September 20, 2024
অনুবাদসাহিত্যবই নিয়ে আলাপ

পর্ব-১৮: পরিচয় পুনরুদ্ধার এবং ইতিহাসে স্থান পুনর্দখল

শিল্প সমালোচক, লেখক শার্লট মালিন্সের A Little Feminist History of Art বইটি বাংলায় অনুবাদ করছেন বিশিষ্ট অনুবাদক, শিক্ষক জি এইচ হাবীব। বইটির অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হচ্ছে ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে। আজ পড়ুন এর আঠারোতম পর্ব। সব পাঠকের সুবিধার জন্য প্রতি পর্বের শুরুতে বইটির এবং লেখক শার্লট মালিন্সের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দেয়া থাকবে।।

[নারীবাদী শিল্প আন্দোলনের শুরু ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে। পুরুষ প্রাধান্যবিশিষ্ট রঙ্গমঞ্চে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়ার জন্যে সে সময় নারী শিল্পীরা তাঁদের কাজগুলোর জেন্ডারচ্যুতি ঘটাবার সংগ্রামে নামেন। এরপর থেকে সেই আন্দোলন শিল্প জগতে গোটা বিশ্বজুড়ে অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন ক’রে আসছে। ‘নন্দনতাত্ত্বিক ফরমালিযম’ ব’লে অভিহিত যুগের পর সামাজিকভাবে প্রাসঙ্গিক নানান ইস্যুতে কথা বলার জন্য ‘নারীদৃষ্টি’-র সাহায্যে নারী শিল্পীরা বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ ক’রে জেন্ডার, পরিচয় এবং ফর্মের দিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন, সমালোচনা করেছেন সাংস্কৃতিক প্রত্যাশাগুলোকে এবং নারীকে সনাতনী দৈনন্দিন ধারণায় আটকে ফেলার ব্যাপারটিকে। সমাজের দৃষ্টি ঘোরাতে চেয়েছেন সাম্যের জন্যে নারীর সংগ্রাম এবং নারীদেহকে পণ্য হিসেবে দেখবার মানসিকতা ও ক্রিয়াকর্মের দিকে। “অল্প কথায় নারীবাদী শিল্প-ইতিহাস” (A Little Feminist History of Art) নামের ছোট্ট বইটিকে এই আন্দোলনের ফসল হিসেবে জাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু শিল্পকর্মের সংক্ষিপ্ত কিন্তু সারগর্ভ ভূমিকা বলা যেতে পারে। ১৯৬০-এর দশক থেকে বর্তমান কাল অব্দি পঞ্চাশটি অসামান্য কাজ নারীর জীবন ও অভিজ্ঞতাকে তুলে ধরেছে। সেই সঙ্গে, ভিয্যুয়াল সংস্কৃতির ওপর নারীবাদী আদর্শ ও রাজনীতি যে প্রভাব ফেলেছে সেটাও এই কাজগুলো মেলে ধরেছে। “অল্প কথায় নারীবাদী শিল্প-ইতিহাস” নামের এই গ্রন্থটি জেন্ডার বৈষম্য, যৌনতা, গার্হস্থ্য জীবন, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর নারী দেহের মতো বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা বিংশ শতকের সবচাইতে উচ্চাকাঙ্ক্ষী, প্রভাবশালী ও টেকসই শৈল্পিক আন্দোলনগুলোর একটির আনন্দ উদযাপন। 

শার্লট মালিন্স একজন শিল্প সমালোচক, লেখক এবং সম্প্রচারক। তিনি রেচল হোয়াইরিড, সেসিলি ব্রাউন, র‌্যাচেল লামসডেন,  জেনি স্যাভিল, ক্যাথে ডে মনসাউক্স, স্যু অ্যারোস্মিদ, সুজ্যান কুন, স্যুযি হ্যামিলটন এবং পলা রেগোসহ বিভিন্ন নারী শিল্পীকে নিয়ে লেখালেখি করেছেন। তাঁর রচিত ও প্রকাশিত বিভিন্ন গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে “লাইভ্স অভ দ্য গ্রেট আর্টিস্টস” (২০০৮) এবং “র‌্যাচেল হোয়াইহেড” (২০০৭)। তিনি বিবিসি রেডিও ফোর-এর “ফ্রন্ট রো” এবং “স্যাটারডে রিভিউ’’-র নিয়মিত প্রদায়ক]

