পর্ব-৯: বোধ স্বতন্ত্র এবং ফিউশন অস্বস্তিকর
শিল্প সমালোচক, লেখক শার্লট মালিন্সের A Little Feminist History of Art বইটি বাংলায় অনুবাদ করছেন বিশিষ্ট অনুবাদক, শিক্ষক জি এইচ হাবীব। বইটির অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হচ্ছে ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে। আজ পড়ুন এর নবম পর্ব। সব পাঠকের সুবিধার জন্য প্রতি পর্বের শুরুতে বইটির এবং লেখক শার্লট মালিন্সের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দেয়া থাকবে।।
[নারীবাদী শিল্প আন্দোলনের শুরু ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে। পুরুষ প্রাধান্যবিশিষ্ট রঙ্গমঞ্চে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়ার জন্যে সে সময় নারী শিল্পীরা তাঁদের কাজগুলোর জেন্ডারচ্যুতি ঘটাবার সংগ্রামে নামেন। এরপর থেকে সেই আন্দোলন শিল্প জগতে গোটা বিশ্বজুড়ে অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন ক’রে আসছে। ‘নন্দনতাত্ত্বিক ফরমালিযম’ ব’লে অভিহিত যুগের পর সামাজিকভাবে প্রাসঙ্গিক নানান ইস্যুতে কথা বলার জন্য ‘নারীদৃষ্টি’-র সাহায্যে নারী শিল্পীরা বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ ক’রে জেন্ডার, পরিচয় এবং ফর্মের দিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন, সমালোচনা করেছেন সাংস্কৃতিক প্রত্যাশাগুলোকে এবং নারীকে সনাতনী দৈনন্দিন ধারণায় আটকে ফেলার ব্যাপারটিকে। সমাজের দৃষ্টি ঘোরাতে চেয়েছেন সাম্যের জন্যে নারীর সংগ্রাম এবং নারীদেহকে পণ্য হিসেবে দেখবার মানসিকতা ও ক্রিয়াকর্মের দিকে। “অল্প কথায় নারীবাদী শিল্প-ইতিহাস” (A Little Feminist History of Art) নামের ছোট্ট বইটিকে এই আন্দোলনের ফসল হিসেবে জাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু শিল্পকর্মের সংক্ষিপ্ত কিন্তু সারগর্ভ ভূমিকা বলা যেতে পারে। ১৯৬০-এর দশক থেকে বর্তমান কাল অব্দি পঞ্চাশটি অসামান্য কাজ নারীর জীবন ও অভিজ্ঞতাকে তুলে ধরেছে। সেই সঙ্গে, ভিয্যুয়াল সংস্কৃতির ওপর নারীবাদী আদর্শ ও রাজনীতি যে প্রভাব ফেলেছে সেটাও এই কাজগুলো মেলে ধরেছে। “অল্প কথায় নারীবাদী শিল্প-ইতিহাস” নামের এই গ্রন্থটি জেন্ডার বৈষম্য, যৌনতা, গার্হস্থ্য জীবন, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর নারী দেহের মতো বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা বিংশ শতকের সবচাইতে উচ্চাকাঙ্ক্ষী, প্রভাবশালী ও টেকসই শৈল্পিক আন্দোলনগুলোর একটির আনন্দ উদযাপন।
