষ এসবের চেয়ে সে কতটা আকর্ষণীয় তা অনেক বেশি বিবেচিত হয়। আর পান থেকে চুন খসলেই নারীর কপালে চরিত্রহীন তকমা পড়ে যায়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর আবেদন এখনো দেহকেন্দ্রিক। নারী নিজ যোগ্যতায় অফিসের বস হয়েছে, তো সমাজ ভাবে নিশ্চয়ই অন্য কিছু, নারীর প্রমোশন হয়েছে তো নিশ্চয় অন্য কিছু। নারী যদি হেসে অফিসের বসের সাথে কথা বলে, যদি অফিসের বস একদিন তাকে গাড়িতে লিফট দেয় তাহলে অফিসের অধিকাংশ পুরুষের কাছে এই স্বাভাবিক ঘটনা রটনায় পরিণত হবে। আর নারী হবে চরিত্রহীন।

আসলে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীকে চরিত্রহীন আখ্যা দেওয়া সহজ। নারী যদি উচ্চশিক্ষিত হয় তখন সমাজের হজম করতে কষ্ট হয়। নারী যদি বড় কর্মকর্তা কিংবা ব্যবসায়ী হয় তাও সমাজ মানতে পারে না। নারী যদি পাঁচটা খুনও করে, আমাদের সমাজ এখনো হা হয়ে বলে ‘মেয়ে মানুষ হয়ে পাঁচজন মানুষ মারল’। নারী যদি ড্রাগ ডিলারও হয় সমাজ অবাক হয়ে বলে ‘মেয়ে হয়ে মাদকের ব্যবসা করে, মেয়েটার সাহস আছে’। কিন্তু যদি শোনে নারী কোনো পুরুষের সাথে কথা বলেছে, ঘুরতে গিয়েছে তাহলেই সমাজ চোখ বন্ধ করে চরিত্রহীন, রক্ষিতা এসব আখ্যা দিয়ে দেয়। শুধুমাত্র বায়োলজিক্যাল আইডেন্টিটির কারণে সমাজ একই ইস্যুতে নারী এবং পুরুষের ক্ষেত্রে বিপরীত মেরুতে বসবাস করে।

একজন নারী যে যোগ্যতা দিয়ে, মেধা দিয়ে সফল হতে পারে তা এই সমাজ এবং সমাজের পুরুষ এমনকি নারীর নিজের পুরুষ সঙ্গীরও হজম করতে কষ্ট হয়। বেশ কিছু দিন আগে একটা লেখায় পড়েছিলাম যে উচ্চশিক্ষার জন্য যারা বাইরের দেশে যান তাদের মধ্যে অনেক পুরুষ দেশে ফিরে এলেও নারীরা আর ফিরে আসতে চান না। এরকম পক্ষপাতদুষ্ট সমাজে ফিরে না আসাই ভালো।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]