 

ক্যারি মে উইমস (Carrie Mae Weems)

(জন্ম ১৯৫৩)

ক্যারি মে উইমস-এর আলোকচিত্রভিত্তিক কাজগুলো আফ্রিকী-আমেরিকানরা ঐতিহাসিকভাবে এবং বর্তমানে যেভাবে অন্যায় যৌন পক্ষপাত আর জাতিগত বিদ্বেষজনিত অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে তা খতিয়ে দেখতে চায়।

তাঁর From Here I Saw What Happened and I Cried  সিরিযে কৃষ্ণাঙ্গ নর-নারীর তেত্রিশটি  ঐতিহাসিক আলোকচিত্র রয়েছে। সেগুলোর বেশিরভাগই ১৮৫০ সালে হারভার্ডের বিজ্ঞানী লুইস আগাসিয-এর তোলা প্রাক্তন দাসদের দাগেরোটাইপ ছবি থেকে নেয়া। আগাসিয-এর নাম ইতিহাসের হাত ধরে আমাদের কাছে পৌঁছলেও তিনি যাঁদের তুলেছিলেন তাঁদের নাম পৌঁছোয়নি। প্রথমে ছবিগুলো তোলা হয়েছিল নানান ‘টাইপ’ হিসেবে, একেবারে মুখোমুখি আর পাশ থেকে, অন্যগুলো তাঁদের চাকুরিদাতার  ইউনিফরম প’রে আড়ষ্টভাবে দাঁড়ানো বা নগ্ন অবস্থায়।

প্রতিটি প্রতিচ্ছিবির ওপর উইমস কিছু টেক্সট বসিয়ে দেন। তার একটিতে লেখা: “You became a scientific profile.” আরেকটিতে : “You became playmate to the patriarch.” স্বতন্ত্রভাবে এসব ফিগারের প্রতিনিধিত্ব করার মাধ্যমে উইমস তাদের পরিচয় পুনরুদ্ধারের দিকে খানিকটা এগিয়ে যান। এই কাজটি সম্পর্কে তিনি বলেন, “এখানে তিনটি আখ্যান এক সঙ্গে কাজ করছে। একটা আখ্যান পুরো কাজটি জুড়ে বিস্তৃত [এবং] এখানে এমন কিছু প্রতিচ্ছবি রয়েছে যেগুলো ইতিহাসের খুবই সুনির্দিষ্ট একটি বিকাশকে মেলে ধরে:   মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আলোকিচিত্রভিত্তিক ইতিহাস এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গ ইতিহাস।

 

শিল্পকর্ম পরিচিতি:

From Here I Saw What Happened and I Cried  ১৯৯৫-৬

৩৩টি আলোকচিত্র; কাগজে ডিজিটাল সি-প্রিন্ট এবং কাচে প্রবল বেগে বালু নিক্ষিপ্ত ক’রে লেখা টেক্সট

বিচিত্রমাত্রিক

 

লুবাইনা হিমিদ (Lubaina Himid)

(জন্ম ১৯৫৪)

লুবাইনা হিমিদ এক প্রাকৃতিক শক্তি। তিনি বলেন, “নিজেকে আমি শিল্পী ব’লে মনে করি, কিন্তু সেই সঙ্গে সাংস্কৃতিক অ্যাক্টিভিস্ট ব’লেও ভাবি।” এছাড়াও তিনি একজন লেখক, শিল্প তত্ত্বাবধায়ক (কিউরেটর), অধ্যাপক, ১৯৮০-এর দশকের ব্রিটেনে কৃষ্ণাঙ্গ শিল্প আন্দোলনের একজন পথিকৃত এবং টার্নার পুরস্কারপ্রাপ্ত (২০১৭) প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী।

