নারী কি চাইলেই নিজের টাকা খরচ করতে পারে?
সৈয়দ মাহী আহমদ।। উপার্জন বা অর্থনৈতিক কাজ করলে নারীরা কি স্বাধীন/ মুক্তভাবে জীবনযাপন করতে পারেন? অর্থাৎ কোন নারী যদি কোনো চাকরি, ব্যবসা বা অন্যান্য খাতে অর্থনৈতিকভাবে শ্রম দেন তাহলে তিনি কি তার ইচ্ছা-পছন্দমাফিক-স্বাধীন-মুক্ত জীবন যাপন করতে পারেন? তিনি কি চাইলেই তার টাকাটা খরচ করতে পারেন? কোনকিছু কিনতে পারেন? টাকাটা কি তিনি আত্মোন্নয়নে কাজে লাগাতে পারেন? এই টাকার মালিক কি তিনি?
আমাদের আশেপাশে অনেক নারী আছেন যারা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত। তারা কেউ চাকরি করছেন, কেউ বিভিন্ন ধরনের শ্রমিক হিসেবে অর্থোপার্জন করছেন। কিন্তু দেখা যায় যে তাদের টাকা তারা ব্যবহার করতে পারছেন না। উপার্জিত টাকা স্বামীর হাতে তুলে দিচ্ছেন। স্বামী তার পছন্দমত টাকাটা ব্যবহার করছেন। অনেক স্ত্রী আছেন যারা আয় করেন ঠিকই, কিন্তু তারা সেই টাকা খরচ করেন না। মাস শেষে টাকা স্বামীর অ্যাকাউন্টে গিয়ে জমা হয়। তারা টাকা আয় করার পর তাদের নিজ ইচ্ছামত টাকা ব্যয় করতে পারছেন না। খরচ, সঞ্চয়ের ব্যাপারে তাদের কোনো অবস্থান বা কথা বলার জায়গা নাই। অর্থাৎ টাকা উপার্জন করলেন স্ত্রী আর টাকার মালিক স্বামী। উপরন্তু এরকম স্ত্রীরা বিভিন্নভাবে শারীরিক, মানসিক ও ভাষিক নির্যাতনের শিকার হোন। স্বামী অনেকসময় অযথাই ঝগড়া করেন। আয়, সংসার বা নিজবাড়ী (পৈত্রিক বাড়ী) নিয়ে খোঁটা দেন ইত্যাদি। এরকম ঘটনা আমরা হরহামেশাই দেখি। তখন আমাদের মনে হয় তারা তো আয় করছেন। নিজের খরচ নিজে চালাতে পারবেন। অর্থনৈতিকভাবে কারো মুখাপেক্ষী না। তাহলে তারা কেন অপমান বা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন! তাদের তো স্বাধীন, স্বাবলম্বী হয়ে চলার ও বেঁচে থাকার কথা। কিন্তু তারা তো উপার্জনহীন নারী, মানে গৃহিণীর মতো করে নিজেদেরকে পুরুষতন্ত্র থেকে বের করতে পারছেন না; বরং নিঃশেষ ও আত্মমর্যাদাহীনভাবে বেঁচে থাকছেন। এর কারণগুলো কী? এরকম কেন হচ্ছে?
