May 19, 2024
কলামফিচার ২

সরকারও কি মনে করে নারীরা ‘ফিজিক্যালি ডিসকোয়ালিফায়েড’ থাকে?

শওগাত আলী সাগর।।

গত দু’দিন ধরে আমার কেবল এমিলি মারফির কথা মনে পড়ছে। বিচারকের আসনে বসে আছেন এমিলি মারফি। আদালতের অন্যান্য কর্মকর্তরাও সবাই আছেন। কিন্তু কার্যক্রম শুরু হচ্ছে না। শুনানীর জন্য কেউই দাঁড়াচ্ছে না। এজলাসের দিকে তাকান এমিলি। বুঝতে পারেন, আইনজীবীদের কেউই অনুপস্থিত নন। তা হলে কেউ শুনানী শুরু করছে না কেন?

“এখন তো একটি মামলার শুনানী শুরু হবার কথা, আইনজীবী কোথায়? বক্তব্য উপস্থাপন করেন”- আদেশ দেন বিচারক এমিলি মারফি।

কেউ তার নির্দেশে কিংবা ডাকে সাড়া দেয় না। সবাই যেন নির্বিকার। তিনি আবার তার কথাগুলো উচ্চারণ করেন, “আইনজীবী কোথায়, বক্তব্য শুরু করেন।”
– কোথায় বক্তব্য শুরু করবো। আমার তো বক্তব্য দেয়ার কথা আদালতের সামনে। কিন্তু আদালতই তো নেই।
কেউ একজন দাঁড়িয়ে এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলেন। বলেই নিজের পরিচয় দেন- আমি বাদি পক্ষের আইনজীবী। বক্তব্য দেয়ার জন্য তৈরি হয়ে আছি। কিন্তু আদালতই তো নেই।
– আমিই আদালত। আমি বিচারক। বক্তব্য শুরু করেন।
– আইন অনুসারে তো আদালত গঠিত হবে ‘পার্সন’কে নিয়ে। আপনি তো একজন নারী। আইনে, সংবিধানে তো একজন নারীকে ‘পার্সন’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। কাজেই আপনি আদালত হতে পারেন না।

ঘটনাটা একশত বছরেরও আগের। বিচারক হিসেবে নিয়োগ পাবার পর আদালতের প্রথম দিনে এমিলি মারফির অভিজ্ঞতা এটি। কানাডার প্রথম মহিলা বিচারক হিসেবে নিয়োগ পেয়ে প্রথম দিন আদালতে গিয়েই এই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন তিনি। ‘ব্রিটিশ নর্থ আমেরিকা অ্যাক্ট’ এর আওতায় কানাডার সংবিধানে নারীকে তখনো ‘পার্সন’ হিসেবে স্বীকারই করা হয়নি।

বাংলাদেশের অবস্থাটা একশত বছর আগের কানাডার মতো মোটেও নয়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, সংসদের বিরোধীদলীয় নেত্রী, জাতীয় সংসদের স্পিকারের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে নারীরা দায়িত্ব পালন করছেন। সাংবাদিকদের সংগঠন জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি হিসেবেও একজন নারী সম্প্রতি দায়িত্ব নিয়েছেন। নিম্ন থেকে উচ্চ- সব আদালতেই বিচারক হিসেবে নারীরা দাপটের সঙ্গেই দায়িত্ব পালন করছেন। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সব পদে নারী কাজ করতে পারলেও মুসলমানদের বিয়ে নথিভূক্ত করার ‘কেরানীগিরি’ নারী করতে পারবে না- এমন সিদ্ধান্ত দিয়েছে দেশের আদালত। মিডিয়ায় হাইকোর্টের রায়ের এই খবরটি পড়তে পড়তে একশত বছর আগের কানাডার আলবার্টার কোর্টে এমিলি মারফির অভিজ্ঞতাগুলো কেবল মনে হতে থাকে। যদিও আমরা এখন আর একশত বছর আগের অলবার্টায় নেই, আমরা ২০২১ সালের বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে। কিন্তু হাইকোর্টের রায়, রায়ের পর্যবেক্ষণে দেয়া বক্তব্যের ভাষা বার বার আমাকে একশত বছরের বেশি আগের এমিলি মারফির সময়ে নিয়ে যেতে থাকে।

ঘটনাটা দিনাজপুরের ফুলবাড়িয়ার আয়েশার সিদ্দিকার। নিকাহ রেজিস্ট্রার পদে চাকুরি পেতে আবেদন করেছিলেন তিনি। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে চাকুরিও পেয়েছিলেন। স্থানীয় পর্যায় থেকে তাকে নিয়োগের সুপারিশ করে অনুমোদনের জন্য আইন মন্ত্রনালয়ে পাঠানো হয়েছিলো। সেখানে এসেই সবকিছু উল্টে যায়। ‘একজন নারী নিকাহ রেজিস্ট্রার হিসেবে নিয়োগ পেতে পারেন না’- মর্মে সিদ্ধান্ত দেয়া হয় আইন মন্ত্রনালয় থেকে। ‘দিনে রাতে যেকোনো সময় বিবাহ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে হয়’ উল্লেখ করে নারীর নিরাপত্তার অজুহাত তুলে আইন মন্ত্রনালয় আয়েশার নিয়োগটি বাতিল করে দেয়। আইনমন্ত্রনালয়ের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আদালতে যান আয়েশা। টানা চার বছর আইনি লড়াইয়ের পর তিনি হেরে যান। তিনি হেরে গেলেও আদালতের রায় এবং পর্যবেক্ষণে বাংলাদেশের প্রশাসনের উপরতলার দৃষ্টিভঙ্গি এবং মানসিকতার একটি দিক উন্মোচিত হয়ে যায়।

