পর্ব-১৭: নারীর দেহভাষা আর পুরুষের প্রত্যাশার বিরুদ্ধাচারণ
শিল্প সমালোচক, লেখক শার্লট মালিন্সের A Little Feminist History of Art বইটি বাংলায় অনুবাদ করছেন বিশিষ্ট অনুবাদক, শিক্ষক জি এইচ হাবীব। বইটির অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হচ্ছে ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে। আজ পড়ুন এর সতেরোতম পর্ব। সব পাঠকের সুবিধার জন্য প্রতি পর্বের শুরুতে বইটির এবং লেখক শার্লট মালিন্সের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দেয়া থাকবে।।
(জন্ম ১৯৪১)
রবার্টা ব্রেইটমোর কে ছিলেন? একজন পূর্ণ বয়স্ক নারী হিসেবে তিনি ১৯৭৪ সালে জন্মগ্রহণ ক’রে বেশ কয়েক বছর বিদ্যমান ছিলেন, এবং তারপর যে শিল্পী তাঁকে সৃষ্টি করেছিলেন- লিন হার্শম্যান লীসন- তাঁর মাধ্যমে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে “অবসর” নেন। এর মধ্যে লীসন এবং আরো তিনজন নারী ব্রেইটমোর-এর ভূমিকায় অভিনয় করেন। তাঁদের সবাই তাঁর ব্যক্তিত্ব ধারণ করলেন, তাঁর কাপড় চোপড় পরলেন এবং তাঁদের সঙ্গে ছিল তাঁর ক্রেডিট কার্ড ও গাড়ি চালাবার অনুমোদনপত্র।
ব্রেইটমোর ছিলেন লীসন-এর দ্বিতীয় সত্তা, একটি চরিত্র যার মাধ্যমে লীসন নারী সম্পর্কে সমাজের আকাঙ্ক্ষা ও ধারণাগুলোর উন্মোচন ঘটিয়েছেন। ব্রেইটমোর একজন ব্যক্তি হিসেবে যেমন বিদ্যমান ছিলেন, সেই সঙ্গে অস্তিত্বশীল ছিলেন প্রামাণ্য দলিল বা নথির মাধ্যমেও । Roberta’s Body Language Chart –এ ব্রেইটমোর-এর ছোট ছোট সাদা-কালো ছবিগুলোকে বিশ্লেষণ ক’রে নীচে টাইপ ক’রে লিখে দেয়া হয়েছে। দুই হাত আড়াআড়িভাবে রাখার মানে কি তিনি ‘হতাশ’? স্কার্ট নীচের দিকে টেনে ধরার মানে কি ‘যৌন শীতলতা বা যৌনতা সম্পর্কে ভীতি’? ব্রেইটমোরের এই ছবিগুলো সম্পর্কে আমরা আসলে ঠিক কী বলতে পারি, যে ছবিগুলো সম্ভবত ব্রেইটমোর যখন তার মনোচিকিৎসকের সঙ্গে দেখা করেছিলেন তখন তোলা হয়েছিল! লীসন বলছেন, “সংস্কৃতি থেকে শিল্পবস্তু সংগ্রহ ক’রে এবং জীবনের সঙ্গে সরাসরি মিথস্ক্রিয়া (ইন্টারঅ্যাক্ট) ক’রে সে (ব্রেইটমোর) এমন একটি আয়নায় পরিণত হয়েছিল যেটায় দুই পাশ থেকেই মুখ দেখা যায়, আর সে-আয়নায় অভিজ্ঞতার মাধ্যমে অর্জিত সমাজের পক্ষপাতিত্ব প্রতিফলিত হয়।”
শিল্পকর্ম পরিচিতি:
Roberta’s Body Language Chart ১৯৭৮
আলোকচিত্র; কাগজে জেলাটিন সিলভার প্রিন্ট
১০২.৬ X ৮৫.৩
সারাহ লুকাস (Sarah Lucas)
(জন্ম ১৯৬২)
শিল্পে নারীদেহকে সচরাচর যেভাবে তুলে ধরা হয় তার একটা শ্লেষাত্মক প্রত্যুত্তর সারাহ লুকাস-এর Self-Portrait with Fried Eggs । নানান রঙের চৌখুপী নকশা আঁকা নোংরা মেঝেতে একটা পুরানো চেয়ারে ব’সে আছেন লুকাস। তাঁর পা ছড়ানো, সাথে মার্লবোরো সিগারেট, সরাসরি দর্শকের চোখের দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি। নারী যে পুরুষের কাছে কেবল তাকিয়ে দেখার বস্তু বা তাদের আনন্দের উপকরণ, পুরুষের এই প্রত্যাশার বিরুদ্ধাচারণ করেন তিনি। এই প্রতিচ্ছবিটিতে লুকাস নিজে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন। তাঁর শারীরিক উপস্থাপনকে নিয়ে একটা খেলায় রত হয়েছেন, আর স্তনের বদলে পোচ ডিম ব্যবহার করেছেন।
এই ছবিটি বারোটি আত্ম-প্রতিকৃতির একটি সিরিযের অন্যতম। সেখানে তিনি যেসব থিম ব্যবহার করেছেন সেগুলো সুস্পষ্ট: শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোর বিকল্প হিসেবে নানান সব্জি আর ফলের ব্যবহার, টাইটস আর সিগারেটের মতো দৈনন্দিন ‘রেডিমেড’ জিনিসের ব্যবহার, আর এক যুদ্ধংদেহী রসবোধ। আলোকচিত্রগুলোতে তাঁকে কলা খেতে, টয়লেটে বসা অবস্থায়, এবং বেশ কিছু নিকার (knicker) শুকাতে দেয়া একটা দড়ির সামনে দেখা যায়। তাঁর ভাষায়, “আমার ছবি কেউ তুলুক সেটা আমার কখনো ভালো লাগত না, এবং সম্ভব হলে এটা আমি সব সময় এড়িয়ে যেতাম। আমার মনে হতো আমাকে পুরুষালি দেখায়।…‘‘ কিন্তু কলাসহ সেই ছবিতে, সেই বারোটি ছবির প্রথমটায়, আপনি দেখবেন যে সেদিন আমাকে বিশেষভাবে ভাল লাগছে কিনা, বা আপনি যতটা দেখতে চান তার চাইতে আপনাকে একটুখানি বেশি বা কম পুরুষালি দেখাচ্ছে কিনা সেটা ছবিটার ক্ষেত্রে কাজে লেগেছে। সেগুলো আপনার অহংকারের ক্ষেত্রে কাজে লাগেনি।”
শিল্পকর্ম পরিচিতি:
Self-Potrait with Fried Eggs ১৯৯৬
কাগজে ডিজিটাল প্রিন্ট
৭৫ X ৫১
(চলবে)
পর্ব-১: শিরীন নিশাত ও যারিনা হাশমি- দ্রোহ আর স্মৃতিকাতরতা
পর্ব-২: মহাজাগতিক সৃজনকারী শক্তি ও নারীর স্বরূপে ফেরা
পর্ব-৩: শিল্পের নতুন বিষয় ও শিল্পীর শরীর
পর্ব-৪: শ্রম বৈষম্য এবং সন্তান পালনের দলিল
পর্ব-৫: নারীর প্রতীকী ইতিহাস এবং শিল্পকর্ম হিসেবে দেহ
পর্ব-৬: দেহ ভাস্কর্য ও চিরন্তন মাতৃসত্তার বিরুদ্ধচিত্র
পর্ব-৭: গার্হস্থ্য জীবন আর অন-স্ক্রীন নারীত্বের স্বরূপ উন্মোচন
পর্ব-৮: দেহাস্ত্র এবং অনিরপেক্ষ প্রতিচ্ছবি
পর্ব-৯: বোধ স্বতন্ত্র এবং ফিউশন অস্বস্তিকর
পর্ব-১০ নির্যাতন নিরন্তর ও পিতৃতান্ত্রিক বিশ্বে নারী হওয়ার জটিলতা
পর্ব-১১: ব্যক্তিগত ক্ষমতায়ন এবং কৃষ্ণাঙ্গ নারী সমকামীর অভিজ্ঞতা
পর্ব-১২: পেশল বাস্তবতা আর পূর্বকল্পিত জেন্ডার বিষয়ক মতামত
পর্ব-১৩: সঙ্গীতের মহাফেজখানা আর ঐতিহাসিক পেইন্টিং-এর ভিন্ন বয়ান
পর্ব-১৪: সাদা কার্ড বাদামি কার্ড আর নারীর চোখে নারী
পর্ব-১৫: দৈনন্দিনের একঘেয়েমি আর শিল্পে গেরিলাযুদ্ধ
পর্ব-১৬: আশ্রয়স্থল কিংবা কারাগার আর ফিমেল আর্টের অনুসন্ধান