November 24, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

পুরুষে নির্ভরশীল নারী: নিজেকে পূর্ণ মানুষ ভাবেন তো?

মেহেরুন নূর রহমান।। আজকে ইউটিউব-এ একটি নাটক দেখছিলাম। একালের জনপ্রিয় টিভি অভিনেতা অভিনেত্রীরা অভিনয় করেছেন। নাটকের কাহিনী এ রকম –

স্ত্রীর শরীর খারাপ, সে প্রায়ই স্বামীকে বলে যে তার শরীর ভালো লাগেনা, কিন্তু স্বামী ব্যস্ততার কারণে তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে পারেনা। একবার ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায় কিন্তু শেষ মুহূর্তে  স্বামীটির কাছে জরুরি ফোন কল আসায় ওদের ফিরে আসতে হয়। এক পর্যায়ে স্ত্রীটি বেশি অসুস্থ হয়ে গেলে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, কিন্তু তখন দেরি হয়ে গেছে এবং স্ত্রীটি মারা যায়। স্বামী দুঃখে আহাজারি করতে থাকে যে কেন সে সময়মত স্ত্রীকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে এলো না। এই মৃত্যুর জন্য সেই দায়ী ইত্যাদি ইত্যাদি। নাটকটির নিচে কমেন্টে সবাই স্বামীটিকে দোষারোপ করেছে। স্বামীরা কত কেয়ারলেস, নির্দয়, স্ত্রীদের মূল্য দেয় না ইত্যাদি। সব ঠিক আছে, আমি শুধু ভাবছিলাম স্ত্রীটির সমস্যা কী? সে নিজে কেন ডাক্তারের কাছে যায়নি? বেশ চালাক চতুর লেখাপড়া জানা বলেই তো মনে হল। এমনকি যখন তারা ডাক্তারের কাছে গেল, স্বামীর ফোন কল এলো, তখনও কি স্ত্রীটি একা থেকে ডাক্তার দেখিয়ে আসতে পারতো না?

এরকম চরিত্র কিন্তু আমায় আমার বাস্তব জীবনেও দেখেছি অনেক।

একদল আছে যারা স্বামীকে ছাড়া এক পা কোথাও যেতে পারেনা বা যায়না। না ডাক্তার, না শপিং, না কোথাও ঘুরতে। ভয়ঙ্করভাবে স্বামীর উপর নির্ভরশীল। এরা কেউ কিন্তু মূর্খ বা বোকাসোকা নয়। তাহলে তারা এটা কেন করে? করে, কারণ তারা স্বামী ছাড়া নিজেদের অসহায় মনে করে। ছোটবেলা থেকে মেয়ে বলে এরা অনেক “না” এর মধ্য দিয়ে বড় হয়। একা বাইরে যাওয়া মানা, রাত করে বাইরে থাকা মানা, ছেলে বন্ধু থাকা মানা ইত্যাদি।

ঘরের বাইরের প্রতিটি কাজের জন্য কারো না কারো উপর নির্ভরশীল থেকেছে।

– বন্ধুর বাড়ি যাবে? ভাইকে নিয়ে যাও, সে বয়েসে তোমার চেয়ে ছোট হোক না কেন।

– শপিং এ যাবে? মা, বোন বা বাবার সাথে যাও।

এভাবে অনেক “না” শুনে এবং অন্যের উপর নির্ভরশীল থাকতে থাকতে তাদের আত্মবিশ্বাস গড়ে ওঠেনা, আর তাই বিয়ের পরও স্বামী ছাড়া বাইরের কোন কাজ করার সাহস তাদের হয় না। এরা বেড়ে ওঠে বিয়েকে জীবনের প্রধান লক্ষ্য ভেবে এবং মনে করে বিয়ের পর তার দায়দায়িত্বসহ সকল সমস্যার সমাধান হচ্ছে স্বামী।

