হিজাব ও ইসলাম
পাকিস্তানের বেলুচিস্তান হাইকোর্টের সাবেক বিচারপতি কাজী ফাইয়েজ ঈসা’র The Veil & Islam লেখা প্রবন্ধটি ২০০৩ সালের ১৯ মে পাকিস্তানের ডন পত্রিকায় প্রথম প্রকাশ হয়। পরে এটি অনেকেই প্রকাশ করেন। ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরের পাঠকদের জন্য কাজী ফাইয়েজ ঈসা’র এই লেখাটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন আতিকুল ইসলাম ইমন।
পাকিস্তানের এক প্রাদেশিক অ্যাসেম্বলির সদস্য ১২ বছর বয়স হলেই মেয়েদের ঘোমটা দেওয়া বাধ্যতামূলক করতে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন। প্রস্তাবটির পক্ষে বলতে গিয়ে পবিত্র কোরআনের কোনো আয়াতের উল্লেখ না করেই মুত্তাহিদা মজলিস-আমাল-এর পীর মুহাম্মদ খান ধরে নিয়েছেন যে, ইসলামে নারীদের জন্য ঘোমটা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
যদি ঈশ্বর নারীদের মুখমণ্ডল ঢেকে রাখার আদেশ দেন তবে মুসলিমদের অবশ্যই তা মানতে হবে। তবে যদি আমাদের ঈশ্বর, দয়াশীল স্রষ্টা, এমন কোনো আদেশ-নিষেধ না করেন তবে কোনো মানুষ তা চাপিয়ে দিতে পারে না। স্রষ্টার আদেশ-নিষেধের সঙ্গে কোনো নতুন কিছু জুড়ে দেওয়া ইসলামে সম্পূর্ণভাবে অগ্রহণযোগ্য। যে কেউ যতো ভালো উদ্দেশ্য নিয়েই এমনটা করুক না কেন, তা ঈশ্বরের আইনকে প্রতিস্থাপন করতে পারে না। সত্য থেকে বিচ্যুত হওয়া ইসলামে বৈধ নয়।
‘অতএব, আপনি আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তা অনুযায়ী ফয়সালা করুন এবং আপনার কাছে যে সত্য এসেছে, তা ত্যাগ করে তাদের নিরর্থক প্রবৃত্তির অনুসরণ করবেন না’ (সুরা মায়েদা ৫:৪৮)। এবং কোরআনের সুরা বাইয়্যেনাহ যার অর্থ হলো ‘পরিষ্কার প্রমাণ’—সেখানে কোরআনের বক্তব্যকে সত্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘কোরআনে রয়েছে সত্য ও সঠিক বিষয়’ (৯৮: ৩); সুতরাং কিছু সংযোজন বা বিয়োজন পুরোপুরি নাকচ করা হয়েছে।
যারা নারীদের পর্দার পক্ষে ওকালতি করেন তারা মূলত হিজাবের নির্দেশনা দেন। হিজাব হলো একটি আরবি শব্দ যার অর্থ হলো ‘ঘোমটা’ বা ‘আবরণ’, ‘বিভাগ’, ‘বিভাজন’, ‘আলাদা’, ‘অঙ্গরখা’, ‘পর্দা’। কোরআনে হিজাব শব্দটির সাত বার উল্লেখ আছে। পাঁচ বার আছে ‘হিজাব’ হিসেবে এবং দুই বার ‘হিজবান’ হিসেবে। চলুন কোরআনের এই সাত আয়াত নিয়ে আমরা একটু আলোচনা করি যেখানে ‘হিজাব’ শব্দটি রয়েছে।
হিজাব শব্দটি সুরা আল আরাফের ৪৬ নম্বর আয়াতে জান্নাতবাসীদের থেকে জাহান্নামবাসীদের পৃথককারী একটি পর্দা বা বিভাজক বা বাধা বুঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে। নবী (সা.) এর বাড়িতে কীভাবে আচরণ করতে হতো তা সুরা আল আহজাবের ৫৩ নম্বর আয়াতে রয়েছে। আয়াতের তর্জমা করলে দাঁড়ায়—‘এবং যখনই রসূলের স্ত্রীদের কাছে কোনো কিছু চাইবে তা পর্দার অন্তরালে থেকে চাইবে। এটা তোমাদের এবং তাদের অন্তরের জন্য অধিক পবিত্রতার উদ্দেশ্যে’।
সুরা সাদের ৩২ নম্বর আয়াতে হিজাব শব্দটি পাওয়া যায় যেখানে এই শব্দ সূর্যকে রাতের অন্ধকারে ‘আড়াল’ হওয়ার কথা বুঝাতে ব্যবহার হয়েছে। সুরা ফুসিলাতের ৫ নম্বর আয়াতে হিজাব শব্দটি এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘তাদের মধ্যে যাদের অন্তর সত্যের প্রতি উন্মুক্ত হয় না, তারা বলে— পনি যে বিষয়ে আমাদের আমন্ত্রণ জানান, সে বিষয়ে আমাদের অন্তর আবৃত, আমাদের কর্ণ বধির এবং আমাদের ও আপনাদের মধ্যে রয়েছে একটি পর্দা‘।
