May 16, 2024
সাহিত্যফিচার ৩স্যাটায়ার

রূপের আলোয় জীবনের কাঞ্চনজঙ্ঘা

মাসকাওয়াথ আহসান।। জাগো নিউজ ওয়েব পোর্টালে একটি খবর পড়ে ধড়মড় করে জেগে উঠলাম। কাফি নামে এক তরুণ তার স্ত্রীর রূপের আলোয় বিসিএস গাইড বই পড়ে বিসিএস শোবিজের প্রশাসন বিভাগে অস্কার পুরস্কার পেয়েছে।

ছোট বেলায় আব্বা গল্প করেছিলেন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ল্যাম্পপোস্টের নীচে বসে পড়ে বিদ্যাসাগর হয়েছিলেন। সেই গল্প শুনে ল্যাম্পের আলোয় পড়াশুনা করে; জীবনে কিছুই করতে পারলাম না। তাই ‘‘সফল মানুষদের হিংসা’’ করে জীবনটা কাটিয়ে দিলাম। আমার ফেসবুক পোস্ট মানেই হিংসার ঝর্ণাধারা। খুব অনুতাপ হয়। কী করলাম এইটা! যাদেরকে হিংসা করি, তারা তাদের জীবনে সাফল্যের যে এভারেস্ট জয় করেছেন; তা কি ক’রে দেখানোর সামর্থ্য আছে আমার? উত্তর হলো- নাই। সামান্য কেওক্রাডং পাহাড় জয়ের সামর্থ্য নাই; আমরা যাই এভারেস্ট বিজয়ীদের সমালোচনা করতে। হিংসারে ভাই হিংসা।

যারা ল্যাম্পের আলোয় পড়ালেখা করেছেন; তাদের জীবন বিদ্যাসাগরের মতো ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু প্রেমিকা কিংবা স্ত্রীর রূপের আলোয় পড়েছেন যারা; তারা সফল হয়েছেন; এটা চারপাশে তাকালে বুঝতে পারি।

আব্বা আজ বেঁচে নেই; বেঁচে থাকলে উনাকে বলতে পারতাম, কাফির এই স্ত্রীর রূপের আলোয় পড়ে সাফল্যের মাকামে মাহমুদে পৌঁছে যাওয়ার মোটিভেশনাল গল্পটি।

শুধু কাফিই নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসুর ভিপি নূরের সাফল্যের ক্ষেত্রেও তার স্ত্রীর নূরের সম্পর্ক আছে। এই ছেলেটি ক্ষমতাসীন দলের হেলমেট ব্যান্ডের শিল্পীদের হেভিমেটাল গানের মাতমে বার বার আহত হয়েছে; হাসপাতালে তার স্ত্রীকে দেখেছি গভীর ধৈর্য্য আর অনুরাগ নিয়ে পাশে বসে আছে। এতোটুকু বিরক্তি নেই তার মাঝে। সে যেন মাইকেল মধুসূদন দত্তের প্রেমিকা হেনরিয়েটার মতোই; যিনি আলীপুর দাতব্য হাসপাতালে রাতের পর রাত জেগে অসুস্থ কবিকে জীবনের আলোয় ফেরাতে চেয়েছিলেন।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে টিএসসিতে ল্যাম্পপোস্টের আলোয় বসে একবার বন্ধুদের সঙ্গে সম্মিলিত হা-হুতাশ জোটের আড্ডা দিচ্ছিলাম। এমন সময় চনমনে এক তরুণ আসে; অত্যন্ত প্রাণবন্ত। ফিজিক্সের ফার্স্ট বয়; পদার্থবিজ্ঞানে এমন মেধাবী যুবক কম পড়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে। বেশিরভাগ পদার্থবিজ্ঞানীই বুয়েটে ছুটে গিয়ে অপদার্থ হয়ে ওঠার ফ্যাশনেবল কাল সেটা।

তরুণ পদার্থবিজ্ঞানী ফিরে যাবার পর আমাদের এক বন্ধু বললো, ছেলেটি বিয়ে করে স্ত্রীকে নিয়ে স্টুডিও এপার্টমেন্টে থাকে। ওর মা ও শাশুড়ি টিফিন বাটিতে করে সেখানে খাবার পাঠান। আর ছেলেটি রূপের আলোয় শুধু পড়ে আর পড়ে।

আভাগার্দ তরুণেরা যখন ‘‘কে তুমি তন্দ্রাহরণী” গেয়ে লিটনের এপার্টমেন্ট হন্যে হয়ে খুঁজে লেখাপড়ার লালবাতি জ্বালিয়ে দিয়েছে; আমাদের পদার্থবিজ্ঞানী বন্ধুটি তখন স্ত্রীর রূপের আলোয় মাধ্যাকর্ষণের থিওরি পড়ে স্ত্রীর রূপাকর্ষণে নিশ্চিত ফার্স্ট ফ্লাস ফার্স্ট হতে চলেছে।

এ সময় চারুকলা ইনস্টিটিউটে গিয়ে দেখতাম, আমার এক শৈশবের বন্ধু স্ত্রীর রূপের আলোয় বসে ছবি আঁকছে; কী যে নিষ্পাপ হাসি তার স্ত্রীর ঠোঁটে লেগে থাকে। কিছুকাল আগে স্কাইপে তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে দেখি; ওরা দুজনেই একটা স্টুডিও করেছে। বন্ধুর স্ত্রীর নিষ্পাপ হাসিটি এখনো মোনালিসার মিস্টিক হাসি হয়ে রয়ে গেছে। কে বলে “বিশশতকের মহাপ্রয়ানে; স্মরণযোগ্য ইহজাগতিক প্রেম নেই।”

আমার আব্বা থেকে বিদ্যাসাগর হয়ে; আমি তখন কিছুটা বিশ্বসাহিত্যকেন্দ্রসাগরের পাল্লায় পড়েছি। উনি দেখা হলেই, আলোকিত মানুষের কথা বলেন; গ্রন্থের আলোয় নাকি মানুষ আলোকিত হয়। আবার একটা ভুল ধারণার গোলকধাঁধায় পড়ে গেলাম। বিশ্বসাহিত্য তন্ন তন্ন করে নীলপদ্ম তুলে আনার ঘোরে অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলে দেখি; কেউ কথা রাখেনি।

আমার শৈশবের আরেক বন্ধু তখন প্রেম শেষে বিয়ে করে সুখে-শান্তিতে সংসার করছে। স্ত্রীর রূপের আলোয় পড়ে ও প্রথম প্রজন্মের আইটি উদ্যোক্তা হয়ে পড়েছে। মাঝে মাঝে সুন্দর সাদা একটা মাইক্রোবাস নিয়ে আসে; আমাকে ঘোরায় তাতে; লং ড্রাইভে নিয়ে যায়। ক্যাসেট প্লেয়ারে বাজে, কে তুমি তন্দ্রাহরিণী।

একবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে লং ড্রাইভে গিয়ে দেখা হলো শৈশবের আরেক বন্ধু পদার্থবিজ্ঞানীর সঙ্গে। সেও ফার্স্ট বয়; আর যথারীতি স্ত্রীর রূপের আলোয় পড়ে নিউটনের আপেল গাছের নীচে হাসি হাসি মুখে বসে; রূপাকর্ষণের সঙ্গে মাধ্যাকর্ষণ মিলিয়ে নিয়েছে।

একটা বিষয় উল্লেখ্য যে, আমার বন্ধুদের এই রূপের আলোর জ্যোৎস্নাদায়িনীরা সবাই নিজ নিজ ক্যারিয়ারে অত্যন্ত সফল হয়েছেন। শাবানার মতো হীরের হাসি আর স্ফটিক কান্নার এই নারীরা আইকনিক ও অলরাউন্ডার।

এর পর একদিন ইংরেজি সাহিত্যের পণ্ডিত সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, ইংরেজি বিভাগের বারান্দায় এসে অতর্কিতে হানা দিয়ে বললেন, ক্লাসের বাইরে দাঁড়িয়ে যে শিক্ষিকার নান্দনিক ক্লাস নেয়া দেখছো; উনি বয়সে অনেক বড় তোমার চেয়ে। তুমি বরং উদয়ন স্কুলের দিকে যাও। তোমার সোলমেট নিশ্চয়ই স্কুলে পড়ে। আর সময় পেলে বৃটিশ কাউন্সিলে ঢুকবে; যদি একটু পড়তে ইচ্ছা হয়। এরকম আইকন হলে যা হয়, প্রেমের আলোর মানুষ হওয়া যায়না। প্রেম ছাড়া তাজমহল গড়া যায়না; তাই আজো ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে আছি; ভার্চুয়াল গোলপাতার ছাউনিতে।

তাই ঘুরে ফিরে সেই বইয়ের আলোর গল্প শুনে, হীরা ফেলে কাঁচ তুলে ভিখারি সেজেছি; যে আলো আলেয়া হয়ে রয়ে গেলো। এরপর দৈনিক প্রথম আলো এসে হাতে আলোর ঝান্ডা ধরিয়ে দিয়ে বললো, যা কিছু ভালো তার সঙ্গে প্রথম আলো। এই আলো খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে নৈরাশ্যের অন্ধকারে হাবুডুবু খেলাম। জীবনে কিছু হয়ে না দেখিয়েই স্ত্রীর রূপের আলোয় সফল ব্যক্তিদের সমালোচনা করে পার করে দিলাম জীবনের অর্ধশতক।

সত্যি বলতে কী আব্বার মুখে বিদ্যাসাগরের ল্যাম্পপোস্টের আলোয় পড়ার গল্প, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের মুখে গ্রন্থের আলো, সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের মুখে এসথেটিকসের আলো; মাঝে মাঝে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্যারের মুখে শ্রেণি সংগ্রামের আলোর কথা শুনে; আমার বন্ধুদের স্ত্রীর রূপের আলোয় পড়ে সফল জীবন গড়ার বিজয় গাঁথা কেন যেন কখনো মনোযোগ দিয়ে দেখাই হয়নি। আজ বিসিএস শোবিজের কাফির স্ত্রীর রূপের আলোয় পড়ে সাফল্যের ভূমিধ্বস বিজয় দেখে উপলব্ধি করলাম, আসলে স্ত্রী রূপের আলোই কাফি। অযথা অন্য সব আলোর পিছে অন্ধ উইপোকার মতো হন্যে হয়ে ঘুরে এই জীবনের পাতায় পাতায় যা লেখা সবই ভুল; ভুল সবি ভুল। এসব গ্রন্থের আলো টালো নয়; স্ত্রীর রূপের আলোয় পড়লেই আসলে পৃথিবীকে পড়া হয়ে যায়। কারণ নারী মানেই ধরিত্রী; যা কিছু ভালো; তার সঙ্গে নারীর আলো।