শার্লট মালিন্স একজন শিল্প সমালোচক, লেখক এবং সম্প্রচারক। তিনি রেচল হোয়াইরিড, সেসিলি ব্রাউন, র্যাচেল লামসডেন, জেনি স্যাভিল, ক্যাথে ডে মনসাউক্স, স্যু অ্যারোস্মিদ, সুজ্যান কুন, স্যুযি হ্যামিলটন এবং পলা রেগোসহ বিভিন্ন নারী শিল্পীকে নিয়ে লেখালেখি করেছেন। তাঁর রচিত ও প্রকাশিত বিভিন্ন গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে “লাইভ্স অভ দ্য গ্রেট আর্টিস্টস” (২০০৮) এবং “র্যাচেল হোয়াইহেড” (২০০৭)। তিনি বিবিসি রেডিও ফোর-এর “ফ্রন্ট রো” এবং “স্যাটারডে রিভিউ’’-র নিয়মিত প্রদায়ক]
কোযি ফানি টুটি (Cosey Fanni Tutti)
(জন্ম ১৯৫১)
COUM Transmissions –এর প্রদর্শনী Prostitution-এর প্রস্তুতিপর্বে ব্যয় হয়েছিল দু’বছর, এবং সে-প্রদর্শনী শুরু হয় লন্ডনের ইন্সটিটিউট অভ্ কন্টেম্পোরারি আর্টস-এ, ১৯৭৬ সালের অক্টোবর মাসে। দেয়াল জুড়ে ছিল কোযি ফানি টুটি-র যতো পর্নোগ্রাফিক প্রতিচ্ছবি (জন্মের পর অবশ্য তাঁর নাম রাখা হয়েছিল ক্রিস্টিন ক্যারল নিউবি- Christine Carol Newby)। COUM পারফরেমেন্সগুলোর নানান প্রপ-ও ছিল ছড়িয়ে ছিটিয়ে: কিছু রক্তাক্ত পট্টি ও পুঁটুলি, একটা জংধরা ছুরি, ভ্যাসেলিনের একটা জার। সংবাদ মাধ্যমের যেন মাথা খারাপ হয়ে গেল। সংবাদকর্মীরা প্রদর্শনীস্থল ছেড়ে বেরিয়ে এলেন, এবং এই বিতর্কিত প্রদর্শনী হাউস অভ্ কমন্স-এও আলোচনার ঝড় তুলল।
COUM Transmissions ছিল ১৯৬৯ থেকে ১৯৭৬ অব্দি যুক্তরাজ্যে সক্রিয় পরীক্ষামূলক সঙ্গীত এবং পারফরমেন্স আর্ট ভিত্তিক একটি সমবায়মূলক গোষ্ঠী। জেনেসিস পি-অরিজ এটি প্রতিষ্ঠা করেন। এখান থেকেই সৃষ্টি হয়েছিল সঙ্গীত দল ‘দ্য থ্রবিং গ্রিসল’, কিন্তু সেটার বিতর্কিত শিল্পী ছিলেন কোযি ফানি টুটি । তিনি বাণিজ্যিক পর্নোগ্রাফিক শিল্পে যোগ দেন এবং দু’বছরে সাময়িক পত্রে প্রকাশিত তাঁর দু’পাতা জোড়া চল্লিশটি ছবিই ছিল Prostitution প্রদর্শনীর মূল আকর্ষণ। আলোচিত্রগুলোতে তাঁকে পুরুষদের মধ্যে উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী ভঙ্গিতে, এবং প্রায়ই নগ্ন অবস্থায় দেখা যায়। এ-ব্যাপারে তাঁর বক্তব্য হচ্ছে : “নিজেকে আমি ‘মডেল’-এর ভূমিকায় প্রক্ষেপ করেছি, এটা জেনেই যে কী ঘটছে, আর কী আশা করতে হবে। আমার কাছে এটা আগে-থেকেই-বলে-দেয়া-যায় এমন কিছু। একটা ব্যাপারই কেবল আমাকে স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে, আর তা হচ্ছে নানান জিনিস বা ব্যাপার সম্পর্কে আমার সহজাত উপলব্ধি বা বোধ।” অন্যান্য মডেলের চাইতে তিনি কেমন ভিন্ন ছিলেন সেটা মাত্রার তারতম্যের বিষয়। কিন্তু কোযি তাঁর দেহ এবং লিঙ্গকে (sex) শিল্পসৃষ্টিতে ব্যবহার ক’রে গেছেন, এবং তাঁর কাজগুলো বেশ বিতর্কিত।
শিল্পকর্ম পরিচিতি:
Prostitution-এর পোস্টার; ইন্সটিটিউট অভ্ কন্টেম্পোরারি আর্টস, লন্ডন, ১৯৭৬
কাগজে ছাপা
২৯.৭ X ২১ সে.মি.
লিন্ডার (Linder)
(জন্ম ১৯৫৪)
এই ফটোমন্তাজটি যখন তৈরি করা হয় সে-বছরই লিন্ডা মালভে তাঁর প্রথম নামটি খানিকটা বদলে রাখেন, এবং বাকিটা ফেলে দেন। তখনো তিনি শিক্ষার্থী, ম্যানচেস্টার পলিটেকনিকে গ্রাফিক ডিজাইন নিয়ে পড়ছেন- এমন সময় পাংক আন্দোলন লন্ডনে হানা দিল, এবং লিন্ডার তাঁর পথনির্দেশনা খুঁজে পেলেন।
গায়ক, সঙ্গীত রচয়িতা ও গিটারবাদক পিট শেলি এবং গায়ক ও সঙ্গীত রচয়িতা হাওয়ার্ড ডেভোটোর হাতে ইংল্যান্ডের বোল্টনে ১৯৭৬ সালে গ’ড়ে ওঠা পাংক রক ব্যান্ড Buzzcocks এর সঙ্গে লিন্ডার-এর সখ্য গড়ে উঠল, তাঁর জীবনে সঙ্গীতের দোলা বয়ে গেল, কিন্তু তিনি যে রঙ বা পেইন্ট ছেড়ে শল্যছুরিকা (scalpel) হাতে তুলে নিলেন সেটাই তাঁর শিল্পকে সবচাইতে বেশি প্রভাবিত করল।
এই নামবিহীন ফটোমন্তাজটি নামবিহীন বা Untitled শিরোনামের একটি সিরিযের প্রথম দিকের কাজ, যেখানে তিনি পুরুষ এবং নারীদের সাময়িক পত্রগুলোর ব্যবচ্ছেদ ক’রে প্রতিচ্ছবিগুলোকে আবার একসঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন। পর্নোগ্রাফিক ন্যুডদের মাথায় ইস্ত্রি বা ব্লেন্ডার বসিয়ে আর চার হাত-পায়ে হামাগুড়ি দেয়া উলঙ্গ নারীর চারপাশে আঠাল টার্ট আর প্যাস্টি রেখে তিনি তাদের ভিন্নভাবে সাজিয়েছেন, বা বলা যায়, তাদেরকে ভিন্ন রূপ দান করেছেন। নারী দেহের পণ্যায়নকে প্রশ্নবিদ্ধ ক’রে লিন্ডার নারী এবং গার্হস্থ্য বস্তুগুলোর যে একীকরণ বা সম্মিলন (ফিউশন) ঘটান তা দেখে আমরা বেশ অস্বস্তিতে প’ড়ে যেতে পারি।
একথা ঠিক যে তাঁর কাজগুলোর প্রেরণা এসেছিল হান্না হুশ-এর ডাডা মন্তাজ এবং রিচার্ড হ্যামিলটনের পপ কোলাজ থেকে, কিন্তু নিজস্ব যেসব চিন্তা ভাবনা তাঁকে আচ্ছন্ন ক’রে রাখত সেগুলোই এই কাজগুলোর চালিকাশক্তি। এই উদাহরণটিতে যেমনটি দেখা যাচ্ছে, সে-রকম ক’রে চোখগুলোকে প্রায়শই অন্ধ বা টেরা, এবং মাথাগুলোকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন ক’রে দেয়া হয়েছে। নারীরা আর কখনোই প্রেমময় দৃষ্টির বদলে প্রেমময় দৃষ্টিতে তাকায় না – পুড়ে যাওয়া সকেটের ভেতর তাদের চোখগুলো ঘুরতে থাকে, এবং অন্য দিকে তাকিয়ে থাকে। লিন্ডার ফটোমন্তাজগুলো বুঝি এটাই বোঝাতে চায় যে স্থিরদৃষ্টি (gaze) – চিত্রিত ও প্রয়োগকৃত উভয়ই – কখনোই নিরপেক্ষ নয়।
শিল্পকর্ম পরিচিতি:
Untitled ১৯৭৬
কাগজের ওপর বসানো ছাপা কাগজ
২৭.৯. X ১৯.৬ সে.মি.
(চলবে)
পর্ব-১: শিরীন নিশাত ও যারিনা হাশমি- দ্রোহ আর স্মৃতিকাতরতা
পর্ব-২: মহাজাগতিক সৃজনকারী শক্তি ও নারীর স্বরূপে ফেরা
পর্ব-৩: শিল্পের নতুন বিষয় ও শিল্পীর শরীর
পর্ব-৪: শ্রম বৈষম্য এবং সন্তান পালনের দলিল
পর্ব-৫: নারীর প্রতীকী ইতিহাস এবং শিল্পকর্ম হিসেবে দেহ
পর্ব-৬: দেহ ভাস্কর্য ও চিরন্তন মাতৃসত্তার বিরুদ্ধচিত্র
পর্ব-৭: গার্হস্থ্য জীবন আর অন-স্ক্রীন নারীত্বের স্বরূপ উন্মোচন
পর্ব-৮: দেহাস্ত্র এবং অনিরপেক্ষ প্রতিচ্ছবি