November 23, 2024
অনুবাদসাহিত্যফিচার ৩বই নিয়ে আলাপ

পর্ব-১৪: সাদা কার্ড বাদামি কার্ড আর নারীর চোখে নারী

শিল্প সমালোচক, লেখক শার্লট মালিন্সের A Little Feminist History of Art বইটি বাংলায় অনুবাদ করছেন বিশিষ্ট অনুবাদক, শিক্ষক জি এইচ হাবীব। বইটির অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হচ্ছে ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে। আজ পড়ুন এর  চতুর্দশ পর্ব। সব পাঠকের সুবিধার জন্য প্রতি পর্বের শুরুতে বইটির এবং লেখক শার্লট মালিন্সের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দেয়া থাকবে।।

[নারীবাদী শিল্প আন্দোলনের শুরু ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে। পুরুষ প্রাধান্যবিশিষ্ট রঙ্গমঞ্চে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়ার জন্যে সে সময় নারী শিল্পীরা তাঁদের কাজগুলোর জেন্ডারচ্যুতি ঘটাবার সংগ্রামে নামেন। এরপর থেকে সেই আন্দোলন শিল্প জগতে গোটা বিশ্বজুড়ে অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন ক’রে আসছে। ‘নন্দনতাত্ত্বিক ফরমালিযম’ ব’লে অভিহিত যুগের পর সামাজিকভাবে প্রাসঙ্গিক নানান ইস্যুতে কথা বলার জন্য ‘নারীদৃষ্টি’-র সাহায্যে নারী শিল্পীরা বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ ক’রে জেন্ডার, পরিচয় এবং ফর্মের দিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন, সমালোচনা করেছেন সাংস্কৃতিক প্রত্যাশাগুলোকে এবং নারীকে সনাতনী দৈনন্দিন ধারণায় আটকে ফেলার ব্যাপারটিকে। সমাজের দৃষ্টি ঘোরাতে চেয়েছেন সাম্যের জন্যে নারীর সংগ্রাম এবং নারীদেহকে পণ্য হিসেবে দেখবার মানসিকতা ও ক্রিয়াকর্মের দিকে। “অল্প কথায় নারীবাদী শিল্প-ইতিহাস” (A Little Feminist History of Art) নামের ছোট্ট বইটিকে এই আন্দোলনের ফসল হিসেবে জাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু শিল্পকর্মের সংক্ষিপ্ত কিন্তু সারগর্ভ ভূমিকা বলা যেতে পারে। ১৯৬০-এর দশক থেকে বর্তমান কাল অব্দি পঞ্চাশটি অসামান্য কাজ নারীর জীবন ও অভিজ্ঞতাকে তুলে ধরেছে। সেই সঙ্গে, ভিয্যুয়াল সংস্কৃতির ওপর নারীবাদী আদর্শ ও রাজনীতি যে প্রভাব ফেলেছে সেটাও এই কাজগুলো মেলে ধরেছে। “অল্প কথায় নারীবাদী শিল্প-ইতিহাস” নামের এই গ্রন্থটি জেন্ডার বৈষম্য, যৌনতা, গার্হস্থ্য জীবন, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর নারী দেহের মতো বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা বিংশ শতকের সবচাইতে উচ্চাকাঙ্ক্ষী, প্রভাবশালী ও টেকসই শৈল্পিক আন্দোলনগুলোর একটির আনন্দ উদযাপন। 

শার্লট মালিন্স একজন শিল্প সমালোচক, লেখক এবং সম্প্রচারক। তিনি রেচল হোয়াইরিড, সেসিলি ব্রাউন, র‌্যাচেল লামসডেন,  জেনি স্যাভিল, ক্যাথে ডে মনসাউক্স, স্যু অ্যারোস্মিদ, সুজ্যান কুন, স্যুযি হ্যামিলটন এবং পলা রেগোসহ বিভিন্ন নারী শিল্পীকে নিয়ে লেখালেখি করেছেন। তাঁর রচিত ও প্রকাশিত বিভিন্ন গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে “লাইভ্স অভ দ্য গ্রেট আর্টিস্টস” (২০০৮) এবং “র‌্যাচেল হোয়াইহেড” (২০০৭)। তিনি বিবিসি রেডিও ফোর-এর “ফ্রন্ট রো” এবং “স্যাটারডে রিভিউ’’-র নিয়মিত প্রদায়ক]