এর পরবর্তী সুরা অর্থাৎ আস-শুরার ৫১ নম্বর আয়াতে হিজাব শব্দটি এসেছে। আয়াতের তরজমা করলে দাঁড়ায়—‘কোনো মানুষের এমন মর্যাদা নেই যে, আল্লাহ তার সঙ্গে সরাসরি কথা বলবেন, কোনো পর্দার আড়াল বা কোনো দূত বা ওহি ছাড়া ’। সুরা বনি ইসরাইলের ৪৫ নম্বর আয়াতের তর্জমা করলে দাঁড়ায়—‘যখন নবী কুরআন পাঠ করেন তখন আল্লাহ পরকালে অবিশ্বাসী ও নবীর মধ্যে প্রচ্ছন্ন পর্দা টেনে দেন।’ নারীদের মধ্যে সর্বাধিক সম্মানিত মরিয়ম যার নামে কোরআনে একটি সুরা রয়েছে সেই সুরার ১৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে ‘যখন ঈশ্বর তার (মরিয়মের) কাছে রুহ পাঠালেন তখন সে নিজেকে তাদের থেকে আড়াল করতে পর্দা করল’।
উপরোক্ত সাত আয়াতের কোনোটিতেই মুসলিম নারীদের ড্রেসকোড হিসেবে হিজাব পরিধান করতে বুঝানো হয়নি। দয়াশীল আল্লাহ অসীম জ্ঞানী, তিনি হিজাব শব্দটি নারীদের পোশাক হিসেবে বা ড্রেস কোড হিসেবে ব্যবহার করেননি। তবে কিছু মানুষ এটি ব্যবহার করেছে। এইসব পুরুষরা হিজাব শব্দটি প্রসঙ্গের বাইরে গিয়ে ব্যবহার করেছে। এমন একটি প্রসঙ্গে তারা শব্দটি ব্যবহার করেছে যা ঈশ্বর নিজে ব্যবহার করেননি। তারপর তারা হিজাবের অর্থ হিসেবে নারীদের পোশাক দাঁড় করিয়েছে। এটি এমন একটি অর্থ, যা সৃষ্টিকর্তা নিজে করেননি।
পোশাক হিসেবে হিজাব শব্দটির ব্যবহার আরও অবাক করে যখন কোরআনে কী পোশাক পরতে হবে সে ব্যাপারে নির্দিষ্ট শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করা হয়েছে, তবে সেই শব্দগুলোর কোথাও হিজাব শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি। সুরা আন নূর এর ৩১ নম্বর আয়াতে ‘খমোরেহেন্না’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। এই আয়াতে স্রষ্টা নারীদের তাদের বক্ষদেশ ঢেকে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। ‘খমোরেহেন্না’ শব্দটি ‘খুমার’ শব্দ থেকে উদ্ভূত (বহুবচন খিমার) যার অর্থ হলো—একটি শার্ট বা শাল বা ব্লাউজ বা যে কোনো আবরণ। এছাড়া এই আয়াতে মুখ বা চুল ঢেকে রাখা নয় বরং বুক ঢেকে রাখার কথা বলা হয়েছে। ‘জুয়ুবিহিন্না’ যে শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে তা ‘জায়ব’ থেকে উদ্ভূত (বহুবচন জুয়ুব) যার অর্থ হলো ‘বক্ষ’। যদি ঈশ্বরের উদ্দেশ্য হতো ঘোমটা চাপিয়ে দেওয়া তবে প্রেরিত আয়াতে মুখমণ্ডল ও ঘোমটা শব্দগুলো সরাসরি ব্যবহার করা থেকে কোনো কিছুই তাঁকে বিরত রাখতে পারত না। উপরে উল্লেখিত আয়াতে মুখ (ওয়াজহ, উজাহ, কুবাল); মাথা (রাআস); বা চুল (শাআর) এর কোনো উল্লেখ নেই। এমনকি এই আয়াতে হিজাব শব্দটিরও উল্লেখ নেই।
উল্লেখিত আয়াতে হয়ত এটাও নির্দেশিত হয়েছে যে, নারীরা তাদের মুখমণ্ডল ঢেকে রাখবে না। ওই আয়াতে বলা হয়েছে—নারীরা শুধুমাত্র তাদের প্রকাশিত অংশ ছাড়া অন্যান্য সৌন্দর্য প্রকাশ করবে না। যদি শরীরের এমন কোনো অংশ থাকে যা প্রকাশিত অংশ তবে তা হলো মুখমণ্ডল। শ্বাস ও গন্ধ নিতে নাক, মুখ দিয়ে পানাহার, চোখ দিয়ে দেখতে, কান দিয়ে শুনতে মুখমণ্ডলই সবচেয়ে বেশি প্রকাশিত অংশ।
