বক্সিংয়ের প্রথম নারী ধারাভাষ্যকার: এক জীবনযোদ্ধার গল্প
রেহমান মুস্তাফিজ।। ২০ অক্টোবর নিউ ইয়র্কের মরিস বাওয়ার ও এস্টেলে রাপোর্টের কোলজুড়ে আসে তাদের প্রথম সন্তান। মরিস বাওয়ার ছেলে আশা করেছিলেন। যার কারণে জন্মের আগেই আগত সন্তানের নামও রেখে দেন জোসেফ। যদিও মেয়ে জন্মানোর ফলে তার মনে কোন হতাশা ছিল না। নিজের মেয়েকে সে সবসময় ছেলের মতই প্রাধান্য দিয়ে এসেছে। আর পরিবার থেকে এরকম পরিবেশ পেয়ে বড় হয়ে ওঠায় মেয়েটাও বেড়ে উঠেছে নিজের মতো করে। পড়াশোনার প্রতি ছিল প্রবল আগ্রহ। আর বাবা-মায়ের সমর্থনে উচ্চশিক্ষা কখনো তার জন্য বাধা হয়েও দাঁড়ায় নি। ফলাফল ছিল কর্নেল ইউনিভার্সিটি থেকে একই সাথে “গার্হস্থ্য অর্থনীতি” এবং “মনোবিজ্ঞান” এ দুটো বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি। পরবর্তীতে কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করেন মনোবিজ্ঞানের উপর।
১৯৪৯ সালে মাত্র ২২ বছর বয়েসে মেয়েটা হুট করেই তার ভালবাসার মানুষ মিল্টন ব্রাদার্সকে বিয়ে করে ফেলে। জীবন যুদ্ধের শুরু সেখান থেকেই। স্বামী মিল্টন ছিলেন নিউ ইয়র্কের মাউন্ট সেইন্ট হসপিটালের একজন সামান্য ইন্টার্ন মাত্র। মাসিক বেতন ছিল যার মাত্র ৫০ ডলার। কিছুদিনের মাঝেই জন্ম নেয় তাদের প্রথম সন্তানও।
দারিদ্র আর কুইন্স, নিউ ইয়র্কের বিস্ত এলাকার জীবনে একরকম অতীষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। সময়টা ১৯৫৫ সাল। একদিন আচানকই চলে গেলেন কুইজ রিয়েলিটি শো “ডলার ৬৪০০০ কোয়েশ্চেন” অনুষ্ঠানের সেটে। যেটা ছিল সে সময়ের টেলিভিশনের সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান। সেদিনের শ্যুটিং দেখে তার শুধু মনে হচ্ছিলো সে নিজেও অনুষ্ঠানের ভাল একজন প্রতিযোগী হতে পারে। যেই ভাবা সেই কাজ। অনুষ্ঠান চালকদের নিজের ইচ্ছের কথা জানালেন। তো অনুষ্ঠানের নিয়মানুযায়ী কেউ অংশগ্রহণ করতে চাইলে তাকে একটি আবেদনপত্র পূরন করতে হতো। যেখানে নিজের সকল বিবরনের পাশাপাশি লিখতে হত কেন সে নিজেকে এই অনুষ্ঠানে প্রতিদ্বন্দ্বীতার জন্য যোগ্য মনে করে তার কারনও। মেয়েটাও সেদিন তার সকল তথ্য ও বর্ণনা দিয়ে বাড়ি ফিরে আসে।
কিছুদিন চলে যায়। জানা যায় নি সে আবেদনপত্রটার কি হল। এদিকে মেয়েটার আবেদনপত্রটা এ হাত সে হাত ঘুরে অবশেষে আসে কুইজ শো’য়ের প্রডিউসার মার্ট কপলিনের হাতে। আবেদনপত্র দেখেই কপলিনের মাথায় অন্য চিন্তা। কপলিনের মাথায় তখন তার শো’টাকে আরও জনপ্রিয় করে তোলার ভাবনা। এরকম ভাবনা থেকেই মেয়েটাকে ইন্টারভিউর জন্য ডাকা হয়।
ইন্টারভিউর দিন মেয়েটা বসে ছিল কপলিনের সামনে। কপলিনই প্রথম নীরবতা ভাঙ্গে। মেয়েটাকে জানায় তার শো’য়ের একটা নিয়ম হচ্ছে প্রতিযোগীদের পড়াশোনা যে বিষয়ে কুইজের বিষয় হিসেবে সে সেই বিষয় বাছাই করতে পারবে না। অর্থাৎ মেয়েটাও তার কুইজের বিষয় হিসেবে “মনোবিজ্ঞান” বা “গার্হস্থ্য অর্থনীতি” নিতে পারবে না। কপলিনের মনে ভাবনা তখন মেয়েটাকে এমন কোন একটা বিষয় ধরিয়ে দিতে হবে, যেটিকে সাধারণত পুরুষের বিষয় বলে ধরা হয়। এতে করে শো’টা যারা দেখবে তারাও অবাক হবে এবং মেয়েটাকেও বাগে আনা যাবে। তাকে বলা হলো পুরুষদের আগ্রহের কোন একটা বিষয় বেছে নিতে। উদাহরণ হিসেবে বলা হলো আমেরিকান ফুটবলের কথা। কারন তখনো ধারনা করা হত মেয়েদের খেলাধুলা নিয়ে তেমন একটা আগ্রহ থাকে না এবং এ বিষয়ে তারা তেমন একটা জানেও না। আর এই মেয়েকে দিয়ে যদি এমন কোন বিষয় নেয়ানো যায়ই তাতে করে শো’য়ের রেটিং এখনকার চেয়ে আর অনেক বেশি আসবে। মেয়েটা নিজের জন্য কী বিষয় নেবে ভাবছিল। হঠাৎ মনে হলো, তার স্বামী বক্সিংয়ের অন্ধ ভক্ত। স্বামীর সাথে থেকে থেকে নিজেরও পড়া হয়েছে বক্সিংয়ের কয়েক শত “রিং ম্যাগাজিন”। আর তাই নিজের কুইজের বিষয় হিসেবে বক্সিংকেই নিলো সে।
