May 16, 2024
কলামফিচার ৩

পুরুষকেও একই প্রশ্ন করতে হবে

মেহেরুন নূর রহমান ।। গ্রামীনের ঘর সামলাই, ব্যবসাও সামলাই বিজ্ঞাপনটি দেখে লেখার ইচ্ছে হলো।  মগজের ভেতর ঢুকে যাওয়া কিছু ধারণা থেকে বের হয়ে আসা সত্যি কঠিন।

একটা ছেলে যখন বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয় তখন ছেলেটির স্বাধীনতা চলে গেল বলে একটা রব ওঠে। এ নিয়ে অনেক কৌতুকও আছে, যেখানে ইনিয়ে বিনিয়ে বলা হয় বিয়ের কারণে কী কী ভাবে একটা পুরুষের স্বাধীনতা খর্ব হয়। এখানেই শেষ নয়, অসংখ্য ক্লিশে জোক আছে যেখানে বিবাহিত পুরুষদের স্বাধীনতা হরণ, দুঃখ, স্ত্রী দ্বারা নির্যাতন ইত্যাদিতে অবাস্তব চিত্র বর্ণনা করা হয়।

এসব যখন দেখি এবং পড়ি তখন ভাবি বিয়ে মেয়ে/নারীদের স্বাধীনতা কেড়ে নেয় এটা নিয়ে তেমন কোন কথা কেন হয় না বা এসব নিয়ে তেমন জোক নেই কেন? জোক নেই কারণ নারীর স্বাধীনতার কনসেপ্ট আমাদের সমাজে এখনও ব্রাত্য। নারী স্বাধীনতা আবার কী? এটা খায় না পরে? আর বিয়ে তো হলো নারীর ভবিতব্য। বিয়ে মানে একজন নারী এবং তার পরিবারের উদ্ধারের দিন। বিয়ে ঠিক হলে একটা মেয়ে উল্লাস করবে, আনন্দ করবে, স্বাধীনতা গেল বলে হা হুতাশ করার প্রশ্নই নেই – ঠিক এটাই আমাদের সমাজের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার ধারণা।

অথচ ঠিক করে ভাবলে বিয়েতে পুরুষের চেয়ে নারীর স্বাধীনতা খর্ব হয় অনেক বেশি। তাকে নিজের বাসস্থান ছেড়ে অন্য কোথাও গিয়ে থাকতে হয়। জগৎ সংসারের অসংখ্য এক্সপেকটেশন তার উপর জেঁকে বসে। স্বামী ছাড়াও শ্বশুরবাড়ির সকলের সন্তুষ্টির দায়িত্ব তার উপর বর্তায়। চাইলেই যখন তখন ঘরের বাইরে যাওয়া যায়না। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়া, ইচ্ছে হলেই কোথাও ঘুরতে যাওয়া এসব আর সহজে হয়ে ওঠেনা, তার উপর সন্তান হলে তো পোয়া বারো। আপনি গৃহিনী অথবা চাকুরীজীবী যাই হন না কেন, সন্তাদের দেখভাল, লেখাপড়া, খাওয়া-দাওয়া, পড়াশুনা এসব কিছুর দায়িত্ব প্রথমত আপনার।

একটা ইন্ডিয়ান বাংলা সিরিয়ালের খানিক অংশ দেখলাম। এক মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে। হবু শ্বশুরবাড়ির লোকজন তার ইউনিভার্সিটি যাওয়া নিয়ে অসন্তুষ্ট, যদিও মেয়ে ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রী। মেয়ে ভয়ে ভয়ে কেঁদেকেটে হবু শাশুড়ির কাছে পারমিশন চাচ্ছে!

আমি এমন অনেক পুরুষকে জানি যারা বিয়ের পর এবং বাচ্চাকাচ্চার বাবা হবার পরও প্রতি বিকেলে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে বের হয়। একজন স্ত্রী, একজন বাচ্চাকাচ্চার মায়ের ব্যাপারে কি এটা আমরা ভাবতে পারি?