অ্যাড্রিয়ান পাইপার (Adrian Piper)

(জন্ম ১৯৪৮)

১৯৮৬ সালে অ্যাড্রিয়ান পাইপার দুই বাক্স বিজনেস কার্ড ছাপালেন: এক বাক্সে ছিল সাদা কার্ড, অন্যটিতে বাদামি। সাদা কার্ডগুলো ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত ভক্তদের দূরে সরিয়ে রাখার জন্য; এবং তিনি বলতে চাইলেন যে কোন বার বা নাইটক্লাবে তিনি একা আছেন ব’লেই তার মানে এই নয় যে তিনি চান কেউ এসে তাঁর সঙ্গে প্রেমালাপ জুড়ে দিক। আর, কখনো কোন রেসিস্ট মন্তব্য বা গালি শুনলেই তিনি সাদা কার্ডটা ধরিয়ে দিতেন।

উজ্জ্বল-শ্যামলা আফ্রিকী-আমেরিকান হওয়ার কারণে তাঁকে লোকে অনেক সময় শ্বেতাঙ্গ ব’লে মনে করতো। তো, সেই সাদা কার্ডে লেখা ছিল: “প্রিয় সুহৃদ, আমি কৃষ্ণাঙ্গ। আমার ধারণা আপনি যখন সেই রেসিস্ট মন্তব্যটি করেছিলেন/শুনে হেসেছিলেন/অনুমোদন করেছিলেন তখন আপনি বুঝতে পারেননি যে আমি কৃষ্ণাঙ্গ।” পরে সেই কার্ডগুলো তাঁর প্রদর্শনীগুলোর দর্শকদের জন্যে রাখা হয়েছিল, আর সেখানে লেখা ছিল: এই সংগ্রামে যোগ দিন, নিজের ব্যবহারের জন্য কিছু কার্ড নিয়ে যান।

My Calling (Card) পূর্বসংস্কারের বিরুদ্ধে একটি ধারণাগত সমুচিত জবাব। পাইপার তাঁর পারফরমেন্সে এবং ‘আমার ব্যক্তিত্বের সীমারেখা সম্পর্কে সচেতনতা’র সুলুক সন্ধান করতে নিজের শরীর ব্যবহার করেন। তাঁর কাজ বা শিল্পকর্মগুলো অনেক সময়ই কোন গ্যালারি সেটিং-এর বদলে বাস্তব জগতে সৃষ্টি হয়, এবং তাঁদের প্রতিক্রিয়া উসকে দেয় যাঁরা অপ্রত্যাশিতভাবে সেসব কাজের মুখোমুখি হন। কাজগুলো হাতে নেবার বা করার ক্ষেত্রে তাঁর মূল প্রেরণা দর্শকের মধ্যে একটা পরিবর্তনের সূচনা করা।

 

শিল্পকর্ম পরিচিতি:

My Calling (Card) # 1 (ডিনার আর ককটেল পার্টির জন্য) ১৯৮৬ থেকে বর্তমান সময় অব্দি

My Calling (Card) # 2 (বার আর ডিস্কোর জন্য) ১৯৮৬ থেকে বর্তমান সময় অব্দি

পারফরমেন্স তৈজসপত্র: কার্ডবোর্ডের ওপর ছাপানো বিজনেস কার্ড

প্লাইউড, পেইন্ট, অ্যাক্রিলিক, এবং অন্যান্য উপকরণ

প্রতিটি ৫.১  X ৯ সে.মি.

 

জেনি স্যাভিল (Jenny Saville)

(জন্ম ১৯৭০)

ন্যুড তথা নগ্নমূর্তি বা নগ্নপ্রতিচ্ছবির ইতিহাস অপ্রতিরোধ্যভাবেই পুরুষ চিত্রকর এবং নারী মডেলদের ইতিহাস। ঠিকই এই রাজপাটটিকেই ১৯৯০-এর দশকে সেভিল তছনছ ক’রে দিলেন তাঁর নিজের নগ্ন দেহের বিপুলায়তন মাংসল ক্যানভাসগুলো দিয়ে। তিনি বলেন, “শিল্পের ইতিহাসে বরাবরই গজদন্তমিনারবাসী পুরুষদের আধিপত্য, যাঁরা নারীকে যৌন বিষয় হিসেবে দেখে থাকেন। আমি সেভাবেই নারীকে আঁকি যেভাবে বেশিরভাগ নারী নিজেদের দেখে থাকেন। আমি তাঁদের পরিচয়, তাঁদের ত্বক, তাঁদের চুল, তাঁদের উত্তাপ, তাঁদের দোষ-ত্রুটি  ধরবার চেষ্টা করি।”

Propped  চিত্রকর্মে  স্যাভিলকে অতিকায় আকারে একটি উঁচু টুলের ওপর বসা অবস্থায় ওপর থেকে দর্শকের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখা যায়। তাঁর দুই বাহু তাঁর স্তনজোড়ার ওপর আড়াআড়িভাবে প’ড়ে আছে, কাঁধদুটো ঝুঁকে-পড়া, এবং তাঁর হাতের আঙুলগুলো অস্বস্তির সঙ্গে উরুদুটো খামচে ধ’রে আছে। আয়নার ওপর লিখলে যেমন দেখা যায় তেমন ক’রে ছবির পুরো তলটা জুড়ে কিছু লেখা আছে রঙ দিয়ে। ওগুলো আসলে ফরাসী নারীবাদী ল্যুস ইরিগ্যারে-র কথা: “আমরা যদি এই বৈচিত্র্যহীনতা নিয়ে কথা বলতে থাকি, পুরুষেরা শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে যেভাবে কথা বলেছে আমরা যদি সেভাবে এক অপরের সঙ্গে কথা বলতে থাকি- যেমনটা তারা আমাদের বলতে শিখিয়েছে তেমন ক’রে- তাহলে আমরা একে অপরের সঙ্গে বিশ্বাঘাতকতা করবো। আবার।”

Sotheby নিলামঘরে ২০১৮ সালে Propped  ৯০ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ডে বিক্রি হয়েছিল। এর আগে কোনো জীবিত নারী শিল্পীর শিল্পকর্ম এত চড়া দামে বিকোয়নি।

শিল্পকর্ম পরিচিতি:

Propped  ১৯৯২

ক্যানভাসে অয়েল পেইন্ট

২১৩.৫ X ১৮৩

 

(চলবে)

পর্ব-১: শিরীন নিশাত ও যারিনা হাশমি- দ্রোহ আর স্মৃতিকাতরতা

পর্ব-২: মহাজাগতিক সৃজনকারী শক্তি ও নারীর স্বরূপে ফেরা

পর্ব-৩: শিল্পের নতুন বিষয় ও শিল্পীর শরীর

পর্ব-৪: শ্রম বৈষম্য এবং সন্তান পালনের দলিল

পর্ব-৫: নারীর প্রতীকী ইতিহাস এবং শিল্পকর্ম হিসেবে দেহ

পর্ব-৬: দেহ ভাস্কর্য ও চিরন্তন মাতৃসত্তার বিরুদ্ধচিত্র

পর্ব-৭: গার্হস্থ্য জীবন আর অন-স্ক্রীন নারীত্বের স্বরূপ উন্মোচন

পর্ব-৮: দেহাস্ত্র এবং অনিরপেক্ষ প্রতিচ্ছবি

পর্ব-৯: বোধ স্বতন্ত্র এবং ফিউশন অস্বস্তিকর

পর্ব-১০ নির্যাতন নিরন্তর ও পিতৃতান্ত্রিক বিশ্বে নারী হওয়ার জটিলতা

পর্ব-১১: ব্যক্তিগত ক্ষমতায়ন এবং কৃষ্ণাঙ্গ নারী সমকামীর অভিজ্ঞতা

পর্ব-১২: পেশল বাস্তবতা আর পূর্বকল্পিত জেন্ডার বিষয়ক মতামত

পর্ব-১৩: সঙ্গীতের মহাফেজখানা আর ঐতিহাসিক পেইন্টিং-এর ভিন্ন বয়ান