বংশের বাতি ছেলে সন্তান- মিথ্যের ফাঁদে জের টানে কে?
ডা. মৌমিতা শীল।। আমার বড় কাকার ৫ মেয়ে। কীভাবে তার বংশ রক্ষা পাবে সেই দুঃশ্চিতায় তার ঘুম হত কি না জানি না, কিন্তু প্রতিবেশিদের যে ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিল, সেটা নিশ্চিত করে জানি। গ্রামের বুড়োরা কাকাকে বলত- ‘‘তোর পূর্বপুরুষের মুখে জল দেবে কে রে? সব কটা তো মেয়ে!” মেয়ে সন্তান, তাও ৫টা। একটাও ছেলে নেই। এহেন অপরাধে অপরাধী আমার বড় কাকি, সংসারে নিজের লাঞ্চনা ঢাকতেই নাকি নিজের মাতৃত্বের প্রতিদিনের অপমান উপশম করতেই কিনা, মেয়েগুলোকে ঠিক করে আদর যত্ন করতেন না। অন্তত প্রকাশ্যে কখনোই না। বেশি আদর দেখালে, পাতে ভালো মাছটুকু দিলে তাকে শুনতে হত- ‘‘পাঁচ বিটির মায়ের আবার শখ কত, মাছের মুড়োখানা মেয়ের পাতে দিলে”। অতএব মেয়েগুলো কেমন যত্নে বড় হতে থাকলো তা ব্যাখ্যা না করলেও বিলক্ষণ বোঝা যাচ্ছে।৬ষ্ঠ বারের মত তিনি মা হলেন, এবার মা ষষ্ঠীর কৃপায় ছেলে হয়েছে। সকলে বল্ল- ‘‘যাক, শেষ পর্যন্ত বংশটা বাঁচলো”।
ছেলে এবার পাড়াপড়শি, আত্মীয়-স্বজন এমনকি মা বাপেরও সকল আদর মনোযোগের একান্ত ভাগীদার হলো। মেয়েগুলো ঠিক করে খেলো কিনা সে খেয়াল নিতে দেখিনি কাকিকে। কিন্তু ছেলের পাতে সন্দেশ, মাছের মাথা, পাকা আম বড়টা পড়ল কিনা সে খোঁজ সারাজীবন ঠিকমতই নিয়েছেন ও এখনো নিয়ে যাচ্ছেন।
আমাদের কৃষি জমি তখন যথেষ্টই ছিল। ক্ষেতে বীজ বোনা, নিড়ানি দেয়া, সেচের সময় জল তোলা, ধান মাড়ানো, ঢেকির কাজ সবক্ষেত্রেই মেয়েগুলির সাহায্য অনিবার্য ছিলো। (পেশিশক্তি,পরিশ্রমের কাজ- এইসব নিয়ে যারা বুলি কপচান, তারা জেনে রাখুন, এই কাজগুলো অত্যাধিক পরিশ্রমের, সারাদিন শুয়েবসে শুধু ফেসবুক গুতালে তা জানা যাবে না! পেশির শক্তি নিয়ে আরেকদিন আলোচনা হবে।)
এই হলো উপমহাদেশের অধিকাংশ ঘরের প্রতিচ্ছবি। এখন যুগ কিছুটা বদলেছে। তাই আগের মত মেয়ে শিশুর প্রতি ঘেন্না এত খুলে প্রকাশ হয় না অনেক পরিবারে। এমনকি একটা বড় অংশ মেয়ে শিশুকেও ছেলে শিশুর মত সমান যত্ন ও পড়ালেখার সুযোগ দিয়ে বড় করে। কিন্তু গুরুত্ব কি সমান দেয়া হয়?
