পর্ব-১১: ব্যক্তিগত ক্ষমতায়ন এবং কৃষ্ণাঙ্গ নারী সমকামীর অভিজ্ঞতা
শিল্প সমালোচক, লেখক শার্লট মালিন্সের A Little Feminist History of Art বইটি বাংলায় অনুবাদ করছেন বিশিষ্ট অনুবাদক, শিক্ষক জি এইচ হাবীব। বইটির অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হচ্ছে ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে। আজ পড়ুন এর একাদশ পর্ব। সব পাঠকের সুবিধার জন্য প্রতি পর্বের শুরুতে বইটির এবং লেখক শার্লট মালিন্সের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দেয়া থাকবে।।
[নারীবাদী শিল্প আন্দোলনের শুরু ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে। পুরুষ প্রাধান্যবিশিষ্ট রঙ্গমঞ্চে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়ার জন্যে সে সময় নারী শিল্পীরা তাঁদের কাজগুলোর জেন্ডারচ্যুতি ঘটাবার সংগ্রামে নামেন। এরপর থেকে সেই আন্দোলন শিল্প জগতে গোটা বিশ্বজুড়ে অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন ক’রে আসছে। ‘নন্দনতাত্ত্বিক ফরমালিযম’ ব’লে অভিহিত যুগের পর সামাজিকভাবে প্রাসঙ্গিক নানান ইস্যুতে কথা বলার জন্য ‘নারীদৃষ্টি’-র সাহায্যে নারী শিল্পীরা বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ ক’রে জেন্ডার, পরিচয় এবং ফর্মের দিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন, সমালোচনা করেছেন সাংস্কৃতিক প্রত্যাশাগুলোকে এবং নারীকে সনাতনী দৈনন্দিন ধারণায় আটকে ফেলার ব্যাপারটিকে। সমাজের দৃষ্টি ঘোরাতে চেয়েছেন সাম্যের জন্যে নারীর সংগ্রাম এবং নারীদেহকে পণ্য হিসেবে দেখবার মানসিকতা ও ক্রিয়াকর্মের দিকে। “অল্প কথায় নারীবাদী শিল্প-ইতিহাস” (A Little Feminist History of Art) নামের ছোট্ট বইটিকে এই আন্দোলনের ফসল হিসেবে জাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু শিল্পকর্মের সংক্ষিপ্ত কিন্তু সারগর্ভ ভূমিকা বলা যেতে পারে। ১৯৬০-এর দশক থেকে বর্তমান কাল অব্দি পঞ্চাশটি অসামান্য কাজ নারীর জীবন ও অভিজ্ঞতাকে তুলে ধরেছে। সেই সঙ্গে, ভিয্যুয়াল সংস্কৃতির ওপর নারীবাদী আদর্শ ও রাজনীতি যে প্রভাব ফেলেছে সেটাও এই কাজগুলো মেলে ধরেছে। “অল্প কথায় নারীবাদী শিল্প-ইতিহাস” নামের এই গ্রন্থটি জেন্ডার বৈষম্য, যৌনতা, গার্হস্থ্য জীবন, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর নারী দেহের মতো বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা বিংশ শতকের সবচাইতে উচ্চাকাঙ্ক্ষী, প্রভাবশালী ও টেকসই শৈল্পিক আন্দোলনগুলোর একটির আনন্দ উদযাপন।
