May 15, 2024
ফিচার ২মুক্তমত

নিজের পায়ে দাঁড়াতেও কেন এত অনুমতি আর কৃতজ্ঞতা?

প্রিয়া দেব।। ছোটবেলায় আমি যখন আমার প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটা পিছিয়ে পরা গ্রামের শ্যাওলা মাখা স্কুলে যেতাম তখন প্রায়ই আমার হাড় জিরজিরে শুকনো বন্ধুবান্ধবের মায়েরা ব্যস্ত থাকতেন নিজদের হাঁস মুরগী পালনে। স্কুলের পাশের অনেকগুলো বাড়িতে বউয়েরা কাপড় সেলাই করতেন। স্কুলের সব শিক্ষিকার মতো আমার মাও আমার বেশিরভাগ কাপড় তাদের হাতেই বানাতেন। আমার ছোটোবেলার সব ফ্রকে আমার সেই চাচীদের স্নেহের ছোঁয়া লেগে আছে। সপ্তাহান্তে সব ঘরের বৌ ঝিরা মিলে গল্পের আসর বসাতেন, সে আসরের একটু ছোটো আসর হতো সরকার বাড়ির পুকুর ঘাঁটে। প্রতিটা আসরেই সেসব বৌ মেয়েদের কাজের প্রশংসা করা হতো। যেসব বৌ মেয়েদের প্রশংসা করা হতো তারাও নিজেদের সাফল্যের কথা বলতে ভালোবাসতেন।

কখনো আমার বান্ধবী আসমা খাতুনের মা গল্প করতেন কীভাবে তিনি তার হাঁসের পালকে মহামারী রোগ থেকে বাঁচিয়েছেন, কখনো রাকবুল আলামিনের বোন গল্প করতো সে কাঁথাতে কোন নতুন নকশাটা তুলেছে, সেসব মেয়েদের নাম আমি কখনোই জানতে পারিনি।কারন পিছিয়ে পরা সে গ্রামে মেয়ে বৌদের নাম অমুকের মা এবং অমুকের (অবশ্যই কোনো পুরুষ) বোন হিসেবে সম্বোধন করতে হতো।কিন্তু কখনো তাদের আমি সে বিষয়টার জন্য নিজের কাজ থেকে সরে আসতে দেখিনি।

ক্লাস ফোরে বিয়ে হওয়া জেরিনের বাবা যখন দ্বিতীয় স্ত্রী নিয়ে এসে জেরিনের মাকে চার বাচ্চা সমেত বার করে দিয়েছিলেন, তখন জেরিনের মা একা হাঁস মুরগী আর ছাগল নিয়ে বিরাট সংসার গড়ে তুলেছিলেন, সেখানে আজকে তেরো বছর পর একাই সে মহিলা স্বাবলম্বী। কিংবা জমির মিয়ার বোনটা যখন অসৎ চরিত্রের স্বামীকে ছেড়ে এসে নতুন করে মজনু মিয়াকে বিয়ে করে সংসার শুরু করলো তখন সে যে রোজ কাঁথা সেলাই করে উপার্জন করবে, এ বিষয়ের জন্য সে তার পতি পরমেশ্বরের অনুমতির প্রয়োজন অনুভব করেনি, সে জানতো ওইটা তার অধিকার। যখন এনজিওর লোক আসতো তখন সগর্বে সেসব বৌ মেয়েরা নিজেদের লড়াইয়ের গল্প বলতো। তারা গলা উঁচিয়েই বলতো কীভাবে স্বামী সকালে লাথি মারার পরও তারা নিজেদের হাঁস মুরগীকে খাইয়েছে, কীভাবে শাশুড়ি রাজ্যের সব কাজ কাঁধে চাপিয়ে দেওয়ার পরও তাদের ছাগলের বংশবৃদ্ধি লক্ষণীয় হারে হচ্ছে, কীভাবে রোজ সকালে গরম পানির ছ্যাঁকা খাওয়ার পরও তাদের হাত একের পর এক গল্প বুনে যাচ্ছে নকশী কাঁথাতে।

আজ এতো বছর পর আমি ফেসবুকসহ নানা সোস্যাল মিডিয়ায় অনেক নারী উদ্যোক্তার জয়জয়কার দেখি। অবাক হয়ে লক্ষ্য করি এতো বছরের পরিশ্রমের পর নারীরা সত্যি বুঝতে পারছে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মর্ম। কিন্তু যখনি সেসব উদ্যোক্তাদের ক্যাপশনে লেখা থাকে “আমি কৃতজ্ঞ আমার স্বামীর কাছে কারণ তিনি আমাকে কাজটা করবার অনুমতি দিয়েছেন” কিংবা “শ্বশুরবাড়ি থেকে আমার কাজটাতে কোনো বাধা না আসার কারণে আমি খুবই খুশি, আমি খুবই লাকি এমন শ্বশুরবাড়ি পেয়ে” কিংবা “শ্বশুরবাড়ির  সব কাজ সামলে নিজের কাজ করতে পেরে ভাল্লাগছে”- তখন আমার কেন জানি মনে হয় বিপ্লব কি আদৌ হয়েছে?

