November 1, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

সবদিকে ঠকে যাওয়ার নামই নারী, মুক্তি নারীবাদেই

আমিনা সুলতানা সানজানা ।। নারীবাদ ধারণাটি আজকের নতুন নয়। আঠারো শতকের প্রথম দিকেই নারীবাদ ধারণার শুরু বলা যায়, কিংবা তারো আগে, আনুষ্ঠানিকভাবে তখন এই শব্দের ব্যবহার হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। নারীমুক্তি, নারীর ভোটাধিকার, কর্মক্ষেত্রে নারীর অধিকার মূলত এসব বিষয় ছিল নারীবাদ আন্দোলনের মূলে।

১৯১২ সালে নিউইয়র্কের রাস্তায় নারীদের আন্দোলন করতে দেখা যায় ভোটাধিকারের জন্য। অতএব ব্যাপারটা পরিষ্কার নারীবাদী চিন্তার সৃষ্টি হয়েছে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য।

আজকে আমরা আনন্দমুখর পরিবেশে বিশ্বের সব জায়গায় নারী পুরুষ সমানে ভোট দিতে যান, কিন্তু এ বিষয়টা সহজ ছিল না সব সময়। ভোট দেওয়া যে নারীরও একটি অধিকার সেটি প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছে নারীকে আন্দোলনের মধ্যদিয়ে। আজো কিছু দেশে নারীদের ভোট দেওয়া এখনও নিশ্চিত নয়।

আজকে বাংলাদেশে অনেক জায়গাতেই নারীরা স্বাচ্ছন্দে চাকরির জন্য আবেদন করতে পারেন। কিন্তু আপনি জানেন কি একটা সময় নারীদের এই চাকরির জন্য আবেদন করাও সহজ ছিল না! সহজ ছিল না ন্যায্য বেতন পাওয়া। খুব বেশি দিন হয়নি মজুরিভিত্তিক কাজে নারীরা সমান মজুরি পেয়ে থাকেন এখন। তাও সময়-সুযোগমতো ঠকে যাচ্ছে। সব সময় পাওয়া যায় না নারীর ন্যায্য মজুরি। শুধু কি তাই, কর্ম ক্ষেত্রে সব জায়গাতেই এখনো মেয়েরা ডমিনেটেড হয় পুরুষ কর্মী দ্বারা। যৌন হয়রানির কথা আর নাই বা বললাম।

পেশা পছন্দ করার ক্ষেত্রে প্রায়ই শুনে থাকবেন বাড়ির বাবা, ভাই, স্বামী নারীকে তার সিদ্ধান্ত দিয়ে দেয়। সব পেশা নাকি নারীর জন্য না।

যেখানে চাঁদ থেকে হিমালয় জয় করা সব করে দেখিয়েছে নারী। পদে পদে তাকে প্রমাণ করতে হয়েছে আমিও পারি। ঘর সামলেছে নারী, সামলেছে সন্তান, সামলেছে কর্মক্ষেত্র। বড় বড় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে নিজেকে বারবার প্রমাণ করা সত্ত্বেও দিনশেষে শুনতে হয়েছে সে তো একটি নারী। তারপরেও নারী বসে থাকেনি এগিয়ে গেছে তার  স্বমহিমায়।

আমরা নারীবাদকে খারাপ বলতে পিছু হটি না কারণ নারীবাদীরা নারীর অধিকার নিয়ে কথা বলে। এখানে এক শ্রেণি নারীবাদ, পুরুষতন্ত্র, মানববাদ সব গুলিয়ে ফেলেন। মাঝে মাঝে বলতে শুনি কেন শুধু নারীদের নিয়ে কথা বলতে হবে আপনারা সবাইকে নিয়ে বলুন!

