November 2, 2024
মুক্তমত

নারীর প্রতি সহিংসতা: আনুষ্ঠানিকতা, আন্তরিকতা ও আমাদের মনোযোগ

উম্মে সালমা।। মহামারী, বেকারত্ব, হতাশা, জীবন-জীবিকার সংকট, খাদ্য নিরাপত্তা, দুর্নীতি, সামাজিক নিষ্ঠুরতা, বিচারহীনতা, অসহিষ্ণুতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি ইত্যাদি নানা বিপর্যয়ের ভার নিয়ে আমরা এক ভয়াবহ সময়ে উপনীত হয়েছি। গোটা বিশ্ব জুড়েই এই দূর্যোগের দুঃসময়েও নীতি নৈতিকতা, মানবিক মূল্যবোধ ভুলে নারীর প্রতি সহিংসতার ক্রমবর্ধমান সংকট রোজ দেখতে পাচ্ছি। পরিসংখ্যান আর নাই বা দিলাম।

একের পর এক নতুন সহিংসতার ঘটনা পুরাতন ঘটনাকে ঢেকে দিয়ে যাচ্ছে। কিছু কিছু আলোচিত ঘটনায় প্রশাসনের সাথে সাথে সোচ্চার হচ্ছে নাগরিক সুশীল সমাজও। কিন্তু কিছুতেই যেন এসব কমবার নয়, বরং বাড়ছে।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় প্রতিবাদ হচ্ছেনা, মিডিয়ায় আসছেনা, আলোচনায় নেই। কেউ সাহসী হয়ে মুখ খুললেও দ্বিতীয়বারও সহিংসতার শিকার হবার নজির বিরল নয়। নারীর যৌনাঙ্গে আক্রমনের মূলে পুরুষের পক্ষে অস্ত্র এবং নারীর পক্ষে ভীতি হিসেবে কাজ করে অপবিত্রতা, অশুচিতার কল্পিত বোধ যা আসলে নারীর সমস্ত সত্তা, মেধা মনন, কর্ম, সৃজনকে একদাগে বাতিল করে দিয়ে নারীকে কেবলই একটি যৌনাঙ্গ, পণ্য এবং ভোগের বস্তু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

ভাবা যাক একজন নারী সহিংসতার শিকার হলে তার কী কী ধরণের সহায়তার প্রয়োজন পড়ে। সহিংসতার ধরণ অনুযায়ী শারীরিক ও মানসিক চিকিৎসা সহায়তা, পুনর্বার সহিংসতা থেকে নিরাপত্তা, আইনী সহায়তা, নিজের কমিউনিটিতে শারীরিক এবং মানসিকভাবে নিরাপদে থাকার ব্যবস্থা ইত্যাদি। মোদ্দা কথা সহিংসতার শিকার একজন নারীর ভেতর ‘তিনি একা কিংবা অসহায় নন’ এই বোধ জাগ্রত করা জরুরি।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নারীর প্রতি সহিংসতায় যৌন নিপীড়ন, মানসিক নিপীড়ন, অপহরণ, গুম, ধর্ষণের চেষ্টা, ধর্ষণ, পারিবারিক সহিংসতা ইত্যাদি এমন শতশত ধরণের অবতারণা করা যায়। যুগের পর যুগ ধরে নারীর শরীর, প্রজননতন্ত্রবিষয়ক সমাজগঠিত কিছু ট্যাবু নারীকে ‘বাজে দৃষ্টি’ থেকে আড়ালে রাখবার ব্যবস্থায় গোটা জীবনযাপনকে নাজুক করে রেখেছে। নিপীড়নের যে কোনো ক্ষেত্রেই নিপীড়ক নারীকে নিজের অধস্তন ভাববার মানসিকতা থেকেই নিপীড়ন করে থাকেন এই বিশ্বাসে যে ‘নারীর শরীর’ এর সাথে সম্ভ্রম, সম্মান ইত্যাদি ওতপ্রোতভাবে জড়িত আর তাই শরীরে আক্রমন করলেই একজন নারীর সামাজিক মর্যাদাকে ধূলিসাৎ করে দেয়া যায়; নিপীড়কের এই নিশ্চিত নিরাপত্তাবোধ সমাজ তাকে দেয়। পারস্পরিক সম্মানবোধের চর্চার অভাব বোধ করি এই মানসিকতা গড়নের প্রাথমিক রসদ হিসেবে কাজ করে যার মধ্যে দিয়ে সময়ের পরিক্রমায় নিপীড়ন করে নারীকে ‘শিক্ষা দেয়া’র মনোভাব পাকাপোক্ত হয়।