আয়েশা সিদ্দিকার এই মামলাটিতে নারীর প্রতি আইন মন্ত্রনালয়ের দৃষ্টিভঙ্গিকেই গ্রহণ করেছেন হাইকোর্ট। সেই দৃষ্টিভঙ্গি বহাল রাখতে গিয়ে আদালত তার নিজের পর্যবেক্ষণ যুক্ত করেছেন। আদালতের পর্যবেক্ষণ এবং পর্যবেক্ষণে ব্যবহৃত ভাষা নিয়ে ইতিমধ্যে সুধীমহল প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন। উচ্চ আদালতের একজন বিচারক মনে করছেন, ‘নারীরা মাসের একটি নির্দিষ্ট সময় ফিজিক্যাল ডিসকোয়ালিফিকেশনে থাকেন’ এবং তার এই মনে করা একই আদালতে থাকা নারী বিচারপতিও মেনে নিচ্ছেন।’

মাসের এই নির্দিষ্ট সময়ে’ মেয়েরা এখন রাস্ট্র চালায়, ট্রেন চালায়, বিমান চালায়, সবকিছুই করে, তাহলে তারা ‘ফিজিক্যাল ডিসকোয়ালিফিকেশনে থাকেন’ কীভাবে? বিচারপতি মহোদয় কি এই ধরনের পর্যবেক্ষণের সাপোর্ট হিসেবে কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মতামত নিয়েছেন? কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সার্টিফিকেট ছাড়া আদালত কি কাউকে ‘ফিজিক্যাললি ডিসকোয়ালিফাইয়েড’ হিসেবে ঘোষণা করতে পারেন?

এই সব প্রশ্নের বাইরে আমি ঘটনাটিকে অন্যভাবে দেখতে চাই। যে সব কারণ দেখিয়ে আয়েশার বিবাহ রেজিস্ট্রার পদে চাকুরি পাওয়ার পথ রুদ্ধ করা হয়েছে- এই কারণগুলো অবৈজ্ঞানিক এবং পশ্চাদপদ চিন্তা থেকে উৎসারিত। আইন মন্ত্রনালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা তাদের পশ্চাৎপদ মানসিকতা থেকে আয়েশার নিয়োগটি বাতিল করেছিলেন। আয়েশা যখন আইনের আশ্রয় নিলেন তখন পশ্চাৎচিন্তার সেই আদেশটির পক্ষে পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র সক্রিয় হয়ে উঠলো। আমার ভাবনা- এটি কী করে সম্ভব হলো?

নারী- কেবল এই কারণে কোনো নারীকে কোনো চাকুরিতে অযোগ্য ঘোষণা করার অধিকার রাষ্ট্রকে সংবিধান দেয়নি। সরকারের যে নারী নীতি আছে সেখানেও এই ধরনের বিধান নেই। নিকাহ রেজিস্ট্রার নিয়োগের শর্তেও বলা নেই যে এই পদটি কেবলমাত্র পুরুষের জন্য নির্ধারিত পদ। তা হলে আইন মন্ত্রনালয় কীসের ভিত্তিতে আয়েশার নিয়োগকে বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিলো? আয়েশা যখন তার অধিকার রক্ষায় আইনের কাছে প্রতিকার চাইলো তখন রাষ্ট্রের অর্থ এবং সময় ব্যয় করে, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন অফিসকে ব্যবহার করে পশ্চাৎপদ চিন্তার একটি সিদ্ধান্তকে বহাল রাখার লড়াইয়ে আইন মন্ত্রনালয় এতোটা সক্রিয় হয়ে উঠলো কেন!

আয়েশা সিদ্দিকার বিরুদ্ধে আদালতে লড়ার সিদ্ধান্তটি কোন পর্যায় থেকে হয়েছিলো? সেই সিদ্ধান্ত সম্পর্কে কি আইনমন্ত্রী জানতেন? আইন সচিব জানতেন? তারা কি এটির অনুমোদন দিয়েছিলেন? তাদের অনুমোদন ছাড়াই কি এটি আদালতে গেছে। এমন একটি মামলার ব্যাপারে এটর্নি জেনারেল অফিস থেকে কি ভিন্ন কোনো পরামর্শ আইন মন্ত্রনালয়কে দেয়া হয়েছিলো?

সরকারের আইনমন্ত্রীর জ্ঞাতসারে রাষ্ট্র এই মামলা পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকলে সরকারের আদর্শিক অবস্থান নিয়ে আলোচনা তুলতে হয়। প্রশ্ন করতে হয়, সরকারও কি তাহলে মনে করে নারীরা ‘মাসের একটি নির্দিষ্ট সময়ে ফিজিক্যাল ডিসকোয়ালিফায়েড থাকে’?

দিনাজপুরের ফুলবাড়ীয়া তথা মফস্বলের কর্মকর্তারা যে আলোকিত মনের পরিচয় দিতে পেরেছিলেন আয়েশাকে নিয়োগের সুপারিশ করে, রাষ্ট্রের উঁচু মহলে, আইন মন্ত্রনালয়ে, আদালতের চৌহদ্দিতে জমে থাকা একশত বছরের আগের গভীর অন্ধকারকে সেই আলো দূর করতে পারলো না কেন?

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]