May 16, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

পুরুষ-প্রেমের শয়তানি কারবার ও প্রেমের মনস্তত্ত্বে নারী

সাকিব শাকিল ।। স্বতঃস্ফূর্ত প্রেম বলে পৃথিবীতে কিছু নেই। প্রেম হইলো সুবীর নন্দির সেই গান ‘হাজার মনের কাছে প্রশ্ন রেখে একটি কথাই শুধু জেনেছি আমি, পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু নেই, প্রেম বলে কিছু নেই।’

প্রেমের মহানত্ব প্রকাশ মিথ্যালোকের কারবারি। সাহিত্যিকেরা এই মিথ্যা রটনার কাজের দায়িত্ব নিছে। দায়িত্ব যেহেতু তারা নিছে এইজন্য মানবসমাজের উপর প্রেমের আগ্রাসনের যে ধ্বংসস্তুপ নাজিল হইতেছে সেই দায়ভারও তাদের। প্রেম হইলো দুনিয়ার অসম বণ্টনের মিথ্যা ভাব উৎপাদনের যন্ত্র। অস্ত্বিত্বের ক্ষয়কারী ক্ষার হচ্ছে প্রেম। অস্তিত্ববাদী, ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদী মানুষের জন্য প্রেমের আরাম হচ্ছে ব্যারাম। এই ব্যারামের বৈধতাদায়ক আরামের ব্যবসা যারা করে তারা হচ্ছে প্রেম মিডিয়া আর প্রেম কবি। তারা একজন মানুষের উপর আরেকজনের জুলুমকেই প্রেমের সংস্কৃতির অংশ করে তোলে।

প্রেমের মরা আগুনেও পোড়ে, জলেও ডোবে। পৃথিবীতে প্রেমের মৃত মানুষসকলের এবং প্রেমের আগুনে পোড়া মানুষদের এমনই উপলব্ধি। এই উপলব্ধিকে উপভোগ্য উষ্ণ কোমল ও কুসুমাস্তীর্ণ কইরা যারা সফলতার ব্যবসা করে তারা যেন জলে ডোবা প্রেমের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনায় বসে। যেহেতু প্রেম হইলো আস্ত একটা মনস্তাত্ত্বিক শয়তান, অন্যথায় এই শয়তান দিনরাত অভিশাপের ভূত হয়ে তাড়া করবে তাদের। তারা টেরও পাবে না কি সাপে দংশিলো তাহাদের।

সিনেমার প্রেম বাস্তব জীবনের প্রেমের জটিলতাকে সরলরূপ ঝামেলাতে নিমজ্জিত করেছে। সিনেমা ও আর্ট কালচারের কল্পিত প্রেমের এক্সটেনশনে নিজেরে তৈয়ার করতে মানুষের যে মনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয় বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে সেই লড়াই আরো তীব্রতর কঠিন এক সংগ্রাম। ঠিক এই লড়াইটাতে দিনরাত সংগ্রামরত তৃতীয় বিশ্বের নারীসকল। পৌরুষের যৌনতার জানোয়ারিত্বের কাছে নারীর মনস্তাত্ত্বিক ডিলেমায় নারীর মূল্যবোধের বারোটা বেজে গেছে। প্রেম হইলো তাই একটা মানুষ কর্তৃক আরেকটা মানুষের উপর জুলুম। প্রেমের জুলুমত্বকে মহান করার ব্যবসায় এর প্রধান কারবারি হচ্ছে আর্টকালচার-সিনেমা।

আর্ট কালচারের লোকেরা নারীকে যেভাবে উপস্থাপন করেন সেখানে নারীর অস্তিত্বকে নাই করে দেয়া হয়। সেখানে নারী বলতে কেউ থাকে না। ভিজ্যুয়ালি যে নারী চরিত্রে ভূমিকায় থাকে সে নারীর চালক হচ্ছে আর্টের প্রযোজক। সেই প্রযোজক অর্থলগ্নিকারি ব্যক্তি নিশ্চয় একজন পুরুষ। যৌনতার বস্তু ছাড়া নারীর উপস্থিতি সেখানে বেমানান। জনপ্রিয় আর্টের নারীদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো লক্ষণীয় যে সেখানে একদম নিখুঁত চিত্রে নারীর শরীরের যে ইমেজ তৈরি করা হয় তা নারীর প্রতি অবদমিত যৌন ফ্যান্টাসিরই অনুরূপ। এই ফ্যান্টাসি থেকে তৈরি হয় নারীর প্রতি যৌন সহিংসতার। কেননা বাস্তব জীবনে এমন সৌন্দর্য্যের অধিকারী নারীর নিরাপত্তা এই আর্ট সমাজ ও রাষ্ট্রে তৈরি করতে পারে না। তখন সৌন্দর্য হয়ে উঠে অভিশাপ, একই সাথে প্রচলিত সৌন্দর্যের মানদণ্ডের বাইরে সৌন্দর্যহীন নারীর ক্ষেত্রেও তাও কাজ করে অভিশাপ হিসেবেই, অপমান ও সামাজিক লাঞ্চনা, বঞ্চনার কর্মকাণ্ডে। যেহেতু আর্ট হিসেবে শুধু সুন্দর ও কেবল সুন্দরের প্রোপাগাণ্ডার আধিপত্যই মানব সমাজে ও মানব মনে চলমান।

