এবারের মত ভুলগুলো শুধরে নিন
ইশরাত শারমীন সঙ্গীতা।। বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছিলাম। একটা মিহিদানার মতো মৃদু বৃষ্টি হচ্ছে, অল্প অল্প ঠান্ডা বাতাস। এবারো সুন্দরবন আমাদের ঢাকাবাসীকে বাঁচিয়ে দিলো। আজ সারাদিন টাইম লাইনে একটা জিনিস দেখতে পাচ্ছি, যে সমস্ত রিপোর্টাররা ঝড়ের নিউজ কাভার করতে বিপজ্জনক এলাকায় গিয়ে খবর সংগ্রহ করছেন, পানির তোড়ে পড়ে যাচ্ছেন কিংবা হাঁটু সমান পানিতে দাঁড়িয়ে আছেন কিংবা বাতাসের তোড়ে খেই হারাচ্ছেন, তাদের নিয়ে ব্যাপক হাসাহাসি হচ্ছে। বলি যে আপনাকে বললে আপনি বাড়িঘর ছেড়ে ওখানে যেতেন? মানলাম যে সে পেশার খাতিরেই করছে, এটাই তার কাজ, করলে টাকা পাবে, কিন্তু তার চাইতে ঝুঁকিটা কম করে দেখছেন কীভাবে? সবকিছু নিয়ে হাস্যরস করা একটা স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেছে।
মহাদুর্যোগ বলি বা মহামারী যাই বলি না কেন, আমাদের অনেক কিছু শিখিয়ে দিচ্ছে, অনেক মানুষকে চিনিয়ে দিচ্ছে। আমাদের সম্পর্কগুলো ভেতরে ভেতরে কতটা ঠুনকো তাই দেখিয়ে দিচ্ছে। এটাই হয়তো মনুষ্যত্ব প্রকাশের শ্রেষ্ঠ সময় ছিল, কিন্তু আমরা সেখানে হেরে গিয়েছি।
ক’দিন আগেই পড়লাম মাকে তার ছেলে জঙ্গলে ফেলে এসেছে, স্বামীর করোনা সন্দেহে বৌ ছেলেমেয়ে তাকে ঘরে ঢুকতে দেয়নি, করোনা ইউনিটে দায়িত্বরত নার্সকে বাড়ি ছাড়ার নোটিশ পেতে হচ্ছে, কুকুর বেড়ালে করোনা ছড়ায় তাই তাদের নিধন করা হচ্ছে, করোনায় মৃত ব্যক্তি বিনা সৎকারে রাস্তায় পড়ে আছে- এমন সহস্র অমানবিকতার নিদর্শন দেখতে পাচ্ছি।
একটু ভিন্ন একটা প্রসঙ্গেই বলি, এই যে আমাদের ভেতর সংবেদনশীলতার এতোটা অভাব এক কারণটা কী? গতকাল আমরা ক’জন এই নিয়ে বলাবলি করছিলাম। একটা বাচ্চার কাছে আসলে অভিভাবক হিসেবে আমার বা আমাদের ভূমিকা কী হওয়া উচিৎ?
আমি যেহেতু তার পৃথিবীতে আসবার একমাত্র মাধ্যম কাজেই তার ওপর কর্তৃত্ব ফলাবো নাকি তাকে নাকে মুখে কিছু তোতাপাখির বিদ্যা গুঁজে দিয়ে সে পরে উচ্ছন্নে গেলে ‘আমার কি আসে যায়’- এই বলে দোষ কাটাবো? না কি তাকেও ছোটোবেলা থেকেই নৈতিক শিক্ষা দেব? এই আলোচনার শেষে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম যে অভিভাবক ব্যপারটা ছড়ি ঘোরাবার মত কোনো পোস্ট না। এখানে এত কিছু দেবার আছে যার কানাকড়িও আমাদের তথাকথিত অভিভাবকরা দেন নাই বলে আজ আমাদের আর আমাদের বাচ্চাদের চরিত্রের এই বেহাল দশা। আমাদের গড়পড়তা অভিভাবকেরা রোজ প্লেট ভরে ভাত, ব্রয়লার মুরগির তরকারী, দামী স্কুলের পড়াশুনা আর আকাশচুম্বী যতো রাজ্যের চাহিদা নিশ্চিত করার পর ধরেই নেই এটাই সর্বোচ্চ দান, আরো বাকি কিছু যে দিতে হয় তার ধারেকাছেও যাবার প্রয়োজন বোধ করি না। সবচাইতে যে শিক্ষাখানা জরুরি ছিলো তা আমরা পাইনি, দেইনি।
আমরা জাতিগতভাবে হিসাব চুকাতে শিখি নি। রবীন্দ্রনাথের ‘ও আমার দেশের মাটি’ নামের বহুশ্রুত একটা গানের মাঝে এমন একটা কথা আছে, যেখানে কবি বলছেন-
‘ও মা, অনেক তোমার খেয়েছি গো, অনেক নিয়েছি মা
তবু জানি নে-যে কী বা তোমায় দিয়েছি মা!’
আমরা শিখিনি যে আমাদেরও দিতে হয়, আমরা কেবল পেতেই শিখেছি। আমাদের বাচ্চারা, আমাদের বাবা মায়েরা, আমরা, আমাদের পারিপার্শ্বিকতা আমাদের অসংবেদনশীল বানিয়েছে। কেউ করলে যে তার জন্যও করতে হয় আমরা সেই বোধ হারিয়ে ফেলছি। আমাদের ভেতর থেকে মায়া মমতা আর্দ্রতা ক্রমশ কমে যাচ্ছে। যে শালিক পাখিটা বাইরে গান গাইছে তার জন্যও আমার কিছু দেবার আছে। যেই গাছের পাতার মায়াবী ছায়ায় আমাদের প্রাণ জুড়ায় তাকে কি আমাদের কিচ্ছু দেবার নেই? এই বোধ আমাদের নাই, সত্যি নাই।
বাবা মা পরীক্ষায় নকল এগিয়ে দিচ্ছেন নিজের সন্তানকে সবার চাইতে সেরা বানানোর জন্য, কাজের মেয়েটার পাতে মুরগীর গলার হাড্ডি আর নিজের সন্তানকে সেরা টুকরাটা পাতে তুলে দেন, যিনি রিক্সা চালান বা বাড়ির ড্রাইভার, তাকে বাচ্চাদের সামনে ধমকে চড় থাপ্পড় মেরে অসম্মান করতে শেখান, আপনি অফিসে যাবার সময় আপনার ল্যাপটপ ব্যাগ আর পানির বোতল ধরবার জন্য চাকর রাখেন, আপনার বাচ্চার জুতার লেইস বেঁধে দেয় তার সমান আরেকটা বাচ্চা। এইসব দেখবার পর বাচ্চাগুলোর সেন্স অফ এম্প্যাথি আসবে কোথা থেকে শুনি? শুধু বাচ্চা বলে না, একটা গোটা প্রজন্মই এমন নিরেট হয়েছে। আমার বয়সী উজবুকের সংখ্যা সবচাইতে বেশি। এরা এতো নির্বোধ, স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক- আমার এদের নিয়ে বড় ভয় লাগে। এই ক্ষুদ্রতা নিয়ে এরা দেশ চালাবে? এদের হাত দিয়ে কোন জনহীতকর কাজ আদৌ কি আসবে? আমরা আসলে কাদের কাছে দেশ ছেড়ে দিচ্ছি? এখনো তো সময় আছে, নিজের কুঅভ্যাসগুলো বদলান, নিজেকে এবারের মত শুধরে নিন।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]