মার্জনা করবেন, (কিছু ঘটনার বিচার, প্রতিবাদে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সোচ্চার থাকার সুবাদে) সহিংসতার ঘটনায় নাগরিক বা সুশীল সমাজের কার্যক্রমের বিষয়ে কিছু আমার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরতে চাই।

সামাজিক মাধ্যমের যুগ, প্রথমতই তাই এমন কোনো ঘটনা গোচরে এলে আমরা ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস পোস্ট করি। এরপর সারভাইভরকে দেখতে যাওয়া, লিগ্যাল সাপোর্টের ব্যবস্থা করা (ক্ষেত্রবিশেষে), সম্ভব হলে চিকিৎসার প্রয়োজনে আর্থিক সাহায্য, মানববন্ধন, স্মারকলিপি ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে আমরা সহিংসতার শিকার নারীর পাশে থাকার চেষ্টা করি। নিঃসন্দেহে এই তৎপরতা প্রশংসার দাবিদার এবং নিপীড়ককে আইনের আওতায় আনতে কার্যকরও বটে।

জেনে থাকবেন, উপকূলীয় অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়ের সিগন্যাল হলে মাইকিং করে দেয়া হয় নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যাবার জন্য, শুকনো খাবার এর ব্যবস্থা করে রাখবার জন্য যেন আমরা ক্ষতি প্রশমন করতে পারি। এগুলো প্রস্তুতি। ঝড় যদি নিতান্তই এসে যায়, তার পরেই আসে দূর্যোগ পরবর্তী পুনুরুদ্ধার কার্যক্রম।

আত্মসমালোচনায় আসি।

একটু মাথা খাটালেই দেখা যায়, সহিংসতা নিরসনের উদ্দেশ্যে আমরা যে পথে এগোচ্ছি, তাতে পূর্বপ্রস্তুতি বা শুকনা খাবার সঞ্চয়ের পরিকল্পনা নেই। ঝড় এসে সব লন্ডভন্ড করে দেয়ার পরবরতী পরিকল্পনাগুলোই কেবল আমরা আওড়ে যাচ্ছি। প্রাকৃতিক দূর্যোগ আমাদের নিয়ন্ত্রনের বাইরে। কিন্তু মনুষ্যসৃষ্ট এইসব দূর্যোগের পেছনে মূল মানসিকতা বদলে দিতে আমাদের কার্যকর কাজ নেই। যতগুলো ঘটনায় আমরা ভিক্টিমকে সহায়তা করার চেষ্টা করেছি, সেই মূল ঘটনার বিবরণ, মামলা হয়ে থাকলে তার বর্তমান অবস্থা, কমিউনিটিতে তার অবস্থান বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো হালনাগাদ তথ্যভাণ্ডার নেই, এই ঘটনাগুলোর ফলো আপ নেই। সাথে সাথে সহিংসতা নিরসন বক্তৃতায় আমরা ‘নারীরা কারো মা কারোর বোন’ ইত্যাদি রক্তের সম্পর্কের কথা তুলে সহজ মোটিভেশন দেয়ার চেষ্টা চালাই যা মানুষের প্রতি মানুষের মানবিক সহজাত সম্মানে বিশেষ কোনো ভ্যালু অ্যাড করেনা।