না। সেক্ষেত্রে ছেলে সন্তান এগিয়ে। কারন-‘ছেলে বংশের বাতি’।একজন সন্তান জিনগতভাবে কাকে প্রতিনিধিত্ব করে? মা ও বাবা উভয়কেই। (আমি জিনতত্ত্ব আলোচনা করবো, যতটা পারা যায় সহজ ভাষায়। কারো কঠিন ভাষায়, জটিলভাবে বুঝতে ইচ্ছা করলে Langman’s Embryology,Medical Genetics-by Edward S Tobis and Michel Connor থেকে পড়ে নিতে পারেন। এ ছাড়াও আরও অনেক বই আছে, বাহুল্যবোধে উল্লেখ করছি না। এগুলো কোনো পোর্টাল বা ওয়েবপেজ থেকে আমি পড়িনি। আমার পড়ার বিষয় মেডিক্যাল সায়েন্স, সেখানেই এগুলো বিশদভাবে পড়ানো হয়েছে, সব ডাক্তারই পড়েছেন। তাই ‘কোন পোর্টাল, কোন পেজ’-এসব জিজ্ঞেস করবেন না। তবে এসব টপিকস, মেডিক্যালসায়েন্স রিলেটেড পোর্টালে, নিদেন নেট ঘাটলেও পাওয়া যাবে। সাধারণত ফেবুতে এরকম আলোচনার নীচে কিছু ‘প্রাজ্ঞ’ অথচ ‘সহজ-সরল’ ব্যাক্তির বিনোদন উদ্দীপক বিভিন্ন কমেন্ট পাওয়া যায় তো, তাই এই বাড়তি লেখাটুকু)।
প্রত্যেক প্রাণি নিজের বংশগতি বাঁচিয়ে রাখতে চায়, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে পৌঁছে দিতে চায়। এই প্রক্রিয়ায় সাহায্য করে ক্রোমোজম নামক কোষীয় বস্তু। মানুষের ক্রোমোজম আছে কোষের নিউক্লিয়াস নামক অঙ্গাণুতে।
এখন মানুষের ক্ষেত্রে কোষ (ক্রোমোজমের সংখ্যার ভিত্তিতে) দুই প্রকার-
১. হ্যাপ্লয়েড
২. ডিপ্লয়েড
(আমি বিস্তারিত ব্যাখ্যায় যাচ্ছি না।শুধু জানিয়ে রাখছি – হ্যাপ্লয়েড এ অর্ধেক জিনগত বস্তু/ক্রোমোজোম আছে। ডিপ্লয়েডে আছে তার দ্বিগুন)
– শরীরের কোষ বা দেহকোষ ডিপ্লয়েড- মানে ৪৬ টা বা ২৩ জোড়া ক্রোমোজম বহন করে
– ডিম্বানু ও শুক্রানু/জননকোষ হ্যাপ্লয়েড- মানে ২৩ টা ক্রোমোজোম বহন করে
এই পর্যন্ত বুঝতে পারলাম ডিম্বানু ও শুক্রানুতে ক্রোমোজোম সংখ্যা সমান।
একটি ডিম্বানু ও একটি শুক্রানুর মিলনে যখন জাইগোট বা ভ্রুন তৈরি হয় তখন এর ক্রোমোজোম সংখ্যা দাঁড়ায় ২৩ জোড়া বা ৪৬টি তে। মানে মা ২৩টি ও বাবা ২৩টি, মোট ৪৬টি ক্রোমোজোম দিচ্ছেন। একেবারে সমানে সমান ক্রোমোজম দাতা দুজনেই। দুজনের সমান সমান পরিমান বংশগতি বহন করছে সন্তান। এই কথা ছেলে ও মেয়ে উভয় সন্তানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। মানে ছেলেও বাবার থেকে ২৩টা ও মায়ের থেকে ২৩টা ক্রোমোজম পাচ্ছে। মেয়েও তেমনি বাবার ও মায়ের থেকে সমান ২৩টা করে করেই ক্রোমোজম পাচ্ছে।
মেয়ে ও ছেলে-উভয়েই তাদের মা ও বাবার সমান সংখ্যক জিন, প্রজন্মান্তরে বহন করে চলেছে, ১টি কমও নয়, ১টি বেশিও নয়। তাহলে বংশগতি কেবলমাত্র ছেলে সন্তানের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়- এমন অতি ভ্রান্ত ধারনার সৃষ্টি হলো কি করে? কতটা হাস্যকর, বেসলেস কথা! একেবারে কাঁঠালের আমসত্ত্ব।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজ শুধু পুরুষকেই ক্ষমতাবান দেখতে চায়, তাই তারা বংশের বাতি হিসেবে অভিহিত করছে ছেলে সন্তানকে। আর তার জের শুধু মেয়েরা টানছে না, ছেলেরাও টানছে। একটা পুরুষতান্ত্রিক পরিবারে সবকিছু একচোখা ও পক্ষপাতদুষ্ট। এরা শুধু ছেলের জন্ম আশা করে, শুধু ছেলেকেই আদর-যত্ন করে, ভালো ও বেশি খাবারটা ছেলে বাচ্চাকেই দেয়, শিক্ষার ও সামাজিক সকল সুবিধার পুরোটা ছেলের ইত্যাদি ইত্যাদি। এতসব সুবিধায় ছেলেকে সিক্ত করে তারা কোন্ আশায়?