শার্লট মালিন্স একজন শিল্প সমালোচক, লেখক এবং সম্প্রচারক। তিনি রেচল হোয়াইরিড, সেসিলি ব্রাউন, র্যাচেল লামসডেন, জেনি স্যাভিল, ক্যাথে ডে মনসাউক্স, স্যু অ্যারোস্মিদ, সুজ্যান কুন, স্যুযি হ্যামিলটন এবং পলা রেগোসহ বিভিন্ন নারী শিল্পীকে নিয়ে লেখালেখি করেছেন। তাঁর রচিত ও প্রকাশিত বিভিন্ন গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে “লাইভ্স অভ দ্য গ্রেট আর্টিস্টস” (২০০৮) এবং “র্যাচেল হোয়াইহেড” (২০০৭)। তিনি বিবিসি রেডিও ফোর-এর “ফ্রন্ট রো” এবং “স্যাটারডে রিভিউ’’-র নিয়মিত প্রদায়ক]
বিলি জাঙ্গেওয়া (Bille Zangewa)
(জন্ম ১৯৭৩)
বতসোয়ানায় বেড়ে-ওঠা বিলি জাঙ্গেওয়া কাপড় দিয়ে শিল্পসৃষ্টি করতে শুরু করেন। শিল্পকর্ম চর্চার উপযুক্ত হাতিয়ার বা উপকরণের অভাবে তিনি হাতের কাছে যা পেয়েছিলে তা-ই ব্যবহার করতে শুরু করেন। বর্তমানে তাঁর ঠাঁই জোহাসেনবার্গ আর লন্ডন; এখনো তিনি তাঁর সিল্ক কোলাজগুলো হাতে সেলাই করে থাকেন। এবং তাঁর শিল্পকর্মে তিনি কৃষ্ণাঙ্গ নারী হিসেবে তাঁর অভিজ্ঞতা ফুটিয়ে তোলেন।
The Rebirth and Black Venus-এ দর্শক এক অতিকায় নগ্ন জাঙ্গেওয়া-কে দেখতে পান যিনি কমলা-রঙা আকাশের বিপরীতে আকাশচুম্বী অফিস ভবনগুলোর ভেতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। তাঁর গায়ে একটা ব্যানার পেঁচানো, আর তাতে লেখা: ‘নিজের জটিলতার কাছে নিজেকে সর্বান্তকরণে সমর্পণ করো।’ জাঙ্গেওয়া ফিমেল ন্যুডকে শিল্প ইতিহাস থেকে পুনরুদ্ধার ক’রে এক সক্রিয় কৃষ্ণাঙ্গ নারী হিসেবে নতুন একটি অবস্থানে নিজেকে উপস্থিত করেছেন যে-নারী বতিচেল্লির সাগরসৈকতের ফেনাকে জোহানেসবার্গের পিতৃতান্ত্রিক টাওয়ারে বদলে দিয়েছেন।
জাঙ্গেওয়া মনে করেন নারী তাঁর দৈনন্দিন জীবনে জাতি, শ্রেণি এবং জেন্ডারের ভিত্তিতে দমন-পীড়নের শিকার হয়। তাঁর ভাষায়: “সমাজে নারী মাতৃত্বসহ যে ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকা পালন করে এবং ব্যক্তিগত ও সামষ্টিকভাবে সেসব ভূমিকা যেসব প্রভাব ফেলে আমি সেগুলোও খুঁজে দেখছি।” গোড়ার দিকে তাঁর কাজগুলো এই অভিযোগের ভিত্তিতে সমালোচিত হয়েছিল যে সেগুলো অতিমাত্রায় নারীসুলভ এবং আলঙ্কারিক। কিন্তু তিনি সেটাই ধ’রে রাখেন, এবং এখন তিনি সাফল্যের মুখ দেখছেন। তিনি বলেন, “আমি দেখলাম আমার নিজের গল্পের দায়-দায়িত্ব নিয়ে নিজের কণ্ঠস্বর ব্যবহার ক’রে আমার একান্ত নিজের জীবনের গল্প বলা ছিল একধরনের ব্যক্তিগত ক্ষমতায়ন।”
শিল্পকর্ম পরিচিতি:
The Rebirth of the Black Venus ২০১০
সিল্ক টেপেস্ট্রি
১২৭ X ১০৩
শিল্প পরিচিতি:
The Birth of Venus, ১৪৮৪-১৪৮৬- সান্দ্রো বতিচেল্লি
যানেলে মুহোলি (Zanele Muholi)
(জন্ম ১৯৭২)