একবার এক বন্ধুর বাসায় বেড়াতে গেছি, এক লোক গান গাইছে। চমৎকার গলা। আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলাম কে সে? অনেক তথ্যের পাশাপাশি জানলাম তার স্ত্রী স্টেজ ৪ ক্যান্সার রোগী। লোকটি কিন্তু বেশ হাসিখুশি ভাবে গান গাইলো এবং ভোর রাত পর্যন্ত আড্ডা দিলো। কয়েকজন বললো আহা লোকটিরও ব্রিদিং স্পেস দরকার, কাহাতক আর রোগীর সাথে থাকা যায়। যদিও শুনলাম এমন আড্ডা লোকটি প্রায়শই দেয়। এখন কথা হলো কোনো নারী যদি তার ক্যান্সার আক্রান্ত স্বামীকে ছেড়ে সারারাত বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয় তাহলে কি তার বেলায়ও  আমরা বলতে পারবো নারীটিরও ব্রিদিং স্পেস দরকার, কাহাতক আর রোগীর সেবা করা যায়?

আমার এক বান্ধবী, যে একজন উচ্চপদস্ত কর্মকর্তা, তার প্রায়-কিশোর ছেলে বাচ্চাকে রেখে দু’সপ্তাহের জন্য ঘুরতে যেতে চেয়েছিল তার কজন বান্ধবীর সাথে। ট্যুর এর সকল খরচপাতি সে নিজেই বহন করবে, তারপরও তার স্বামী, শ্বশুরবাড়ি কিংবা বাবার বাড়ি থেকে কোন সহযোগিতা পাচ্ছেনা। দু’সপ্তাহের জন্য কেউ দায়িত্ব নিতে রাজি নয়। তাও যদি কাজের সাথে রিলেটেড কিছু হতো, বাচ্চা রেখে ঘুরতে যাবে এটা তো ভীষণ অডাসিটি! কর্মজগতের দায়িত্ব পালনের সাথে সাথে আমার বান্ধবীটি বাচ্চার পড়াশুনা, স্কুল সব সামলাতো যেটা তার স্বামী মাত্র দু’সপ্তাহের জন্য নিজের জব ম্যানেজ করে নাকি করতে পারবে না।

বিয়ে এবং সংসার একটি নারীর স্বউন্নয়নের পথকে কতভাবে রোধ করে তা বলে শেষ করা যাবে না। আমার পরিচিত এক নারীকে দু দুইবার পিএইচডি মাঝপথে ছেড়ে দিতে হয়েছিল শুধু সংসার এবং বাচ্চাদের জন্য। অথচ সেই নারীর স্বামী যখন পিএইচডি করছিল  তখন সেই নারী সংসারের সকল দায়িত্ব ইনক্লুডিং উপার্জনের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল যেন তার স্বামী নির্বিঘ্নে পিএইচডি শেষ করতে পারে। আজকে সম-মেধার অধিকারী হয়েও একজন পিএইচডি  ডিগ্রি হোল্ডার আর একজন এখনো স্ট্রাগল করে যাচ্ছে ।

আমার বান্ধবীরা যারা বিয়ের পর উচ্চতর শিক্ষা নিয়েছে, দেশে কিংবা বিদেশে তাদের কত বাধা, কত কটুকথা, কত অসযোগিতা পেরিয়ে সেটা অর্জন করতে হয়েছে সে গল্প লিখতে গেলে উপন্যাস হয়ে যাবে। শুধু দৃঢ় মনোবলের  কারণে তারা সেটা অর্জন করতে পেরেছে। নিজ চোখে দেখা, অনেক নারীকে বিদেশে পিএইচডি করতে গিয়ে সাথে সন্তানদের নিয়ে যেতে হয়েছে কারণ দেশে থাকা তার স্বামী বা অন্য কোন আত্মীয় সন্তানদের দেখাশোনার ভার নিতে চায়নি। বিদেশে বাচ্চা সামলে, তাদের পড়াশুনা দেখাশোনা করে নিজের পিএইচডি চালিয়ে গেছে। কোনো পুরুষকে কি এসবের মুখোমুখি হতে হয়? দেশে থাকা স্ত্রী গৃহিনী বা চাকুরীজীবী যাই হোক, মনের আনন্দে স্বামী বিদেশে পিএইচডি করছে এর গর্বে গর্বিত হয়ে সন্তানদের দেখাশোনা করে।