উপার্জনহীন নারী যখন নির্যাতনের শিকার হোন তখন আমরা বলি আসলে তাদের যাওয়ার মত জায়গা নাই। কোথায় যাবেন, কী খাবেন, কীভাবে চলবেন? তারা তো নিজেরা উপার্জন করেন না যে চাইলেই স্বামী বা স্বামীর সংসার ছেড়ে চলে আসতে পারেন। তারা যদি নিজে আয় করতেন তখন তারা ছেড়ে চলে আসতে পারতেন। স্বামী বা সংসারে নির্যাতনের শিকার হলে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ করতে পারতেন। তখন স্বামী বা সংসারের অন্য কেউ চাইলেও সহজে শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন করতে পারবে না বা করবে না। তাই তারা জোরারোপ এই বলে যে, নারী যদি অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয় তাহলে সে এরকম নির্যাতন-পীড়ন-অবিচার থেকে মুক্ত হবে। ফলে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া বা টাকা উপার্জন করা নারীর জন্য খুবই জরুরি।
অবশ্যই নারীকে উপার্জন করতে হবে। উপার্জন না করলে জীবন চালানোর জন্য অর্থনৈতিকভাবে পরমুখাপেক্ষী থাকতে হবে। তাই আয় তার জন্য জরুরি। কিন্তু আয় করলেই সে অর্থনৈতিক, পারিবারিক ও সামাজিকভাবে স্বাধীন জীবনযাপন করতে পারবে না। এই টাকার মালিকও তাকে হতে হবে।
আমরা যে দেখি আয় করা বহু নারীও স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করতে পারছেন না তার কারণ হল তাদের ‘আয় করার সুযোগ আছে’ (access to income) ও ‘আয় করার সামর্থ্য’ (ability to earn) আছে; কিন্তু ‘আয়ের ওপর ক্ষমতা’ (power over income) নাই। মানে হলো ‘আয়ের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ’ (control over income) নাই। আর এই নিয়ন্ত্রণ না-থাকার কারণে তারা আয় করেন ঠিকই, কিন্তু সেই আয় ব্যয় করতে পারেন না। ফলে আয় করার পরও তারা ব্যয় করাতে পরমুখাপেক্ষী। এখন প্রশ্ন হলো, আমার আয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ আছে কিনা তা কীভাবে বুঝবো? আয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ তখনই থাকবে যখন-
১. আপনার আয় দিয়ে কোনকিছু কেনার অধিকার থাকবে (Right to buy)
২. আয়কে নিজ অ্যাকাউন্টে সঞ্চয় করার অধিকার আছে (Right to save)
৩. আয়কৃত টাকা দিয়ে কেনা কোন জিনিস বিক্রি করতে পারবেন (Right to sell)
৪. ইচ্ছা ও প্রয়োজন হলে আয়কৃত টাকা কারো সাথে বিনিময় করতে পারবেন (Right to exchange)
৫. আপনার টাকার ব্যবহারের সিদ্ধান্ত আপনার (Right to decide)
৬. আপনার টাকা আত্মোন্নয়নে ব্যবহারের অধিকার থাকবে (Right to utilize for self-development)
আপনার আয়ের সাথে যদি আপনি এই অধিকারগুলো চর্চা করতে পারেন তখন আপনার আয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ (establish control over income) প্রতিষ্ঠা হলো। এবং আপনি তখন অনেকটাই স্বাধীন-মুক্ত ও স্বাবলম্বী জীবন যাপন করতে পারবেন।
আর আয়ের ওপর এই নিয়ন্ত্রণই ‘নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে’ (economic empowerment of women) এর একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক। “অর্থনৈতিক সম্পদের নিয়ন্ত্রণ ও বরাদ্দের সাথে জড়িত বিষয়গুলোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের সক্ষমতাই হলো অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন (Economic empowerment is the ability to make and act on decisions that involve the control over and allocation of financial resources)” [১]। তাহলে ‘নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন’ মানে এই না শুধু টাকা আয় করার সামর্থ্য; বরং ‘নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন’ = টাকা আয় করার সামর্থ্য + আয়কৃত টাকার ওপর নিয়ন্ত্রণ।
“টাকা আয় করার সামর্থ্যকেই অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন বলে (Economic empowerment is generally defined as the ability to earn income)। কিন্তু উপার্জিত আয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ না-থাকলে অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন হবে না (But earning money cannot be equated with controlling it)। . . . আয় ও আয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণই, বিশেষ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়গুলোতে, হলো অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ক্ষমতায়ন (Empowerment in the economic sphere therefore involves both earning and controlling earnings in terms of decision-making)” [২]।
এখন আমরা আরেকটা প্রশ্ন করি- সমাজের উন্নয়নে নারীর অর্থনৈতিক উন্নয়ন কী ভূমিকা পালন করে?
