ডিভোর্স বিষাক্ত নয়, বরং বিষ থেকে মুক্তি
তৌকির ইসলাম।। ‘ডিভোর্স’ শব্দটি শুনলে আজও অনেকে ইনিয়ে বিনিয়ে ওঠেন। একজন ডিভোর্সপ্রাপ্ত মানুষকে সমাজের সকলে দেখে বাঁকা চোখে। কেউ কেউ চোখ বন্ধ করে থাকেন যেন দেখতে না হয়! কিন্তু ডিভোর্স কি এতটাই খারাপ? এতটাই বিষাক্ত?
না। ডিভোর্স কোন নেগেটিভ ইস্যু নয় বরং ডিভোর্স প্রতিটি মানুষের একটা অধিকার। তাহলে সমাজে ডিভোর্স নিয়ে এত কানাঘুষা কেন? সেইটা বিশ্লেষণ করতেই আজ লিখতে বসেছি। যা লিখছি তা আমার নিজস্ব অভিমত আর জীবন দর্শন।
ধরুন একজন পুরুষ ও একজন নারী বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন। একটা নির্দিষ্ট সময় পর তাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটল এবং তারা ডিভোর্স নিতে ইচ্ছুক কিন্তু নিতে পারছেন না। কারণ কী জানেন? কারণ হল সমাজ কী বলবে, পরিবারের মানুষজন কি সাপোর্ট দিবে- ইত্যাদি। আর যদি এদের দুজনের মধ্যে চলে আসে কোন নতুন অতিথি তখন শুরু হয়ে যাবে নতুন আরেক ডাইমেনশন। পুরুষ সদস্যটি কোন মতে ডিভোর্সে পার পেলেও নারী সদস্যের কিন্তু রেহাই নাই। সমাজ তখন তার দিকেই আঙ্গুল তুলবে। তার চরিত্র-শিক্ষা-চাকুরি-ধর্ম-কর্ম কোন কিছু নিয়েই শেমিং করতে সমাজ থেকে শুরু করে পরিবার পর্যন্ত কেউ কোন দ্বিধা করবে না। কিন্তু যদি এই দুটো মানুষই সম্পর্কের অবনতি জানা সত্যেও কষ্ট করে এই ভাঙ্গা সম্পর্ক টেনে নিয়ে যেতেন তবে এই সমাজ আর পরিবার কম্প্রোমাইজের উদাহরণ টেনে বাহবা দিত কিন্তু ডিভোর্সটাকে মেনে নিত না। এখন আপনিই বলুন যে এই দুটি বা তিনটি মানুষ কি কোন দিন ভালো থাকবে? তাদের সম্পর্কে কোন সম্মান থাকবে? তাদের সন্তানের বিকাশ কি ঠিকভাবে হবে? প্রতিটি উত্তরই হবে ‘না’।
চিন্তা করুন সমাজ যদি বিয়ের মত ডিভোর্সকে মেনে নিত তবে কি আমরা অনেকগুলো সুখি মানুষ পেতাম না! অবশ্যই পেতাম। ডিভোর্স কোন নেতিবাচক দিক নয়। বরং ডিভোর্স হচ্ছে একটি প্রতিকূল সম্পর্ক থেকে মুক্তি যা হয়তো আমাদের জীবনে অনেকটা শান্তি দিতে পারে। হ্যাঁ, ডিভোর্সের রেট বেড়েছে আগের তুলনায় কিন্তু তা কি আমাদের সমাজে চলমান সম্পর্কের নামে যে অভিনয়টা হচ্ছে তার তুলনায় যথেষ্ট? মোটেও নয়। আমি অনেক পরিবারের মাঝে দেখেছি তারা সন্তানদের বিশেষ করে মেয়ের ভালো থাকার চেয়ে সমাজ কি বলবে তা নিয়ে ভেবে ডিভোর্সকে সমর্থন করেন না। হোক তার স্বামী মদ্যপ কি চরিত্রহীন! মানিয়ে নেওয়ার বুলি আউরিয়ে পরিবারের দায়িত্ব শেষ। অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী অনেক নারীকেও দেখেছি ডিভোর্সকে তারা চান না। কারণ সমাজের ব্লেমিং-শেমিং, সন্তানদের কী হবে এই নিয়ে ভাবনা ইত্যাদি ইত্যাদি। সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে এই মুসলিম দেশে ডিভোর্সকে নেগেটিভ ইস্যু হিসেবে নিলেও খোদ ইসলামেই ডিভোর্সকে বৈধতা দিয়েছে, ডিভোর্সপ্রাপ্ত নারী ও পুরুষকে পুনরায় বিয়ের বৈধতা দিয়েছে। আইনেও এর ব্যত্যয় নেই। ব্যত্যয়টা আমাদের মাঝেই প্রকট।
এত কিছু বলার পর আপনার মনে প্রশ্ন আসতে পারে ডিভোর্স নিয়ে কেন এত কথা বলছি, ডিভোর্সকে কেন এত পজিটিভলি নিচ্ছি!
ডিভোর্স বৈধ। ধর্মীয় বলুন আর আইনগত বলুন এটি একটি অধিকার। কম্প্রোমাইজের বিপক্ষে আমি বলছি, তা নয়। সংসার করতে গেলে অবশ্যই ছাড় দিতে হয়, হবে। কিন্তু কতটুকু ছাড় আপনি দেবেন তাও তো আপনাকে ভাবতে হবে। আপনার ছেলে বাসার কাজের মেয়ের সাথে ঘুমুলে যদি ভুল হয়ে গিয়েছে বলে ক্ষমা পেয়ে যায় আর ড্রাইভার ভুলে আপনার ছেলের বউয়ের হাত ধরে ফেলেছে বলে সে অসতী বনে যায়, তবে এটা কম্প্রমাইজ নয়। শাড়ির রঙ পছন্দ হয় নি বলে যদি আপনার স্ত্রী পুরো বাড়ি মাথায় তোলে আর আপনি চুপ করে তা মেনে নেন তবে তা ছাড় দেওয়া নয়। অন্তত আমি তাই বিশ্বাস করি। এমন সম্পর্ক টেনে বা বয়ে না নিয়ে যাওয়া অনেক ভালো। আর সমাজ ও পরিবারকে এখানেই সাপোর্ট দিতে হবে। ডিভোর্স নেওয়ার সিদ্ধান্তকে ওয়েলকাম করতে হবে। তবেই একটা অসুন্দর সম্পর্ক থেকে মানুষগুলো বেঁচে যাবে।
নিজেকে হারিয়ে ফেলে সম্পর্ক টেনে নিয়ে লাভ নেই। আর তাই সমাজ যত ডিভোর্সকে সঠিক মূল্যায়ন করবে, সম্মানের সাথে মেনে নেবে ততই বিষাক্ত মেকি সম্পর্কগুলো থেকে পরিত্রাণ পাবে মানুষ, সুখে থাকবে, ভালো থাকবে।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]