একজন জেনুইন মিসোজিনিস্ট পুরুষ হাসতে হাসতে বলেছিল, মেয়েদের মেধা পুরুষদের চেয়ে কম তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ বিজ্ঞানে হাতেগোনা কিছু নারীর নোবেল প্রাইজ পাওয়া। তর্ক করিনি, এদের সাথে তর্ক করাও বোকামি। বিজ্ঞানের মত ফিল্ডে নিজেকে একটা অবস্থনে নিয়ে যেতে গেলে সময় লাগে এবং তার জন্য যে পরিমাণ ডেডিকেশন, সময় দিতে হয় সেটা কি একজন নারী যথাযথ মেধা থাকা সত্ত্বেও সংসার বাচ্চা সামলে সবসময় দিতে পারে? তাকে সাপোর্ট দেবার মতো বা সহযোগিতা দেবার মতো তেমন কেউ কি থাকে? একজন পাগলা বিজ্ঞানীকে পরিবার যত স্নেহের চোখে দেখে, সাপোর্ট দেয়, একজন পাগলী বিজ্ঞানীকে কি সবাই সেই দৃষ্টিতে দেখে? সংসার বা বাচ্চাদের খেয়াল না করে একজন নারী ল্যাবে পড়ে আছে, এটা  ক’জন মেনে নিতে পারে? তারপরও বহু নারী তাদের কঠিন পরিশ্রম এবং ডেডিকেশন দিয়ে বিজ্ঞানের নানা শাখায় আজ স্বমহিমায় উজ্জ্বল।

একজন পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখিকার কথা জানি যিনি আজ সুপরিচিত, কিন্তু তার শুরুটা ছিল কঠিন। তিনি লিখতে শুরু করেছিলেন যখন তার সন্তানরা যথেষ্ট বড়। সংসারের সমস্ত ঝামেলা সামলে তিমি যখন লিখতে বসতেন, তার স্বামী এবং শাশুড়ি ভীষণ অসন্তষ্ট হতো। তাকে লুকিয়ে লিখতে হতো। যতরকম অসহযোগিতা আছে তার সাথে করা হতো। শুধু মনের জোরে সেই নারী লেখক লেখা চালিয়ে গেছেন। কোনো পুরুষ লেখককে কি এসব ফেইস করতে হয়? আজ সেভাবে বাধা না দিলেও তার সাফল্যে সেই নারী লেখকের স্বামী যোগ দেয়না। অথচ একজন সফল পুরুষ লেখকের স্ত্রী গর্ব করে সবাইকে তার স্বামীর সাফল্য বলে বেড়ায়।

এছাড়া সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে চাকুরির অগ্রগতি ব্যাহত হওয়া, প্রোমোশনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়া খুব সাধারণ ব্যাপার। তার উপর বাচ্চাকে কাজের সহযোগীর কাছে  বা মায়ের বাড়িতে রেখে জব করতে গিয়ে নানা কটু কথা তো শুনতে হয়। চাকুরিজীবী মায়ের সন্তান অসুস্থ তো মায়ের দোষ, কারণ মা যথেষ্ট সময় দিচ্ছেনা।  বাচ্চা গোলগাল মোটাসোটা না  কারণ মা চাকরি নিয়ে ব্যস্ত, ঠিকমত খাওয়াচ্ছে না। চাকরি ছেড়ে বাচ্চার জন্য ঘরে বসে থাকলে সবার শান্তি। নারীর নিজের আইডেন্টিটি তৈরির দরকারই বা কী? এটাই সবার মনোভাব।

এককভাবে ব্যবসা করতে গেলে ব্যবসাটিকে দাঁড় করাতে প্রচুর সময় দিতে হয়। ব্যবসায়ী যে কোনো পুরুষকে দেখলেই সেটা বুঝতে পারবেন। একজন মুদি দোকান্দারকেও সারাদিন দোকানে বসে থেকে বেচাকেনা করতে হয়। কোন পুরুষ ব্যাবসায়ীকে ব্যবসা দেখার সাথে সাথে সংসার সন্তানকে দেখভাল করতে দেখেছেন? অথচ একজন নারী ব্যবসায়ী ব্যবসার সাথে সাথে সংসার ও সন্তানদের সঠিকভাবে দেখভাল করবে এটা সবাই আশা করে, না হলে তাকে চুড়ান্ত ঝামেলায় ফেলে ব্যবসা থেকে বেরিয়ে আসতে বাধ্য করে।