কেন একজন আধুনিক নারী মনে করতে পারেন না যে, কাজ করাটা মানুষ হিসেবে তার অধিকার, সেখানে অনুমতি প্রদানের প্রশ্নটাই আসে না। আজকে তো আধুনিক পৃথিবীতে সোস্যাল সাইটে আমাদের নারীদের নিজের নামে চিনতে কোনো বাধা পেরোতে হয়না। আজকে তো একজন আধুনিক পৃথিবীর নারীর স্বামী চাইলেই দ্বিতীয় স্ত্রী এনে লাথি মেরে তাকে ঘর থেকে বের করে দিতে পারেন না। তবে কেন নারীরা এ ধারনা থেকে বের হতে পারেন না যে নিজের পায়ে দাঁড়ানোটা তার অধিকার। সেখানে হস্তক্ষেপ করার অধিকার স্বামী, শ্বশুরবাড়ি কিংবা বাবা কারোরই নেই। যখন অধিকারই নেই তখন কেন আপনি এরকম করে ধন্যবাদ জানাবেন তাদেরকে, কেন অহেতুক মহান হতে সাহায্য করবেন তাদের? তাদের তো মহান হবার তকমা পাওয়ার কথাই না। আপনি কেন খুশি হবেন শ্বশুরবাড়ির সব কাজ সামলে নিজের কাজ করতে পেরে? আপনার তো বোঝা উচিত শ্বশুরবাড়ির সব কাজ করাটা আপনার একার দায়িত্ব না। বিষয়টাকে যতোবার আপনি মহিমান্বিত করবেন ততবার আপনি এটাই প্রমাণ করবেন যে সব কাজ করাটা একমাত্র ঘরের বউ হিসেবে আপনারই উচিত, যতোবার আপনি ধন্যবাদ দেবেন আপনাকে কাজ করতে দেবার জন্য ততবার আপনি প্রমাণ করবেন আপনার কাজটা স্বামীর অনুমতি ছাড়া করা উচিত না। এভাবেই দিনের পর দিন আপনারা শিক্ষিত হয়েও নিজের অধিকারকে গলা টিপে হত্যা করবেন।

আপনাদের থেকে আমার ওই প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামটাই ভালো, সেখানে নারীরা নিজের কাজের জন্য নিজেকে ধন্যবাদ দেয়, নিজের কষ্টের ক্রেডিটটা তাদের আপনাদের মতো সোস্যাল মিডিয়ায় অন্যদের দিয়ে বেড়াতে হয় না, তারা জানে পরিশ্রমের দামটা আসলে কতো বেশি। সে কারণে কোনো অযোগ্যকে তারা সে দামটা দেয় না। আসলে শিক্ষাটা কখনো দামী স্কুল, ভালো রেজাল্ট কিংবা বইপত্র দিতে পারে না যদি না আপনি নিজে শিক্ষাটা নিতে পারেন। দুঃখ একটাই, আমার ওই নাম না জানা চাচী কিংবা বোনেরা সেই যুগের পর যুগ ধরে যে লড়াইটা করে গেছে, আপনারা সে লড়াইটার মূল্য বুঝতে পারেননি। আজ থেকে এক যুগ আগে তারা যে বিপ্লবটা করতে পেরেছে আপনারা সব রকম সুযোগ সুবিধা পেয়েও সে বিপ্লবের যোগ্য হতে পারেননি।

আশাপূর্ণা দেবীর সত্যবতীর লড়াইটা কতোটুকু আসলে নারীরা গ্রহণ করতে পেরেছিলো সেটা বকুল দেখে গেছে, এবং বুঝতে পেরেছে স্বাধীনতার মর্ম না বুঝলে সেটা কতোটা খারাপ হয়ে দাঁড়ায় ভবিষ্যতের জন্য। আপনারাও যদি নিজেদের স্বাধীনতাকে সত্যিকার অর্থে সম্মান করতে না পারেন তবে স্বাধীনতা কখনোই এগোতে পারবে না। আমি সোস্যাল মিডিয়াতে আপনাদের দেখে যখন হতাশ এবং আহত হয়ে আমার সেই গ্রামে ফিরে যাই তখন দেখতে পাই নতুন নামে আমার ছোট ভাইয়ের বন্ধুর মা এখন সেলাই মেশিনে স্বপ্ন বোনেন, কেউ কেউ বিরাট খামারের মালিক। তাদের কখনো দরকার পড়েনা স্বামীকে শ্বশুরবাড়িকে ধন্যবাদ দিয়ে ফেসবুকে পোস্ট লেখার। তারা জানেন তারা যে কাজটা করছেন সেটা তাদের অধিকার। আর অধিকারের লড়াইয়ে তারা কাউকে ছাড় দেননা। তারা এরকমই থাকুক, আপনারা বদলান। শুধু পড়াশুনা করে ডিগ্রীধারী না হয়ে শিক্ষাটাকে বুঝুন, ধারন করতে শিখুন। নিজেরা মানুষের মতো বাঁচুন অন্যদের বাঁচতে দিন।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]