যদি কান ও চোখ সামান্যতম ঢেকে রাখা হয় তবে দেখা ও শোনার কাজ বাধাগ্রস্ত হয়। মুখ আবৃত থাকলে খাওয়া ও পান করাও সম্ভব নয়। মুখমণ্ডলে পর্দার ব্যবহার নানা ধরণের জটিলতা সৃষ্টি করে। এবং আমাদের দয়াশীল সৃষ্টিকর্তা কোরআনের ২২ নম্বর সুরার ৭৮ নম্বর আয়াতে বলেছেন, তিনি ধর্মে কোনো জটিলতা রাখেননি।
শুধুমাত্র আরেকটি আয়াতে নারীদের পোশাক সম্পর্কে নির্দিষ্ট করে বলা হয়েছে—তা হলো সুরা আল আহজাবের ৫৯ নম্বর আয়াত। সেখানে নবী (সা.)-কে বলা হয়েছে তিনি যেন তার স্ত্রী ও কন্যা এবং বিশ্বাসী নারীদের বলেন, তারা যেন তাদের ‘জালাবিবের’ কিয়দংশ দিয়ে নিজেদের ঢেকে নেয়। এখানে ‘জালাবিব’ শব্দটি হলো ‘জিলবাব’ এর বহুবচন যার অর্থ হলো শার্ট, চাদর বা আলখেল্লা। প্রশ্ন জাগে, এই জালবিব বা জালাবিব শব্দের অর্থ কি এটা বুঝায় যে মুখমণ্ডল ঢেকে রাখতে হবে? পরিষ্কারভাবে না, কেননা মহাজ্ঞানী ঈশ্বর এমনটা বলতে চাইলে সেই শব্দ ব্যবহার করতেন।
নারীদের বলা হয়েছে তাদের শ্লীলতাহানি থেকে রক্ষা পেতে তাদের শরীর ঢেকে রাখার জন্য। যদি একজন নারীর মুখমণ্ডল ঢেকে রাখা হয় তবে তাকে কেউ চিনতে পারবে না। শরীরের একমাত্র অংশ যা দ্বারা এক মানুষকে আরেক মানুষ আলাদাভাবে চেনা যায় তা হলো তার মুখমণ্ডল। মানুষ শনাক্তকরণের অন্য সকল পদ্ধতি যেমন ফিঙ্গার, জেনেটিক প্রিন্টিং, রেটিনা পরীক্ষা শুধুমাত্র নির্দিষ্ট সরঞ্জাম দ্বারাই সম্ভব।
কোরআনে এমন একটাও আয়াত নেই যেখানে নারীদের মুখমণ্ডল ঢেকে রাখার জন্য বলা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, উপরে উল্লেখিত আয়াতগুলো দ্বারা এমনকি মুখমণ্ডল ঢেকে পর্দা উচিত নয় বলে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে, কারণ আয়াতগুলোতে নারীদের প্রকাশ্য ও জ্ঞাত হওয়ার আবশ্যকতা রয়েছে। যদি নারীদের মুখমণ্ডল ঢেকে রাখা হয় তবে তারা না প্রকাশিত না জ্ঞাত। এমনকি আজকের দিনে সৌদি আরব যেখানে কঠোর পর্দা প্রথা বিদ্যমান সেখানে হজের সময় প্রকৃত ইসলামিক চর্চা দেখা যায়। হজের সময় কোনো নারীর মুখমণ্ডল ঢাকা রাখা যায় না।
কোরআনের সৌন্দর্য ও মহিমা অন্তহীন। এর মাধ্যমে সবচেয়ে দয়ালু ও সবচেয়ে করুণাময় ঈশ্বর আমাদের বলেন যে, বিশ্বাসীদের উদ্দেশ্যই হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ‘হে আদমের সন্তান, নিজেকে আচ্ছাদিত ও ঢেকে রাখতে আমরা তোমাকে লিবাস (পোশাক) দিয়েছি এবং তোমাকে দিয়েছি ধার্মিকতার পোশাক, যা আরও উত্তম ’(আল কোরআন ৭: ২৬)। এবং ধার্মিকতার পোশাকের একমাত্র বিচারক হলেন স্রষ্টা। সুতরাং এ বিষয়টি মানুষের বিচারের অনেক ঊর্ধ্বে নিয়ে নেওয়া হয়েছে। তা বিচারের এখতিয়ার সর্বোচ্চ প্রভুর দরবারে নিয়ে নেওয়া হয়েছে।
যারা নারীদের মুখমণ্ডল কালো করতে চায় এবং তাদেরকে নিছক একটি বস্তু হিসেবে বিবেচনা করে তাদের অবশ্যই স্মরণ করতে হবে যে, ঈশ্বর বিশ্বাসী পুরুষদের তাদের দৃষ্টি নত রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। যদি নারীরা আবৃত হয়ে থাকে তবে পুরুষদের দৃষ্টি নত রাখার কোন প্রয়োজন হত না। দৃষ্টি নত রাখার আদেশটি প্রায়ই লজ্জাজনকভাবে অবজ্ঞা করা হয়। ১২ বছরের একটি বালিকার মুখমণ্ডল ঢাকার নিয়ম তৈরি না করে বরং পুরুষের দৃষ্টির উপর আইন তৈরি করাই আইনপ্রণেতাদের জন্য অধিক উপযুক্ত হবে।
আতিকুল ইসলাম ইমন: সাংবাদিক