আরেক দল নারী আছে চালাক এবং সুযোগসন্ধানী। এরা মনে করে সংসার চালানো, ডাক্তার দেখানো, কেনাকাটা-  এসব পুরুষের দায়িত্ব। তারা আসলে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের এই ধারণাগুলিকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে। আর এই কারণেই এরা সব কিছুতেই স্বামীকে ডাকাডাকি করে। এরা চাকরি করলেও চাকরির টাকা সংসারে খরচ করে না কারণ তারা মনে করে সংসারের সব খরচ স্বামী মেটাতে বাধ্য তা তার যত কষ্টই হোক না কেন।

আমার এক আত্মীয়া ছিল যে তার চাকরির এক পয়সাও সংসারে খরচ করত না। নিজের টাকা জমিয়ে গয়না কিনত আবার স্বামীকে খোঁটা দিত এই বলে যে তার স্বামী কখনোই গয়না কিনে দেয়না, যদিও  সে ভালো করেই জানে সংসার চালানোর পর তার স্বামীর তাকে গয়না দেবার মত সামর্থ্য নেই। আরেকজনকে দেখেছি নিজের জমানো টাকায় টিভি কিনে সবাইকে বলে বেড়াতো আমার টিভি, আমার টিভি। আমি ভাবতাম, ওই নারীর স্বামী যদি বলা শুরু করে- আমার ভাত তুমি খাও, আমার ঘরে থাকো, তাহলে কি ভালো শোনাতো?

উপরোক্ত যে দলেই পড়ুক না কেন নারীর এই আচরণের মূল কারণ আত্মসম্মানের অভাব এবং নিজেকে সম্পূর্ণ মানুষ হিসেবে না ভাবা। নারীর নিজেকে অসম্পূর্ন মনে করার এই ধারণাটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের তৈরি যা অনেক নারী অজান্তেই ধারণ করে, কখনো অসহায় হয়ে, কখনো চালাকি করে।

মানুষের নিজের উপর নির্ভরশীলতা তখনই বাড়ে যখন সে নিজেকে কারো চেয়ে কম মনে না করে এবং নিজেকে সম্পূর্ণ মনে করে। আত্মমর্যাদাসম্পন্ন একজন মানুষ কোনভাবেই যে কাজ নিজের পক্ষে করা সম্ভব সে কাজের জন্য অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়না। পরনির্ভরশীল মানুষ কারো কাছেই সন্মান পায়না।

আপনার হাত আছে, পা আছে, মাথা আছে, ঠিক আপনার পুরুষ সঙ্গীর মত, তাহলে বাইরের সব কাজের জন্য কেন আপনি তার উপর নির্ভর করবেন? সংসার আপনাদের দুজনেরই, তাহলে সংসারের সম্পূর্ণ খরচ আপনার স্বামীকেই কেন বহন করতে হবে যখন আপনিও চাকরি করছেন? নিজে আয় করার পরও অন্যের উপর নির্ভরশীলতা কি লজ্জার নয়? নিজে আয় করার পরও যদি আপনি ভাবেন সংসার চালানোর দায়িত্ব শুধু পুরুষেরই, তার মানে হলো আপনি নিজেই নিজেকে স্বামীর সমকক্ষ মনে করছেন না। এক্ষেত্রে পুরুষটি যদি তাই মনে করে থাকে তাহলে কি তাকে দোষ দেয়া যায়?

যে কোন ফর্মেই হোক, পুরুষের উপর নারীর এই অতি নির্ভরশীলতাই পুরুষদের চোখে তাদের ঊন করে রাখে, ছোট করে রাখে এবং তারা অতি সহজেই নারীকে অপমান করার সাহস পায়।

সন্মান, স্বাধীনতা এমনি এমনি আসেনা, আদায় করে নিতে হয়। নিজেকে আত্মনির্ভরশীল ও আত্মসম্মানজ্ঞানসম্পন্ন একজন সম্পূর্ণ মানুষ ভাবার মাধ্যমেই তা সম্ভব।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]