দক্ষিণ আফ্রিকায় জন্ম নেয়া শিল্পী এবং এক্টিভিস্ট যানেলে মুহোলি তাঁর আলোকচিত্রে কৃষ্ণাঙ্গ নারী সমকামী ও আফ্রিকী এলজিবিটিআই (লেসবিয়ান, গে, বাইসেক্সুয়াল, ট্রান্সজেন্ডার এবং ইন্টারসেক্স) গোষ্ঠীর জীবন এবং অভিজ্ঞতাকে ধ’রে রাখার মাধ্যমে তাঁদের অধিকার আদায়ের জন্য প্রচার, প্রচারণা এবং লড়াই-সংগ্রাম করছেন। মুহোলি বলেন, “আমি দেখেছি লোকজন আমাদের হয়ে নারী সমকামীদের নিয়ে কথা বলছে, তাঁদের ছবি তুলছে, যেন আমরা এ-কাজে সক্ষম নই, যেন আমরা মূক। আমি এটা গে প্রাইড ইভেন্টে দেখেছি, অ্যাকাডেমিক কনফারেন্সে দেখেছি, তথাকথিত নারী আন্দোলন ফোরামেও দেখেছি… আমি অন্যের জন্য বিষয়বস্তু হতে, আমার মুখ বন্ধ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছি।”
Only Half the Picture ২০০৩-৬ সিরিযটি দক্ষিণ আফ্রিকার এলজিবিটিআই গোষ্ঠীকে আবিষ্কার করার, তাঁদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা কামনা-বাসনা প্রত্যাশা-বঞ্চনা, ইতিহাসকে খতিয়ে দেখার একটি ঐকান্তিক ও অন্তরঙ্গ প্রয়াস। সেখানে আমরা পাই বেঁধে-রাখা, বিশেষ উদ্দেশ্যসাধনে ব্যবহার করা দেহ, প্রশ্রয়-পাওয়া ব্যক্তিগত আনন্দ, উন্মোচিত হয়ে পড়া ক্ষত। In-security ২০০৩ তে কার্গো প্যান্ট আর বুটজুতো পরা একজন নারী দাঁড়িয়ে- তাঁর রুক্ষ পোশাকের সঙ্গে আত্মরক্ষামূলকভাবে আড়াআড়ি ক’রে রাখা তাঁর হাত দুটো ঠিক খাপ খাচ্ছে না। আমরা তাঁর মুখ দেখতে পাই না, দেখি কেবল তাঁর সামরিক কেতার ট্রাউজার আর তাঁর দুই পায়ের সন্ধিস্থলে ছায়ান্ধকার V-টি।
Somnyama Ngonyama (কালো সিংহীর জয়) ২০১৪ শিরোনামের উল্লেখযোগ্য সিরিযটিতে (এই বইয়ের ভূমিকার ১৬ নম্বর পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য) এক বছর ধ’রে ৩৬৫টি বিমুগ্ধকর আত্ম-প্রতিকৃতিমূলক ফটো তুলে মুহোলি কৃষ্ণাঙ্গ নারী সমকামী হিসেবে তাঁরা যে পূর্বসংস্কারের মুখোমুখি হন তাঁর প্রতি তাঁর নিজের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।
শিল্পকর্ম পরিচিতি:
In-security ২০০৩, Only Half the Picture ২০০৩-৬ সিরিয থেকে
আলোকচিত্র; কাগজে জেলাটিন সিলভার প্রিন্ট নেয়া
৪৮ X ৩৩ সে. মি.
(চলবে)
পর্ব-১: শিরীন নিশাত ও যারিনা হাশমি- দ্রোহ আর স্মৃতিকাতরতা
পর্ব-২: মহাজাগতিক সৃজনকারী শক্তি ও নারীর স্বরূপে ফেরা
পর্ব-৩: শিল্পের নতুন বিষয় ও শিল্পীর শরীর
পর্ব-৪: শ্রম বৈষম্য এবং সন্তান পালনের দলিল
পর্ব-৫: নারীর প্রতীকী ইতিহাস এবং শিল্পকর্ম হিসেবে দেহ
পর্ব-৬: দেহ ভাস্কর্য ও চিরন্তন মাতৃসত্তার বিরুদ্ধচিত্র
পর্ব-৭: গার্হস্থ্য জীবন আর অন-স্ক্রীন নারীত্বের স্বরূপ উন্মোচন
পর্ব-৮: দেহাস্ত্র এবং অনিরপেক্ষ প্রতিচ্ছবি
পর্ব-৯: বোধ স্বতন্ত্র এবং ফিউশন অস্বস্তিকর
পর্ব-১০ নির্যাতন নিরন্তর ও পিতৃতান্ত্রিক বিশ্বে নারী হওয়ার জটিলতা