এই প্রশ্নটির উত্তর R L Blumberg তার একটা পেপার Women’s Economic Empowerment as the “Magic Potion” of Development?- এ আলোকপাত করেছেন [৩]। তিনি ‘নারীর অর্থনৈতিক উন্নয়ন’-কে উন্নয়নের magic potion [ম্যাজিক বৈশিষ্ট্য/প্রধান বৈশিষ্ট্য] বলে অভিহিত করেছেন। এবং এই অভিহিত করার কারণ তার সারসংক্ষেপেই (abstract) বলেছেন। তিনি বলছেন “নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতা বৃদ্ধি পেলে বাসায় কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং পুষ্টি, স্বাস্থ্য ও ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ায় টাকা খরচের ব্যাপারে নারীর কথা বলার জায়গা/শক্ত অবস্থান সৃষ্টি হয়। তাছাড়া সন্তান জন্মদানের ব্যাপারেও তাদের নিজ মতামত প্রতিষ্ঠিত হয় (With greater economic power, women gain more say in household decisions and tend to promote – and spend their own money disproportionately on – the nutrition, health and education of daughters as well as sons. They also have more say in fertility, which they generally use to curb it.)”।
নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন হলে সমাজের যেসব ক্ষেত্রে উন্নয়ন হবে, এই পেপারে উল্লেখিত সেই বিষয়গুলো খুব সহজ ভাষায় নিচে তুলে ধরার চেষ্টা করছি-
১. সমাজে লিঙ্গ-বৈষম্য হ্রাস করার জন্য নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন প্রধান বিষয়।
২. নারীর তার আয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকলে (ক) তার আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায়, (খ) পরিবারে গৃহের বিভিন্ন বিষয়ে, অর্থনৈতিক বিষয়ে, সন্তান জন্মদানে, ভূমি ব্যবহার ও সংরক্ষণে তার মতামত প্রকাশ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ বৃদ্ধি পায়।
৩. বিয়ে, বিবাহবিচ্ছেদ, যৌনতা, চলাফেরার স্বাধীনতাসহ নিজের অন্য অনেক বিষয়ে স্বাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে এক্ষেত্রে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের সাথে সামগ্রিক আইনি ব্যবস্থা ও সামাজিক মূল্যবোধ জড়িত। শুধু নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন দিয়ে এসব অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যাবে না।
৪. নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন রাষ্ট্রের সম্পদ ও জীবনকুশলতা বৃদ্ধি করে।
৫. বিয়ের বয়স বৃদ্ধি, জন্মনিরোধ পদ্ধতির ব্যবহার ও শিশুমৃত্যু হার কমানোর সাথে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত।
৬. নারীর প্রতি সহিংসতা কমাতে অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন ভূমিকা পালন করে। তবে এক্ষেত্রে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন, আইন কাঠামো ও সমাজ-ভাবাদর্শের পরিবর্তন ছাড়া সহিংসতা রোধ করা অসম্ভব।
তাছাড়া তিনি আলোচনা করেছেন নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন প্রতিষ্ঠিত হলে সমাজে সংঘর্ষ ও দুর্নীতি (জর্জিয়ার ক্ষেত্রে) কমে এবং আফ্রিকার নারীদের ক্ষেত্রে এইডস রোগের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে। অন্যান্য দিকগুলো আমাদের দেশের সাথে তুলনামূলক কম সম্পৃক্ত বিধায় উল্লেখ করছি না।
ঋণী :
১। https://www.fphighimpactpractices.org/briefs/economic-empowerment/
২। Mangala Subramaniam 2006. The Power of Women’s Organizing: Gender, Caste, and Class in India. Lexington Books, pg 7.
৩। Rae Lesser Blumberg 2005. Women’s Economic Empowerment as the “Magic Potion” of Development?