এই শরীর মূলত বিক্রি হয় মহান শিল্পের নামে যেন সেখানে সকল ধরনের করুণা, মায়া, মমতার প্রকাশ ঘটানো হয় নারীর প্রতি – বাস্তবিক অর্থে এই করুণা ও মায়া এক ধরনের মমতার মাস্তানি ও নারীর নিজস্ব নারীমূলক অভিব্যক্তিকে পুরুষ শিল্পী নিজের আর্টের মাস্তানি দিয়া তৈয়ার কইরা দেওয়ার রাজনীতি। যেন নারী নিজেকে এমনই সৌন্দর্য সুন্দর নিখুঁত করে গড়ে তুলবে নিজেকে, আর শিল্প ও প্রেমের নামে তার উপর অবচেতনে খবরদারি চালাবে কালচারাল পুরুষ সমাজ। নারীর প্রণয় ও প্রেমের ভঙ্গি তাই যত সহজে আমাদের দেখানো হয় তত সহজ কিছু না। নারী সরে গেছে তার নিজস্ব নারীমূলক অভিব্যক্তি থেকে। তার এক্সপ্রেশন জগতের পরিস্থিতির স্রোতের সাথে প্রতিনিয়ত সংগ্রামরত। এই সংগ্রামে কাটানো তার প্রতিটা দিন তাই পুরুষের নিখুঁত যৌনতার আকাঙ্ক্ষা মেটানোর চাহিদায় কর্তব্যরত থাকতে পারে না। কিন্তু প্রেমের দোহাই দিয়া পুরুষ-পাশবিকতা তাকে বাধ্য করে নিজের অস্তিত্ব ও মননের মনোবৃত্তির বিরুদ্ধে দাড়িয়ে ভূমিকা রাখার। নারী নিজেই তার নিজের বিরুদ্ধে হয়ে ওঠে দুর্বিষহ যন্ত্রণার বস্তু। যন্ত্রণার এই বস্তু চালনা করে প্রেম নামক শয়তানের আধুনিক কলকাঠি। এই শয়তানের পক্ষে আছে কেবল আর্ট আর আর্ট, আর ঐতিহাসিকভাবে পাওয়া বাধ্য করার শাস্ত্র মন্ত্র, গান, কবিতা, সিনেমা।

প্রেম হইলো একজনের জোর ও জুলুমের উপর আরেকজনের নাজেহাল হওয়ার ভাষা। পৃথিবীতে কোনো শুদ্ধ প্রেমের ইতিহাস নেই। বিবাহ পরিবার নৈতিকতায় নারীর মনের উপর শুধু পৌরুষেরই আধিপত্য। কোনো শুদ্ধ স্বতঃস্ফূর্ত প্রেম ছিলো না কখনো কারো জীবনে। প্রেম তাই হইলো আস্ত একটা মনস্তাত্ত্বিক শয়তান। প্রেমের খবরদারি যে করতে পারে তার প্রয়োজন হয় চকচকে ধারালো ছুরির, যে ছুরি চালনার স্থান হিসেবে সে বেছে নেয় নারীর মনন ও হৃদয়কেই। তাই  নারীর হৃদয়ের প্রেম যে শুধু ভক্তিও হতে পারে এই ভক্তি কোনো পুরুষ সহ্যকর বিষয় হিসেবে গ্রহণ করতে পারে না। নারীর এই ভক্তির জায়গার স্থানে নিশ্চয় কোনো শরীরি ব্যক্তি পুরুষ থাকে না, সেটা প্রেমেরই নাস্তির ভেতর অবচেতন এক ভক্তি যা দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না। কিন্তু এই ভক্তিতে পুরুষের মন ভরে না যেন পৌরুষ সবকিছু বুঝে উঠলেও তার শুধু চাই আর চাই। তার সবকিছু লুটায়া পড়ে পৌরুষে।

হায়রে আমার পৌরুষ তুমি কার তরে হবে স্থির!

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *