December 23, 2024
ফিচার ২মুক্তমত

সংসারের সব কাজ একা সামলে যারা ‘সুখি স্ত্রী’ হন…

তানজিয়া রহমান।। আমি বড় হয়েছি পুরুষতান্ত্রিক সমাজে। পুরুষতান্ত্রিক পরিবারেও বলা যায়। যেখানে মহিলারা নিজেরাই যেন স্বেচ্ছায় পুরুষের দ্বারা শাসিত। ছোট থেকে দেখেছি অসুখ বিসুখ উপেক্ষা করে বাড়ির মহিলারা ভোরে সবার আগে ঘুম থেকে উঠে বাড়িঘর ঝাড় দিয়ে রান্নাঘরে ছুটতেন সকালের নাস্তা তৈরি করতে। নাস্তা হয়ে গেলে টেবিল সাজানোর পর স্বামী বাচ্চাকে ডাকা হবে খাবার খেতে (তার আগে আবার রান্নার এক ফাঁকে এসে তাদের ঘুম থেকে ডেকে দিতে হবে, উঠে যেন ফ্রেশ হয়ে নেয়)। নাস্তা করার সময় অবশ্যই স্ত্রীর থাকতে হবে সঙ্গে নাস্তা করার জন্য, তা নাহলে স্বামী সন্তানের প্লেটে খাবার তুলে দেয়ার জন্য, গ্লাসে পানি ঢেলে দেয়ার জন্য। স্বামী নাস্তা করে স্ত্রীর করে দেয়া লাঞ্চবক্স নিয়ে কাজে বের হবেন।

এবার মা বাচ্চাকে স্কুলে পাঠানোর জন্য রেডি করবেন। পোশাক পড়ানো, রুটিন দেখে ব্যাগে বই খাতা তোলা, টিফিন তোলা, জুতা মোজা পড়ানো সব  করে দিয়ে এবার নিজে রেডি হয়ে বাচ্চাকে স্কুলে দিয়ে বাসায় এসে রান্নার আয়োজন করবেন। সবজি কুটে ধুয়ে রান্না করে। রান্নাঘর পরিষ্কার করে ঘরবাড়ি ঝাড় দিয়ে, মুছে কোনমতে গোসল করে আবার ছুটবে বাচ্চাকে স্কুল থেকে আনতে। বাচ্চাকে বাসায় এনে পোশাক পাল্টে দেয়া, গোসল করানো, খাওয়ানো, নিজে খাওয়া। খাওয়া শেষে গোছগাছ করে বাচ্চাকে ঘুম পাড়াবেন।

বিকালে শুকনো কাপড় তোলা। সন্ধ্যায় খাওয়ার জন্য নাস্তা তৈরি করা। স্বামী কাজ থেকে ফিরলে তার ঘামের পোশাক বাতাসে নেড়ে দেয়া, হাতমুখ ধুতে গেলে গামছা এগিয়ে দেয়া, শরবত বা পানি দেয়া ইত্যাদি ইত্যাদি কাজ করে স্বামী সন্তান নিয়ে সন্ধ্যায় চা নাস্তা করবেন। তারপর বাচ্চাকে পড়তে বসানো। বিকালে তোলা শুকনো কাপড় ভাজ করা গোছানো। পরদিন স্বামী কোন পোশাক পরবে তা গোছানো, রাতের খাবার গরম করে সবাই খেয়ে, গোছগাছ করে, বাচ্চাকে ঘুম পারানো। একরাশ ক্লান্তি নিয়ে রাতে স্বামীর সাথে বিছানার ভালোবাসা শেষে দুইজন দুইদিকে ফিরে ঘুমাবে।

তাছাড়া স্ত্রীর আরও দায়িত্ব আছে। সপ্তাহে বা মাসে সমস্ত বাজার করা। সেগুলো নিজ হাতে গোছানো। মাছ মাংস এনে সেগুলো কুটে ধুয়ে ফ্রিজে রাখা। বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানির বিল দেয়া। গিফট কেনা, আত্মীয়স্বজনের সাথে যোগাযোগ রাখা। কাপড় কাচা, লন্ড্রিতে দেয়া, সেগুলো আবার আনা। বাসা, টয়লেট, রান্নাঘর মানে সমস্ত কিছু কয়েকদিন পরপর ভালো করে পরিষ্কার করা। বাচ্চার স্কুলে ডাকলে সেখানে যাওয়া। গেস্ট আসলে ভালোমত আদর আপ্যায়ন করা, রেঁধে বেড়ে খাওয়ানো, গল্প করা। আরও হাজার হাজার কাজ। সব কিছু করে যদি কোন স্ত্রী সময় বের করতে পারেন তাহলেই নিজের জন্য সময় পাবেন। এত এত কাজ করার জন্য যদি আপনার সাহায্যের প্রয়োজন হয় তাহলে আপনি সাহায্যকারী রাখতে পারেন। আর যদি আপনার মেয়ে বাচ্চা হয় তাহলে সাহায্য পাবেন, নয়তো না। ছেলে বাচ্চা হলে তো কাজ করাবেন না। কারণ ‘ছেলেরা কাজ পারে না’।

তো সব কিছু ঠিকভাবে করে হওয়া যায় লক্ষ্মী বৌ আর নিজেকে তখন সুখি মনে হয়। মাঝে মধ্যে স্বামী বাইরে খেতে নিয়ে যাবে, ঘুরতে নিয়ে যাবে, মাঝে মধ্যে একবেলা রান্না করবে। স্বামী টাকা দেবে, তা দিয়ে নিজে গিয়ে কেনাকাটা করে আনবেন। নিজের জন্য কিনবেন স্বামীর পছন্দসই পোশাক। স্বামী সবার সাথে গল্প করবেন, “আমার বৌ দশভুজা। একাই সংসারে সমস্ত কাজ করে, আমার অনেক যত্ন করে, রান্নার কথা আর কি বলবো? এমন রান্না তো পাঁচতারকা হোটেলেও পাওয়া যাবে না।” এত প্রশংসার পরে খুশিতে আটখানা হয়ে নিজেকে স্বর্গের বাসিন্দা মনে করেন স্ত্রীরা। তবে হ্যাঁ, এত কিছুর পরেও পান থেকে চুন খসলে দোষ কিন্তু স্ত্রীর।

স্বামী খুব স্বাভাবিকভাবেই নিজে যে অকর্মা সেটা বলেন। যাদের বলেন তারা এমন কথা শুনে মোটেই আশ্চর্য হন না কেননা তারাও একইভাবে চলেন।

কিন্তু এটা কি আদৌ সুখের সংসার? সংসারের সমস্ত দায়িত্ব কি শুধুই নারীর? পরিবারের সকল সদস্যের নিজের কাজ নিজে করাসহ অন্যান্য কাজও মিলেমিশে করা উচিত। স্বামী কিছু পারেনা, সে আগে কখনো করেনি, আদরের সন্তান- এসব দোহাই হাস্যকর। মেয়েরাও বাবা মা’র আদরের থাকে। তারাও মা বাবার বাড়িতে সংসারে যাবতীয় কাজ করে না যা নিজের সংসারে করে। তাহলে একজন মেয়ে বিয়ের পর অন্য একটা পরিবেশে এসে নিজ কাঁধে এত কাজ, দায়িত্ব কিভাবে নেয় ভেবেছেন কখনো? আর বাচ্চাদেরও ছোট থেকেই হাতে হাতে কাজ করা শিখানো উচিত। সে ছেলে বাচ্চা হোক আর মেয়ে বাচ্চা হোক। সব কাজ সবার।

রান্না, ঘর গোছানোর কাজ, বাচ্চা লালনপালন মেয়েদের কাজ আর আয় রোজগারের কাজ ছেলেদের এবং মেয়েরা ঘরের বাইরে কাজ করলেও তার কাজটা ঠিকভাবে করার জন্য লড়াই করতে হবে, প্রথমে স্বামী সন্তান সামলে পরে নিজের কাজ কন্টিনিউ করতে হবে- এসব অত্যন্ত বাজে ধারণা। কিন্তু আজও এভাবে চলছে অনেক সংসার। এভাবে চলার পরেও সেই স্ত্রী নিজেকে সুখি দাবি করেন। নিজেকে স্বর্গের বাসিন্দা দাবি করেন। তার স্বামীকে কেয়ারিং স্বামী বলেন। এটা পরিবর্তন না করলে আমাদের পরের প্রজন্মও আমাদের কাছ থেকে এই নিকৃষ্ট ধারনা নিয়ে বড় হবে।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]