বুড়ো বয়সে ছেলে আয় করে খাওয়াবে, সকল দায়িত্ব নেবে, বাবার পদবী বহন করবে আর বিয়ে করে বৌ নামক আরেক ফ্রি কাজের লোক এনে ২৪ ঘন্টা সেবা-যত্নের ব্যবস্থা করাবে, সেই আশায়! (যারা নিজের সন্তানকে ভবিষ্যৎ প্রয়োজন মেটানোর জীবন্ত সামগ্রী ভেবে বড় করতে পারে, তারা অন্য বাড়ির সন্তান, বিশেষত অন্য বাড়ি থেকে বিয়ে হয়ে আসা মেয়ে সন্তানকে এর চেয়ে ভালো নজরে দেখবে না এটাই স্বাভাবিক আর এটাই সাধারণত হয়ে থাকে)।
একটা ছেলে অতিরিক্ত চাপ নিতে বাধ্য হয়। ক্যারিয়ার, চাকরি, সংসারের দায়িত্ব, মা-বাবার দায়িত্ব, আবার বিয়ে করলে স্ত্রীর দায়িত্ব, সেই সাথে সন্তানের দায়িত্ব! এতসবের মাঝে সে নিজেকে সময় কখন দেবে? অতিরিক্ত ও একক দায়িত্বের চাপে ব্যক্তিগত জীবনও বিপর্যস্ত হয়,
যার ফলে সম্পর্কের ভারসাম্য নস্ট হয়। প্রতি ঘরেই তা দেখতে পাই আমরা। (আগের দিনে কী হতো, সে বচন আওরাবেন না। তারা এই গোষ্ঠীবদ্ধ,অসাম্যেপূর্ণ কলুর বলদের জীবনকেই সুখি জীবন বলে মনে করতেন। আমি তাদের দোষ-গুন কোনোটাই গাইছি না। আর গুহার যুগে তো বাস করি না আমরা এখন। ২০২০ সাল এটা। সবকিছুতে আপ-টু-ডেট থাকবো আর এই ক্ষেত্রেই শুধু পুরোনো চাল ভাতে বাড়াবো, কেমন দ্বিচারিতা!)
কেন ছেলে একাই এত চাপ, এত দায়িত্ব নিতে বাধ্য হবে? আর মেয়ে সন্তানই বা কেন মানুষ হিসেবে, তার প্রাপ্য অধিকারগুলো থেকে আর
সন্তান হিসেবে তার প্রাপ্য স্নেহ ও গুরুত্ব থেকে কতকাংশে বা সম্পূর্ণভাবে বঞ্চিত হবে? যেখানে ছেলে মেয়ে উভয়ে মা বাবার সমান ক্রোমোজম বহন করে, বংশগতি সেখানে সমানভাবেই বণ্টিত হচ্ছে, পিতা ও মাতা, উভয়ের এবং উভয় বংশেরই। উভয় সন্তান যেমন মানুষ হিসেবে ও সন্তান হিসেবে সমান মনোযোগ, গুরুত্ব ও যত্ন পাওয়ার পূর্ণ অধিকারী, তেমনি পারিবারিক সকল দায়িত্বের সুষম বন্টনও তাদের উভয়ের ওপর বর্তানো উচিত। মা বাবার যত্ন শুধু ছেলে-ছেলের বৌ কেন করবে, মেয়ে-মেয়ের জামাইও করতে বাধ্য। মা বাবা তো একলা ছেলের নয়, মেয়েরও।
বাবা-মায়ের ভালোবাসা,সন্তানের জন্য অমূল্য। প্রথার নামে এ কোন্ বর্বরতা, যা সন্তানের প্রতি মা বাবার স্নেহ-ভালোবাসা ও গুরুত্বকে পর্যন্ত একপাক্ষিক করে তোলে?
আমি অনেক বিজ্ঞ ও লেখাপড়া জানা মানুষ ও বড় বড় ডাক্তার স্যার, ম্যাডামকে দেখেছি- ছেলের আশায় ২টা মেয়ে, এমনকি ৩টা মেয়ে থাকা সত্ত্বেও বেশি বয়সে বাচ্চা নিচ্ছেন, শুধু ছেলে বাচ্চার আশায়! এদের ঘরে মেয়েবাচ্চারা আদর, যত্ন, পড়ার সুযোগ সব সবকিছু পায়, কিন্তু গুরুত্বটা পায় না, সেটি ছেলের জন্য তোলা থাকে। যারা পড়েন নি, তারা নাহয় জানেন না, কিন্তু এঁরা জেনেশুনে কি করে একই কাজ করেন? ওই যে সোশ্যাল স্টিগমা, ওই ফাঁদে পরেছেন আর কি! কোথায় এই ফাঁদটা ভাঙ্গবেন তা না, ফাঁদের আয়তন আরো বাড়িয়ে চলেছেন! আশ্চর্য! কোনো সুস্থবোধ ও ব্যাক্তিত্বসম্পন্ন মানুষের পক্ষে এরকম স্বার্থসসংশ্লিষ্ট আদর-যত্ন আর গুরুত্ব প্রদান করা বা গ্রহণ করা কিংবা এ ধরনের অসুস্থ ব্যবস্থাকে প্রশ্রয় দেয়া- কোনোটাই সম্ভব না বলে মনে করি। সন্তান তো সন্তানই- মা বাবার নয়নের মনি আর মা বাবা পৃথিবীতে সন্তানের পরম নির্ভরতার স্থল, পরম প্রাপ্তি।