তখন আমার মনে হয় এতো বিষয় থাকতে ইংরেজি আর অংক নিয়ে কেন আপনারা এত মেতে থাকেন? কারণ এ দুটোতে বেশিরভাগ ছাত্র ছাত্রী খারাপ করে। এ দুটি বিষয়ে আমাদের সন্তানেরা যেন পিছিয়ে না পড়ে তাই আমরা বেশি জোর দেই ইংরেজি এবং অংক শেখাতে। ঠিক তেমনি করে পিছিয়ে পড়া নারী জাতিদের সামনে এগিয়ে নিয়ে আসতেই নারীবাদী ধারণার জন্ম। একটি সমাজের একটি বড় অংশ নারী এবং তারা যদি ভোট দিতে না পারতেন তবে বিশাল একটি অংশের মতামত জানা যেত না। সেই ভোটাধিকার আনতে নারীদেরই আন্দোলন করতে হয়েছে। বেতনে মজুরিতে পুরুষের সাথে সমান কাজ করেও যখন সমান মজুরি পেতেন না তখন সেই মজুরি ও বেতন আদায় করতে নারীবাদীরা নারীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। শিক্ষায় চাকরিতে সংসারে নারীদের প্রমাণ করতে হয়েছে তারাও পুরুষের থেকে কম নয়। প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছে নিজের অধিকার।

সমাজে যেসব ক্ষেত্রে পুরুষ অগ্রাধিকার পেয়ে থাকে, সেসব ক্ষেত্রে নারীদের এগিয়ে আনতে সাহায্য করেছে নারীবাদ। অন্যায় নিপীড়ন পুরুষের সাথেও হয়। দলীয়করণ, হত্যা-গুম চলছে পুরুষের সাথে। আমরা চাই সেখানে সঠিক বিচার হোক ঠিক যেমনভাবে চাই অন্যায়ভাবে নারীর ওপর যেসব অত্যাচার হয়ে আসছে, বিশেষ করে ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন যেখানে বাদ পড়েনি ৬ মাসের শিশুও।

মজার ব্যাপার হচ্ছে এসবের অধিকার খুঁজতে গেলে অনেক সময় পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পুরুষতন্ত্র দিয়ে আবৃত নারীরাও নারীদের ভৎসনা করতে কম যান না। নারীদের শুধু পুরুষের এই পুরুষতান্ত্রিক চিন্তার বিরুদ্ধে লড়তে হয় না, লড়তে হয় আপনজনদের সাথেও।

হাজারো কষ্টের ভিড়ে মুখ বুঝে সহ্য করতে হয় পারিবারিক নির্যাতন। চুপচাপ স্বামীর অত্যাচার সহ্য করে সংসার করে যাওয়া নারীকে আমরা বলি অনেক ভালো মহিলা। যে নারী স্বামীর অত্যাচারের বিরুদ্ধে কথা তুলে তাকে আমরা মানিয়ে নিতে বলি সন্তানের জন্য। যেন সন্তানের দায়িত্ব একা নারীর। কেউ ছাড় দেয় না সেই নারীকে। নিজের বাবা মা দেয় না, সেখানে সমাজ কোথায় ঠাঁই দেবে?

আমরা নারী পুরুষের সমান অধিকারে বিশ্বাসী। সুন্দর সমাজে নারী ও পুরুষ হবে দুজন দুজনের পরিপূরক। আমরা কখনো অস্বীকার করতে পারিনা পুরুষের অবদান। কিন্তু আমরা এও ভাবতে পারিনা পুরুষ দমন করে রাখবে নারীকে! একটি সাইকেলের যেমন দুটি চাকার প্রয়োজন, নারী-পুরুষ ঠিক দুজন মিলেই এ সংসার সাজায়।

একই সাথে লেখাপড়া করে যখন একটি মেয়ের বিয়ের জন্য তাড়াহুড়া শুরু হয় তখন ছেলেটিকে বলা হয় ভালো চাকরি দেখতে। তবে কি মেয়েদের আমরা লেখাপড়া করাই ভালো বিয়ের জন্য? নিজের চোখে কত দেখলাম শিক্ষিত নারী সংসারের জন্য তার ক্যারিয়ার বাদ দিয়ে শুধু সংসার এবং সন্তান পালন করে গেল। যেকোনো কারণেই হোক মাঝপথে কোনো কারণে যদি সংসারটি ভেঙে যায় ওই শিক্ষিত নারীটি হিমশিম খায় কিভাবে সে বাকিটা জীবন চলবে। কারণ তাকে তো পঙ্গু করে রাখা হয়েছিল এতদিন। বাবা-মা ও তখন মুখ ফিরিয়ে নেয় নতুন কিছু নয়। এখানে নারীবাদ এর প্রশ্নটা চলে আসে। কেন মেয়ে বলে অর্থনৈতিকভাবে তাকে দাঁড়াতে দেয়া হলো না? জীবনের মাঝ সময়ে এসে যখন শারীরিক-মানসিক সবকিছু সংসারের উজাড় করে দিয়ে প্রায় শেষ হয়ে যাওয়া মানুষটাকে আবার নতুন করে জীবন শুরু করতে হয় তখন কত কঠিন হয় সবকিছু, তার সচেতন মানুষ মাত্রই জানা উচিত।