Freedom and Change  ১৯৮৪ তে নির্মিত; এর একবছর পরে তিনি লন্ডনে অত্যন্ত প্রভাবশালী প্রদর্শনী The Thin Black Lineএর তত্ত্বাবধান করেন। ছবিটায় দেখা যায় দুই কৃষ্ণাঙ্গ নারী একটা গোলাপী ব্যানারের পটভূমিতে ছুটে যাচ্ছেন। তাঁদের বহুবর্ণ পোশাকে বাতাসের ঝাপটা এসে লাগছে, দড়িতে বাঁধা চারটে কুকুর তাঁদের টেনে সামনে নিয়ে যাচ্ছে। পেছনের রঙ করা মাটিতে ঘূর্ণি উঠে তাদের পেছন পেছন বক বক করতে থাকা দুই শ্বেতাঙ্গ পুরুষকে প্রায় গোর দেবার জোগাড় করেছে। এই দুই নারী ইতিহাসে তাঁদের স্থান পুনরুদ্ধার করতে চাইছেন – যে-ইতিহাসে শ্বেতাঙ্গ পুরুষ দীর্ঘকাল আধিপত্য করেছে।

হিমিদের Freedom and Change আসলে পিকাসোর Two Women Running on the Beach (The Race) ১৯২২ শিল্পকর্মটির একটি নতুন সংস্করণ। এখানে মডেলদের গায়ে অন্যরকম জামা চাপিয়ে তাদেরকে ছুট দেয়ানো হয়েছে । হিমিদের বেশিরভাগ কাজ কালোদের পক্ষ হয়ে উপনিবেশের ইতিহাসকে স্থানচ্যুত করার ব্যাপারটি ভিত্তি করে সৃষ্ট। আর তা করতে গিয়ে তিনি হয়ত কখনো উইলো-প্যাটার্নের প্লেট নতুন ক’রে পেইন্ট করেছেন সেখানে দাসদের গল্প ব’লে, আবার কখনো নিজের কণ্ঠের জোর বাড়াতে মডার্নিস্ট পেইন্টিং আত্মীকৃত করেছেন ।

 

শিল্পকর্ম পরিচিতি:

Freedom and Change  ১৯৮৪

প্লাইউড, ফেব্রিক, এক্রিলিক পেইন্ট, এবং অন্যান্য উপাদান

২৯০ X ৫৯০

 

শিল্পপরিচিতি:

“Two Women Running on the Beach (The Race)”, 1922 পাবলো পিকাসো

 

 

(চলবে)

পর্ব-১: শিরীন নিশাত ও যারিনা হাশমি- দ্রোহ আর স্মৃতিকাতরতা

পর্ব-২: মহাজাগতিক সৃজনকারী শক্তি ও নারীর স্বরূপে ফেরা

পর্ব-৩: শিল্পের নতুন বিষয় ও শিল্পীর শরীর

পর্ব-৪: শ্রম বৈষম্য এবং সন্তান পালনের দলিল

পর্ব-৫: নারীর প্রতীকী ইতিহাস এবং শিল্পকর্ম হিসেবে দেহ

পর্ব-৬: দেহ ভাস্কর্য ও চিরন্তন মাতৃসত্তার বিরুদ্ধচিত্র

পর্ব-৭: গার্হস্থ্য জীবন আর অন-স্ক্রীন নারীত্বের স্বরূপ উন্মোচন

পর্ব-৮: দেহাস্ত্র এবং অনিরপেক্ষ প্রতিচ্ছবি

পর্ব-৯: বোধ স্বতন্ত্র এবং ফিউশন অস্বস্তিকর

পর্ব-১০ নির্যাতন নিরন্তর ও পিতৃতান্ত্রিক বিশ্বে নারী হওয়ার জটিলতা

পর্ব-১১: ব্যক্তিগত ক্ষমতায়ন এবং কৃষ্ণাঙ্গ নারী সমকামীর অভিজ্ঞতা

পর্ব-১২: পেশল বাস্তবতা আর পূর্বকল্পিত জেন্ডার বিষয়ক মতামত

পর্ব-১৩: সঙ্গীতের মহাফেজখানা আর ঐতিহাসিক পেইন্টিং-এর ভিন্ন বয়ান

পর্ব-১৪: সাদা কার্ড বাদামি কার্ড আর নারীর চোখে নারী

পর্ব-১৫: দৈনন্দিনের একঘেয়েমি আর শিল্পে গেরিলাযুদ্ধ

পর্ব-১৬: আশ্রয়স্থল কিংবা কারাগার আর ফিমেল আর্টের অনুসন্ধান

পর্ব-১৭: নারীর দেহভাষা আর পুরুষের প্রত্যাশার বিরুদ্ধাচারণ