কয়েক সপ্তাহের মাঝেই মুখস্ত করে নিল ২০ ভলিউমের বক্সিং এনসাইক্লোপিডিয়াও। তাকে কোচ হিসেবে দেয়া হলো সাবেক অলিম্পিক বক্সিং চ্যাম্পিয়ন এডওয়ার্ড এগানকে। কয়েক সপ্তাহের পড়াশোনা আর কোচের দেখভালে শো’টাতে সে খুব ভালভাবেই এগিয়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু যখন ১৬০০০ ডলার জিতে গেল তখনই বাধলো বিপত্তি। একজন মেয়ে শো জিতে যাবে সেই ভাবনা থেকে এবার তার কুইজের প্রশ্নও বদল করে দেয়া হলো। এবার আর বক্সিং খেলাটা নিয়ে নয়, সকল প্রশ্ন আসতে থাকে বক্সিং রেফারি নিয়ে। মেয়েটার ফটোগ্রাফিক মেমোরি ছিল অসাধারণ। আর তাই বিষয় বদল করেও তাকে থামানো যায় নি। এবং সেই কুইজ শো’য়ের ইতিহাসে প্রথম এবং একমাত্র নারী হিসেবে জিতে নেয় কুইজ পুরস্কার। পেয়ে যায় ৬৪০০০ ডলারও। যা ছিল তখনকার সময়ের টেলিভিশন অনুষ্ঠানের সবচেয়ে বড় প্রাইজমানি।
দুই বছর পর আবারো অনুষ্ঠান পরিচালকরা অনুষ্ঠানটাকে আরও জমজমাট এবং প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ করে তুলতে অনুষ্ঠানটাকে নতুনভাবে সবার সামনে নিয়ে আসে। যার নাম দেয়া হয় “ডলার ৬৪০০০ চ্যালেঞ্জ”। এবারের প্রতিদন্দ্বী সকলেই ছিল আগের সব চ্যাম্পিয়ন। মেয়েটাও সেখানে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। এবং স্বাভাবিকভাবে যেন তারই জেতার কথা এটা। এবং এবারও সেই জিতে গেল। সে বছর তার জয়ের মাহাত্ম্য আরও বেশি এই কারনে যে সে বছর প্রতিযোগিতায় একমাত্র সে ছাড়া চিটিং স্ক্যান্ডালে জড়িত ছিল সব প্রতিযোগী।
দুই দুইটা রিয়েলিটি শো এবং ১২৮০০০ ডলার জয়ে মেয়েটার দিন রাতারাতি বদলে গেল। দরিদ্রতা ঘুচে গিয়ে জনপ্রিয়তা এসে ধরা দিল। নিউ ইয়র্কের প্রতিটি ঘরেই তার নাম। তাই তাকেও আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয় নি। নিজেই কিছু অনুষ্ঠান প্রডিউস করেছে, করেছে নিজের টক শো, হয়েছে পরামর্শকও। সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং হচ্ছে বক্সিংয়ে তার জ্ঞান দেখে সি.বি.এস তাকে বক্সিংয়ের কমেন্ট্রির অফারও দেয় এবং সুযোগটা সে লুফেও নেয়। বলা হয়ে থাকে সে হচ্ছে বক্সিংয়ের প্রথম নারী ধারাভাষ্যকার।
মেয়েটাকে আরো বলা হয়ে থাকে পপ সাইকোলজির পায়োনিয়র। বর্তমানে আমরা ডিপ্রেশনে বা নিজেদের মানসিক যে কোন সমস্যায় এই যে মনোবিদদের শরণাপন্ন হই এবং তাদের কাউন্সিলিংয়ে সেরেও উঠি, এটা পপ সাইকোলজিরই একটা অংশ। সে যখন এই পপ সাইকোলজি শুরু করে, শুরুতে প্রচুর সমালোচনাও শুনতে হয়েছিল এর কারনে। সবাইকে মানসিক সুস্থতা দেয়া মেয়েটা নিজেও চলে গিয়েছিল গভীর বিষন্নতায়, যখন ১৯৮৯ সালে স্বামী মিল্টন ব্রাদার্স ব্লাড ক্যান্সারের সাথে দীর্ঘদিন যুদ্ধ করে মারা যান। কয়েকবার আত্মহত্যাও করতে চেয়েছিল মেয়েটি। তারপর নিজের সাথে যুদ্ধ করে আবার নিজের কাজের মধ্যেই সকল শান্তি খুঁজে পেয়ে ফিরে এসেছিল। ২০১৩ সালের ১৩ই মে স্বাভাবিক মৃত্যুর মাধ্যমে শেষ হয় তার বর্নিল কর্মময় জীবন।
মেয়েটার নাম ছিল ড. জয়েস ডিয়ান ব্রাদার্স।