উপরের এতো কিছু বলার কারণ বোঝাতে চেষ্টা করা কেন গ্রামীণ ফোন তাদের বিজ্ঞাপনে ঘর সামলাই, ব্যবসাও সামলাই এই লাইনটি ব্যবহার করেছে। নারী – সে জব করুক, ব্যবসা করুক,  শিক্ষক হোক, ডাক্তার হোক, ইঞ্জিনিয়ার হোক বা উকিল, ব্যারিস্টার যাই হোক না কেন, তাদের স্ব স্ব কর্মক্ষেত্রের পাশাপাশি গৃহিনী, মা, বৌমা  ইত্যাদি হিসাবে ভীষণ পারঙ্গম হতে হয়, তবেই সমাজ তাকে সফল বলে ভাবে। যেন একজন নারী সাধারণ কোনো রক্তমাংসের মানুষ নয়, সে সুপার-হিউম্যান। এক বিষম এক্সপেক্টেশনের বোঝা এভাবে একটি নারীর  কাঁধে চাপিয়ে দেয়া হয়। আর কিছু নারী নিজেকে দেবী দূর্গা প্রমাণ করতে গিয়ে জীবনপাত করে কিন্তু কাউকেই খুশি করতে পারেনা। একজন সফল ডাক্তার, ব্যবসায়ী কিংবা উকিল বা ইঞ্জিনিয়ার ঘর সামলায় কি না বা বাবা এবং স্বামী হিসেবে সফল কিনা এই প্রশ্ন কি আমরা করি? তাহলে নারীদের বেলায় এই বৃহৎ আশা কেন?

আপনার কর্মক্ষেত্র আপনার নিজস্ব, সেখানের সফলতা ব্যর্থতা আপনার একার কিন্তু একটা সংসার, সন্তান দুজনের যৌথ ফসল। সংসার সামলানো শুধু একজনের দায়িত্ব হতে পারেনা যেখানে স্বামী স্ত্রী দুজনেই ব্যস্ত। কর্মক্ষেত্রে সফল একজন নারীকে সংসারে সফল কিনা এই প্রশ্ন যদি করা হয় তবে একজন পুরুষকেও একই প্রশ্ন করতে হবে। চাকুরীজীবী বা ব্যবসায়ী একজন নারীকে যদি প্রশ্ন করা হয় আপনারা সন্তানদের কে দেখভাল করছে, সেই প্রশ্ন একজন পুরুষকেও করতে হবে। পুরুষদের বোঝাতে হবে সংসার সামলানো, বাচ্চাদের দেখাশোনা শুধু স্ত্রীর দায়িত্ব নয়। আর আপনার স্ত্রী যখন  ব্যস্ত তার ব্যবসা বা জব নিয়ে, তখন এই দায়িত্ব দুজনকে যৌথভাবে সমভাবে পালন করা দরকার।

আমি মনে করি গ্রামীণ তাদের এই বিজ্ঞাপনে সংসারের কথা টেনে এনেছে  কারণ অনেক পুরুষই সংসারের কথা বলে স্ত্রীকে ব্যবসা করতে বাধা দেয়। এক্ষেত্রে গ্রামীণ তাদের বিজ্ঞাপনে পুরুষদের সংসার পালনের যৌথ দায়িত্ব নিয়ে কথা বলতে পারতো। বলতে পারতো  কী করে একজন আদর্শ পুরুষ তাদের স্ত্রীদের সহায়তা করতে পারে সফল ব্যবসায়ী হতে, সংসার সামলানোর ক্ষেত্রে সহযোগিতার মাধ্যমে। কিন্তু তারা সহজ পথটি বেছে নিয়েছে। তারা সমাজের স্টেরিওটাইপ মনোভাবের বাইরে যেতে পারেনি। তারা পুরুষতন্ত্রকে সাপোর্ট করে গেছে, কোনো প্রশ্ন করেনি। এই ধরনের বিজ্ঞাপন পুরুষতান্ত্রিকতাকে শক্তিশালী করে আর কিছু নয়। আমি মনে করি বিজ্ঞাপনী সংস্থায় আধুনিক মানসকিতার ছেলে মেয়েরা কাজ করে। তারা যখন এই ধরনের কনসেপ্ট নিয়ে কাজ করে এবং কোনো প্রশ্ন ছাড়া প্রকাশ করে তখন হতাশ লাগে।

সবার শুভ বুদ্ধি হোক, নারীকে দশভুজা প্রতীয়মান করে হাজার কাজের বোঝা চাপিয়ে না দিয়ে একজন সাধারণ মানুষ হিসাবে ভাবা হোক এবং সংসার পালনের ক্ষেত্রে, স্ত্রীকে সহায়তার ক্ষেত্রে পুরুষরা এগিয়ে আসুক, নারীরা তাদের অধিকার নিয়ে আওয়াজ তুলুক এই শুভ কামনা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *