ট্রান্সজেন্ডার: মগজ থেকে দূর করুন ভুলগুলো
মেহেরুন নূর রহমান।। ট্রান্সজেন্ডার বা রূপান্তরিত লিঙ্গরা হলেন সেইসব ব্যক্তিরা, যারা যে জৈবিক লিঙ্গের সাথে জন্মগ্রহণ করেন তার সাথে নিজেকে সনাক্ত করতে পারেন না। এদের লৈঙ্গিক পরিচয় বা প্রকাশ (জেন্ডার আইডেন্টিটি) জন্মগতভাবে তাদের জন্য নির্ধারিত জৈবিক লিঙ্গ থেকে পৃথক।
মনে রাখা দরকার হিজড়া এবং রূপান্তরিত লিঙ্গরা কিন্তু এক নয়। ট্রান্সজেন্ডার বা রূপান্তরিত লিঙ্গরা শারীরিকভাবে পুরুষ অথবা নারী হিসেবে জন্মগ্রহন করলেও এদের মানসিক লিঙ্গবোধ তাদের জৈবিক লিঙ্গের বিপরীত বা এদের লৈঙ্গিক অনুভূতি সুস্পষ্টভাবে নারীসুলভ বা পুরুষসুলভ নয়।
কিছু ট্রান্সজেন্ডার এক লিঙ্গ থেকে অন্য লিঙ্গে রূপান্তরিত হতে চিকিৎসার সহায়তা নেয়। এদের ট্রান্সসেক্সচুয়াল বা রূপান্তরকামী বলা হয়। এটা ট্রান্সজেন্ডারদের লৈঙ্গিক পরিচয়ের একটি স্থায়ী সমাধানের অভিব্যক্তি বলা যেতে পারে।
রূপান্তরিত লিঙ্গ বা ট্রান্সজেন্ডারদের এই জৈবিক লিঙ্গের সাথে লৈঙ্গিক পরিচয়ের ভিন্নতা প্রকাশ পায় তাদের মন মানসিকতায় , জীবনধারায়, পোশাক নির্বাচনে, সাজসজ্জায়, যৌনসঙ্গী এবং জীবনসঙ্গী নির্বাচনে।
ঠিক কী কারনে মানুষ ট্রান্সজেন্ডার হয় তার পরিষ্কার সাইন্টিফিক ব্যাখ্যা এখন পর্যন্ত বের হয় নাই কিন্তু এর উপর বহু গবেষণা চলছে। রূপান্তরিত লিঙ্গদের মস্তিষ্কের গঠন এবং জেনেটিক কোড নিয়ে রিসার্চ চলছে। ভবিষ্যতে আমরা হয়তো এর সঠিক ব্যাখ্যা পেয়ে যাবো কিন্তু বিভিন্ন গবেষণায় এটা প্রমানিত হয়েছে যে রূপান্তরিত লিঙ্গ বা ট্রান্সজেন্ডার প্রকৃতিবিরুদ্ধ নয়।
অনেকেই মনে করে রূপান্তরিত লিঙ্গরা মানসিক বিকৃতির শিকার বা বদসঙ্গের ফলাফল। শাসন ও মারধোর করলে এই ভূত মাথ থেকে নেমে যাবে। আবার অনেকেই মনে করে শিশুদের বেড়ে ওঠার সাথে এটি জড়িত। ছেলেরা পুতুল বা রান্নাবাটি খেললে, কিম্বা তাদের গোলাপী কাপড় পরালে, বা ঘরের কাজ করালে বড় হয়ে তারা তাদের পুরষত্ব (ম্যাস্কুলিনিটি) হারায় এবং এ ধরনের ছেলেদের ট্রান্সজেন্ডার বা ক্রসড্রেসার হবার সম্ভাবনা আছে। অত্যন্ত ভ্রান্ত ধারণা এসব।
বাংলাদেশের কথা ভাবুন, যেখানে একটি ছেলে শিশু বড়ই হয় ভয়ংকর পুরুষশাসিত সমাজে। তারা বেড়ে উঠে এই ভেবে রান্নাবান্না মেয়েদের কাজ। লিপিস্টিক, নেইলপলিশ, কাজল ব্যবহার করে মেয়েরা। শাড়ি, সালোয়ার কামিজ মেয়েদের জন্য নির্দিষ্ট পোশাক। এমন একটা সমাজ ব্যবস্থায় তাহলে ট্রান্সজেন্ডার তৈরি হয় কী করে? যদিও আমারা সকলেই জানি, বাংলাদেশেও প্রচুর ট্রান্সজেন্ডার মানুষ আছে।
আমাদের বোঝা দরকার কেন আমাদের মাঝে অনেকই জৈবিক লিঙ্গের সাথে নিজের লৈঙ্গিক পরিচয়ের অমিল খুঁজে পায়। কেন তারা একটি পর্যায়ে এসে সম্ভব হলে নিজের জৈবিক লিঙ্গের বিপরীত বা অন্য লৈঙ্গিক পরিচয় কে সামনে নিয়ে আসে বা আনতে চেষ্টা করে। এভাবে নিজেকে প্রকাশ করার ইচ্ছা কিন্তু সহজ নয়। এই ইচ্ছাশক্তি নিজের ভেতর থেকে আসতে হয়। জোর বা মজা করে এটা সম্ভব নয় যেখানে এর সাথে সামাজিক লজ্জা, অবমাননা জড়িত।
আমরা প্রায়শই জৈবিক লিঙ্গ (সেক্স) এবং লৈঙ্গিক পরিচয় (জেন্ডার আইডেন্টিটি) এর মধ্যে বিভ্রান্ত হই । জৈবিক লিঙ্গ পুরুষ এবং স্ত্রীদের মধ্যে জৈবিক পার্থক্য বোঝায়। উদাহরণস্বরূপ, ক্রোমোজোম (নারী এক্সএক্স, পুরুষ এক্সওয়াই), প্রজনন অঙ্গ (ডিম্বাশয়, টেস্টেস), হরমোন (ইস্ট্রোজেন, টেস্টোস্টেরন)। আর লৈঙ্গিক পরিচয় বা জেন্ডার আইডেন্টিটি, পুরুষ এবং নারীদের মন-মানসিকতা, আচরণ, জীবনধারা, যৌন দৃষ্টিভঙ্গি এবং যৌন ক্রিয়াকলাপ সহ সমগ্র জীবনাচারকে বোঝায়। আমরা ধরেই নেই একজন নারী বা পুরুষের লৈঙ্গিক পরিচয় তার জৈবিক লিঙ্গ অনুযায়ী হবে। অর্থাৎ একটি মেয়ে শিশুর আচরণ সমাজের পূর্বনির্ধারিত মেয়েদের আচরনের মত হবে এবং ছেলেদেরর ক্ষেত্রেও তাই। ট্রান্সজেন্ডার বা রূপান্তরিত লিঙ্গদের ক্ষেত্রে এটা হয় না। জৈবিক লিঙ্গর সাথে তাদের লৈঙ্গিক পরিচয় এবং জীবনাচার মেলে না।
জনস হপকিন্স চিলড্রেনস সেন্টারের গবেষণায় দেখা গেছে যে লিঙ্গ পরিচয় বা প্রকাশ প্রায় সম্পূর্ণভাবে প্রাকৃতিক এবং শিশুর জন্মের আগে প্রায় পূর্বনির্ধারিত। উইলিয়াম রেইনার, যিনি একজন কিশোর-কিশোরী মনোচিকিৎসক এবং ইউরোলজিস্ট, দুটি গবেষণায় নিশ্চিত করেছেন যে, জৈবিক লিঙ্গ নির্বিশেষে, অ্যান্ড্রোজেনের সংক্রমণের পরিমাণ প্রায় একচেটিয়াভাবে সিদ্ধান্ত নেয় একটি শিশু পুরুষালি (ম্যাস্কুলিন) না মেয়েলি (ফেমিনিন) হিসাবে চিহ্নিত হবে। অর্থাৎ একজন মেয়ের মধ্যে যেমন পুরুষালী ভাব থাকতে পারে তেমনি একজন ছেলের মধ্যে থাকতে পারে মেয়েলি ভাব। তার মানে হলো সেক্স বা জৈবিক লিঙ্গ, জেন্ডার আইডেন্টিটি বা লিঙ্গ পরিচয় বা প্রকাশকে নিরূপণ করছে না।
রেইনার তার প্রথম সমীক্ষায়, ১৪ জন শিশুকে অনুসরণ করেছিলেন যাদের জন্মের সময় অন্ডকোষ এবং পুরুষ হরমোনের মাত্রা পুরোপুরি স্বাভাবিক থাকলেও তারা পুরুষাঙ্গ ছাড়া জন্মগ্রহণ করেছিলো। সেই ১২ টি শিশুর উপর যৌন পুনর্নির্মাণের সার্জারি করা হয়েছিল তাদের মেয়ে হিসেবে রূপান্তর করার জন্য। বর্তমানে মেয়ে হিসেবে বড় হওয়া এই ১২টি শিশু তাদের আচরণ, দৃষ্টিভঙ্গি, বন্ধুবান্ধব এবং খেলায় ছেলেদের মতই আচরন করছে এবং ১২ জনের এর মধ্যে ৭ জন ইতিমধ্যে তাদের পুরুষ লিঙ্গ পরিচয় পূনরায় প্রকাশ করেছে। যে দুটি শিশুর যৌন পুনর্নির্মাণের সার্জারি হয়নি তারা স্বাভাবিক ছেলেদের মতই বিকাশ লাভ করেছে।
দ্বিতীয় সমীক্ষায়, রাইনার ১২টি ছেলে শিশুকে অনুসরণ করেছিলেন যারা একই ধরণের ত্রুটি নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলো। তাদের জন্মের সময় লিঙ্গের (যৌনাঙ্গের) অনুপস্থিতি ছিলো। এই সব শিশুগুলোকেও মেয়েতে রূপান্তরেরে জন্য যৌন পুনর্নির্মাণের শল্যচিকিৎসা করা হয়েছিল। বর্তমানে ১২ জনের মধ্যে ৮ জনই নিজেকে আবার পুরুষ পরিচয়ে স্বীকৃতি দিয়েছে। বাকী ৪ জনের ক্ষেত্রেও একই ফলাফলের সম্ভাবনা রয়েছে।
এ থেকে আমরা বুঝতে পারি যে লিঙ্গ পরিচয় কোন বেছে নেওয়ার জিনিষ নয়। জোর করে, মজা করে বা বদ সঙ্গের কারণে চাইলেই আমরা আমাদের জেন্ডার আইডেন্টিটি পরিবর্তন করতে পারিনা। পরিবেশগত কারনে সাময়িক কিছু প্রভাব পড়লেও সেটা সম্পূর্ণ জীবন যাপনকে বদলে দিতে পারে না।
শৈশব থেকেই একজন ট্রান্সজেন্ডার নানা অমানবিক আচরন, ঘৃণা এবং বঞ্চনার ভেতর দিয়ে বড় হয়। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিবারসহ বাইরে সব জায়গায় তারা নানা অপমানের শিকার হয়। বহু ট্রান্সজেন্ডার মানুষ জেন্ডার ডিস্ফোরিয়াতে ভোগে। জেন্ডার ডিস্ফোরিয়া একটি কষ্টকর উদ্বেগময় অনুভূতির নাম যা একজনের জৈবিক লিঙ্গ এবং লিঙ্গ পরিচয়ের মধ্যে অমিলের কারণে তৈরি হতে পারে । জেন্ডার ডিসফোরিয়া কখনো কখনো এত তীব্র হয় যা একজনকে প্রচন্ড হতাশাগ্রস্ত করে তুলতে পারে এবং এর প্রভাব তার দৈনন্দিন জীবনে ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলতে পারে। আত্মহত্যার মত ঘটনাও এর থেকে ঘটতে পারে। তাই দয়া করে ট্রান্সজেন্ডার বা রূপান্তরিত লিঙ্গদের অন্যভাবে দেখা থকে বিরত থাকুন। তাদের ন্যায্য সন্মান এবং অধিকার পেতে সাহায্য করুন।
আপনার সন্তানের মধ্যে যদি লৈঙ্গিক পরিচয়ের ক্ষেত্রে কোন ভিন্নতা লক্ষ্য করেন তবে দয়া করে প্রথমেই তাকে মারধোর বা জোর করে পরিবর্তনের চেষ্টা থেকে বিরত থাকুন। কথা বলুন, বোঝার চেষ্টা করুন। দরকার হলে স্পেশালিস্টের সাহায্য নিন। অকারন অত্যাচার করবেন না। সামাজিক এবং ধর্মীয় বেড়াজালে আটকে থাকা নিয়ম থেকে বের হয়ে আপনার সন্তানের প্রতি মানবিক আচরণ করুন যেন সে একটি সুস্থ মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠতে পারে এবং সমাজের সকল বৈরিতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারে। আপনারাই যদি তার পাশে না দাঁড়ান তবে আর কে দাঁড়াবে বলুন তো?
মেহেরুন নূর রহমান: লন্ডনে আন্তর্জাতিক মিডিয়া ও এডভার্টাইজিং সংস্থায় কর্মরত