সহিংসতা পরবর্তী সময় কেন্দ্রিক পরিকল্পনার কথা-ও যদি বলি, অধিকাংশ মানুষ জানেন না সহিংসতা পরবর্তী পদক্ষেপ কী হওয়া উচিত, আইনের সহায়তা আসার আগ পর্যন্ত কিভাবে প্রমাণ বা আলামত সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হয়- এই তথ্যগুলোর প্রচার নিয়ে তেমন কাজ নেই।  নারীর অধিকার  নিয়ে কাজ করবেন এমন পুরুষ কাওকে আমরা সক্রিয় করে তুলতে পারিনি, নারীর বিষয়টি কেবলই ‘নারী’র থেকে গেছে। এটাও আসলে দীর্ঘসময় ধরে পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতা চর্চার ফসল যা সমাজ নির্মিত অদৃশ্য গণ্ডী থেকে বের হওয়া বা না হওয়া উভয় নারীদেরই সহিংসতার কবলে ফেলে, এই নির্মান পুরুষের অশোভন আচরণকে বৈধতা দেয় নারীর শরীরকে নাজুকতায় দাঁড় করিয়ে, আর এই কাঠামো অনুসারেই সহিংসতা পরবর্তী পদক্ষেপগুলো গৃহীত হয় এই বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠিত করে যে, নারী সহিংসতার শিকার ‘হবেই’। তাই সহিংসতা যেন না হয় সেই মানসিকতা তৈরিতে মন না দিয়ে আমাদের পূর্ণ মনোযোগসহিংসতা পরবর্তী কার্যক্রমে।

বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী। এতো বিশাল জনগোষ্ঠী হয়েও কেন এই সমস্যা থেকে উত্তরনের উপায় বের হচ্ছে না? আমাদের প্রশাসন, আইন, নাগরিক পদক্ষেপ ফলপ্রসূ হচ্ছে না কেন?

নারীর অধিকার রক্ষায় পুরুষের নের্তৃত্ব হাতেগোনা তো বটেই, নারীর সমস্যাটাকে খোদ নারীরাই কতোটা গুরুত্বের সাথে ভাবছি? একটি জাতি গোষ্ঠী নয়, যদি একজন ব্যক্তি নারীর সাথে আরেকজন ব্যক্তি নারীর সম্পর্ক খতিয়ে দেখি তবে তা বাস্তবিকভাবে কতখানি ভরসার, কতখানি নিরাপদ? পোশাকের দোষ, চলাফেরায় সমস্যা, রাত করে বাড়ি ফেরে, ছেলে বন্ধু রয়েছে ইত্যাদি মুখরোচক আলাপের সূত্রপাত হয় আমাদেরই পরিচিত খুব কাছেরই কোনো আত্মীয়ার গলা দিয়ে এবং তা বেতারের গতিতে এক কান থেকে অন্য কানে রঙ চড়িয়ে ছড়িয়েও পড়ে। অন্ত্যন্ত ভঙ্গুর, বিধ্বস্ত, মৃতদেহসম মুখাবয়ব নিয়ে সমাজ দ্বারা নির্ধারিত ‘স্ট্যান্ডার্ড ভিক্টিম’ এর মানদণ্ডে উঁচু স্কোর না হলে সেই নিপীড়নকে ‘লঘু’ বলে ফোড়ন কেটে ভাগাড়ে ফেলা হয়। অভিজ্ঞতা থেকে বলি, নারী দিবসে শহীদ মিনারের বেদীতে দাঁড়িয়ে আমরা যে নারীরা সহিংসতা নিরসনে কাজ করার শপথ নেই, ‘অন্ধকারে দু’চোখ আলোয় ভ’রে’ দিতে মোমবাতি প্রজ্জলন করি; কে ডিপ ছাঁট ব্লাউজ পরলো, কে হা-হা স্বরে হাসলো, কার পোশাক অশ্লীল- এইসব কল্পিত সব জটিল সমস্যা নিয়ে শহীদের বেদীতে বসেই আমরাই মাথা ঘামাই। মঞ্চে অধিকারের গান গেয়ে এসে ঘরে বসে আয়েশে আচার খেতে খেতে বিবিধ নারীদের রগরগে বর্ণনা আমরা নারীরাও কম দেই না। ‘ভাবী জানেন?’ টার্মটি আমাদের জীবনের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত।

সে যা-ই হোক, নিপীড়ন, বদ-কথার চর্চা সব পেরিয়ে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে আমাদের করনীয় বিষয়ে নতুন করে ভাবনার সূত্রপাত হতে পারে প্রচলিত ভুল বিশ্বাসকে কেন্দ্রে রেখে। পারিবারিক শিক্ষা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক সম্মানবোধের চর্চা দেখে বেড়ে ওঠা শিশু মানুষকে মানুষের সম্মান দিতে শেখে। এই প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের দুনিয়ায় যেখানে ‘badass’ হওয়াটা উঠতি টিনেজারদের জন্য স্মার্টনেস, সেখানে তাদের মধ্যে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও চর্চা গড়ে তোলার জন্য শিক্ষকরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। কিছু টুলকিট, সহায়িকা বই, সপ্তাহে অন্তত একদিন উন্মুক্ত আলোচনা, ক্যাম্পিং বা সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এই চর্চার বিকাশ হতে পারে। একজন নারী ধর্ষণ, অপহরণের মতো সহিংসতার শিকার হলে তার সামাজিক মর্যাদাহানি হয় না, অপরাধটি আসলে সম্ভ্রম সম্পর্কিত নয় বরং জবরদস্তি এবং অসম্মতি বিষয়ক লিঙ্গ সহিংসতা। এই সমাজে যে সহিংসতার শিকার, এই সমাজ, আইন তাকেই বিচারে রাখে, তার অতীত, ব্যক্তিগত জীবন, জীবনযাপনের ধরণকে ব্যবচ্ছেদ করে সহিংসতাকে বৈধতা দিতে চায়।

আমরা অধিকার-সংবেদনশীল যে গোষ্ঠীটি বলছি চুপ থাকবেন না, কথা বলুন, সে গোষ্ঠী নারীকে চিরাচরিত ‘অপবিত্রতা, সম্ভ্রমহানি’র অনুভূতি থেকে মুক্তি দিতে, এই প্রপঞ্চ ভাঙার জন্য কোনো পদক্ষেপ আমাদের পরিকল্পনার অন্তর্ভূক্ত রাখছি কিনা? নারীর প্রতি সহিংসতায় লঘু গুরু নেই। অপমানিত হবার অনুভূতি সবার জন্য এক। একেবারে শেকড় থেকে কমিউনিটিভিত্তিক এই সচেতনতা বৃদ্ধিতে মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন।

নারীর প্রতি সহিংসতা অন্য অপরাধ থেকে এটা আলাদা এই দিক দিয়ে যে এটি লিঙ্গ বৈষম্যভিত্তিক সহিংসতা। হুট করে পয়সার বিনিময়ে হত্যা বা ছিনতাইয়ের মতো অকস্মাৎ নয় বরং বহু আগে থেকে ধীরে ধীরে এর ভিত তৈরি হয়েছে। আরো ভয়ংকর বিষয় হচ্ছে যে এসব ঘটনা আমাদের জীবনযাপনে স্বাভাবিক হয়ে উঠছে। তাই কেবল নিপীড়ককে কেবল আইনের আওতায় আনার মাধ্যমেই সমাজ থেকে এই অপরাধ দূর করা কতখানি সম্ভব। আসুন প্রতিবাদ করার উৎসাহ দেয়া আর গোড়ায় কাজ না করার এই প্যারাডক্স ভাঙ্গি।

নারী হই বা পুরুষ হই, ভিক্টিম ব্লেইমিং না করে, ব্যক্তিগত সংকীর্ণতা, গসিপ আর সহিংসতাকেন্দ্রিক পরিকল্পনা ছাড়িয়ে সংবেদনশীল হই, সহানুভূতিশীল হই, খুব শেকড়ে নজর দেই; আমরা নারীর প্রতি সকল সহিংসতা নিরসনে স্বকীয় ব্যক্তিত্বে জাগ্রত হই।

 

উম্মে সালমা: নীতি-অধিপরামর্শ বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব মতামত]