২০২২ সালে এসেও নারীরা অনেক অনেক পিছিয়ে আছে। পিছিয়ে আছে কর্মে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতায়, পিছিয়ে আছে নিরাপত্তায়, পিছিয়ে আছে সম্মানে।

এমনকি আইনগতভাবেও বাংলাদেশের নারীরা অনেক পিছিয়ে আছে। কন্যা সন্তান বাবার সম্পত্তির দুই ভাগের এক ভাগ পায়। মানে যার এক ছেলে এক মেয়ে তার ছেলে যদি দুই ভাগ পায় মেয়ে পায় এক ভাগ। আর যার শুধু কন্যা সন্তান তার বেলা তো আরো অবহেলা। তার সম্পত্তির অর্ধেক পাবে মেয়েরা অর্ধেক পায় সেই ভদ্রলোকের ভাই অথবা ভাইয়ের ছেলেরা।

বাংলাদেশের ইতিহাস বলে ৭২ শতাংশ ক্ষেত্রেই মেয়েরা সম্পত্তি পায় না। চাচা এবং চাচাতো ভাই ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে মেয়েদের বাকি অর্ধেক সম্পত্তিও নিয়ে যায়। আবার ওদিকে স্বামীর সম্পত্তির 8 ভাগের এক ভাগ পায় স্ত্রী। সব থেকে ঠকে যাওয়ার নামই বোধহয় নারী ‌!

যার অধিকার দেয় না স্বয়ং পরিবার এবং রাষ্ট্র, নারীবাদের কাজের জায়গাটা ঠিক সেইখানে। নারীবাদ নারীদের এই অধিকারগুলোর কথাই বলে যায়। হ্যাঁ এটাও মিথ্যা না নারীবাদের এই ধারণার অপব্যবহারও হয়। আচ্ছা বলুন তো, ভালো কাজের অপব্যবহার হয় না এমন কোন জায়গাটা আছে এই পৃথিবীতে?

আমরা চাইনা কোনো কাজেরই অপব্যবহার হোক, অপব্যবহার হোক কোনো আইনের। কিন্তু যেখানে আইনই সাহায্য করছে না সেখানে আপনি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবেন?

নারীবাদী শব্দটাকে অনেকে গালি মনে করেন; হয়তো পুরুষতন্ত্রের আঁতে ঘা লাগে তাই। নারীদের এগিয়ে যাওয়া যারা সহ্য করতে পারেন না, পারেন না নারীদের মতামত নিতে, পারেন না নারীদের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করতে তাদের কাছেই ‘নারীবাদী’ একটি গালি।

সে যাই ভাবুন নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে যুগে যুগে নারীদের এগিয়ে আসতে হয়েছে। বন্ধু হিসেবে খুব অল্প পুরুষই তাদের সাথে হেঁটেছেন। নানা অপমান অবহেলা সহ্য করতে হয়েছে খুব কাছের পুরুষ থেকেই। কখনো সে বাবা কখনো ভাই, স্বামী তো আছেই। এখনো পর্যন্ত নারীদের পক্ষে কথা বলার বিকল্প খুঁজে বের করতে পারে নি।

আমরা তো চাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশ সমাজ পরিবারের উন্নতি। সাথে চাই পুরুষদেরও। পুরুষরাও যেদিন বুঝতে পারবে নারী নয়, মানুষ হিসেবে নারীকে গণ্য করবে, সেদিন হয়তো আর নারীবাদী আন্দোলনের প্রয়োজন হবে না।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *