November 2, 2024
অনুবাদসাহিত্যফিচার ৩বই নিয়ে আলাপ

পর্ব-১৯: সহজাত প্রবৃত্তিভিত্তিক শিল্প আর শিশু ও মাতার ভিন্ন যাত্রা

শিল্প সমালোচক, লেখক শার্লট মালিন্সের A Little Feminist History of Art বইটি বাংলায় অনুবাদ করছেন বিশিষ্ট অনুবাদক, শিক্ষক জি এইচ হাবীব। বইটির অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হচ্ছে ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে। আজ পড়ুন এর উনিশতম পর্ব। সব পাঠকের সুবিধার জন্য প্রতি পর্বের শুরুতে বইটির এবং লেখক শার্লট মালিন্সের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দেয়া থাকবে।।

[নারীবাদী শিল্প আন্দোলনের শুরু ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে। পুরুষ প্রাধান্যবিশিষ্ট রঙ্গমঞ্চে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়ার জন্যে সে সময় নারী শিল্পীরা তাঁদের কাজগুলোর জেন্ডারচ্যুতি ঘটাবার সংগ্রামে নামেন। এরপর থেকে সেই আন্দোলন শিল্প জগতে গোটা বিশ্বজুড়ে অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন ক’রে আসছে। ‘নন্দনতাত্ত্বিক ফরমালিযম’ ব’লে অভিহিত যুগের পর সামাজিকভাবে প্রাসঙ্গিক নানান ইস্যুতে কথা বলার জন্য ‘নারীদৃষ্টি’-র সাহায্যে নারী শিল্পীরা বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ ক’রে জেন্ডার, পরিচয় এবং ফর্মের দিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন, সমালোচনা করেছেন সাংস্কৃতিক প্রত্যাশাগুলোকে এবং নারীকে সনাতনী দৈনন্দিন ধারণায় আটকে ফেলার ব্যাপারটিকে। সমাজের দৃষ্টি ঘোরাতে চেয়েছেন সাম্যের জন্যে নারীর সংগ্রাম এবং নারীদেহকে পণ্য হিসেবে দেখবার মানসিকতা ও ক্রিয়াকর্মের দিকে। “অল্প কথায় নারীবাদী শিল্প-ইতিহাস” (A Little Feminist History of Art) নামের ছোট্ট বইটিকে এই আন্দোলনের ফসল হিসেবে জাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু শিল্পকর্মের সংক্ষিপ্ত কিন্তু সারগর্ভ ভূমিকা বলা যেতে পারে। ১৯৬০-এর দশক থেকে বর্তমান কাল অব্দি পঞ্চাশটি অসামান্য কাজ নারীর জীবন ও অভিজ্ঞতাকে তুলে ধরেছে। সেই সঙ্গে, ভিয্যুয়াল সংস্কৃতির ওপর নারীবাদী আদর্শ ও রাজনীতি যে প্রভাব ফেলেছে সেটাও এই কাজগুলো মেলে ধরেছে। “অল্প কথায় নারীবাদী শিল্প-ইতিহাস” নামের এই গ্রন্থটি জেন্ডার বৈষম্য, যৌনতা, গার্হস্থ্য জীবন, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর নারী দেহের মতো বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা বিংশ শতকের সবচাইতে উচ্চাকাঙ্ক্ষী, প্রভাবশালী ও টেকসই শৈল্পিক আন্দোলনগুলোর একটির আনন্দ উদযাপন। 

শার্লট মালিন্স একজন শিল্প সমালোচক, লেখক এবং সম্প্রচারক। তিনি রেচল হোয়াইরিড, সেসিলি ব্রাউন, র‌্যাচেল লামসডেন,  জেনি স্যাভিল, ক্যাথে ডে মনসাউক্স, স্যু অ্যারোস্মিদ, সুজ্যান কুন, স্যুযি হ্যামিলটন এবং পলা রেগোসহ বিভিন্ন নারী শিল্পীকে নিয়ে লেখালেখি করেছেন। তাঁর রচিত ও প্রকাশিত বিভিন্ন গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে “লাইভ্স অভ দ্য গ্রেট আর্টিস্টস” (২০০৮) এবং “র‌্যাচেল হোয়াইহেড” (২০০৭)। তিনি বিবিসি রেডিও ফোর-এর “ফ্রন্ট রো” এবং “স্যাটারডে রিভিউ’’-র নিয়মিত প্রদায়ক]

 

মারিয়া লাসনিগ (Maria Lassnig)

(১৯১৯-২০১৪)

Do oder Ich (তুমি বা আমি) চিত্রকর্মটিতে একজন ভীত সন্ত্রস্ত নারী ক্যানভাস থেকে সামনের দিকে তাকিয়ে আছেন; তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে যেন একটা চেয়ারের ওপর ধপ ক’রে বসে পড়া অবস্থায় আছেন তিনি। তাঁর নীল-সবুজ চোখ দুটো বিস্ফারিত; তিনি নগ্ন, নিজের মাথায় একটি পিস্তল ধরে আছেন। তাঁর আরেক হাতেও একটি পিস্তল রয়েছে; সেটি তিনি আমাদের দিকে তাক ক’রে ধরেছেন। তাঁর শরীর থেকে একটা হলদে দীপ্তি বের হচ্ছে, কিন্তু সেটা কোনো স্বস্তি বা আরাম দিচ্ছে না। তিনি কোথায় আছেন এবং কী করছেন সেটা আমরা ঠিক বুঝতে পারছি না। তাঁর রোমহীন শরীর একটা কাজে রত, এবং তাঁর মুখ দেখে আমরা সেই কাজের গতি আর অভিঘাত সম্পর্কে খানিকটা ধারণা পাই।

মারিয়া লাসনিগ তাঁর সহজাত প্রবৃত্তি থেকে আঁকেন। তাঁর শৈলী প্রায় যেন পারফরমেন্সের রূপ নেয়। নিজের যাত্রাবিন্দুর কথা বোঝাতে তিনি একটি শব্দবন্ধ তৈরি করেছিলেন : সহজাত প্রবৃত্তি সহজাত প্রবৃত্তি ‘Körperbewusstseinsmalerei’ (দেহ-সচেতনতামূলক চিত্রাংকন)। সত্তর বছর ধ’রে তিনি জীবিত থাকার সংবেদন বা অনুভব চিত্রিত ক’রে গেছেন। আলোকচিত্র থেকে কাজ করার ঘোর বিরোধী ছিলেন তিনি। তাঁর কথায়, “আমার দরকার আসল দেহ, আসল হাওয়া। আমি যখন ছবি আঁকি তখন আমি চাই সব কিছু যতটা সম্ভব প্রত্যক্ষ হোক।”

লাসনিগ বেশ দেরিতে সাফল্যের দেখা পেয়েছিলেন। পৃথিবী তাঁর নাগাল ধরতে ধরতে সত্তর বছর পেরিয়ে গিয়েছিল। তারপর এসেছিল নানান রেট্রস্পেক্টিভ আর পুরস্কার। ছয় বছর আগে ২০১৪ সালে তিনি ৯৪ বছর বয়েসে মারা যান। তিনি তাঁর সারা জীবনের অবদান বা কৃতিত্বের সুবাদে ভেনিস বিয়ানাল-এ স্বর্ণ সিংহ পুরস্কার লাভ করেন। এক নতুন প্রজন্মের চিত্রকরদের জন্য তিনি এক অনুপ্রেরণাদায়ী ব্যক্তিত্ব।

 

 

শিল্পকর্ম পরিচিতি:

Do oder Ich (তুমি বা আমি) ২০০৫

ক্যানভাসে তেলচিত্র

২০৩ X ১৫৫

 

অ্যান-সোফি সিডেন (Ann-Sofi Sidén)

(জন্ম ১৯৬২)

অ্যান-সোফি সিডেন ২০০৭ সালে তাঁর ছয়-চ্যানেল বিশিষ্ট ভিডিও ইন্সটলেশন In Passing সম্পন্ন করেন। একটা স্ক্রীনে দেখা যায় একটি শিশু চেঞ্জিং ম্যাটে শুয়ে কাঁদছে, নার্সরা তার কান্না থামানোর চেষ্টা করছে। এদিকে, আরেকটা স্ক্রীনে দেখা যায় বাচ্চাটির মা বার্লিনের রাস্তা ধ’রে হেঁটে যাচ্ছেন, তাঁর দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়াচ্ছে। একটু আগেই তিনি তাঁর বাচ্চাটিকে “Babbyklappe”-এ রেখে এসেছেন। জার্মানীতে একটি ব্যবস্থা রয়েছে যেখানে শিশুদেরকে একটা জায়গায় রেখে যাওয়া যায়, সেখানে অন্যরা সেসব শিশুর যত্ন নেন এবং তাদেরকে লালন-পালন ক’রে বড় ক’রে তোলেন। তিনি বলেন, “২০০৪ সালে আমি বার্লিনে প্রথমবারের মতো একটা Babbyklapp দেখি। তখন আমি গর্ভবতী ছিলাম। আমি ভাবতে লাগলাম কী ক’রে একটা ভিডিও ইন্সটলেশনের মাধ্যমে বিষয়টিকে ধরা যায়। … ২০০৭ সালে আমি গল্পটির চলচ্চিত্র রূপ দিতে শুরু করি: বেশ সকালের দিকে বার্লিনে এক তরুণী নারী Babbyklappe –এ তাঁর শিশুটিকে রেখে এসেছেন। আমি ভেবে ভেবে বের করার চেষ্টা করলাম এই পরিস্থিতে একটি তরুণী নারী – যে কিনা সম্ভবত এই এলাকারই আশেপাশে জন্ম নিয়েছে এবং সেখানেই তাঁর বাচ্চার জন্ম দিয়েছে- সে কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াতে পারে।”

ছয়টি স্ক্রীন জুড়ে সদ্যোজাত শিশুটির আর তার মায়ের জীবনযাত্রা দেখতে পাবো আমরা। দর্শকে বেছে নিতে হবে কার যাত্রাপথটি তাঁরা অনুসরণ করবেন। সেটা বেছে নেয়া বেশ কঠিন;  আর এই কঠিন পরিস্থিতিটি যেন পরিবারের ইউনিটটিকে বিচ্ছিন্ন ক’রে ফেলার ব্যাপারে মায়ের  হৃদয়বিদারক সিদ্ধান্তটিরই একটি প্রতিধ্বনি।

 

 

 

শিল্পকর্ম পরিচিতি:

In Passing  ২০০৭

ছয় চ্যানেলের সমন্বিত ভিডিও ইন্সটলেশন; দুটো মনিটর, শব্দ সহ চারটি ভিডিও প্রজেকশন

স্থায়িত্ব ১৪ মিনিট

(চলবে)

পর্ব-১: শিরীন নিশাত ও যারিনা হাশমি- দ্রোহ আর স্মৃতিকাতরতা

পর্ব-২: মহাজাগতিক সৃজনকারী শক্তি ও নারীর স্বরূপে ফেরা

পর্ব-৩: শিল্পের নতুন বিষয় ও শিল্পীর শরীর

পর্ব-৪: শ্রম বৈষম্য এবং সন্তান পালনের দলিল

পর্ব-৫: নারীর প্রতীকী ইতিহাস এবং শিল্পকর্ম হিসেবে দেহ

পর্ব-৬: দেহ ভাস্কর্য ও চিরন্তন মাতৃসত্তার বিরুদ্ধচিত্র

পর্ব-৭: গার্হস্থ্য জীবন আর অন-স্ক্রীন নারীত্বের স্বরূপ উন্মোচন

পর্ব-৮: দেহাস্ত্র এবং অনিরপেক্ষ প্রতিচ্ছবি

পর্ব-৯: বোধ স্বতন্ত্র এবং ফিউশন অস্বস্তিকর

পর্ব-১০ নির্যাতন নিরন্তর ও পিতৃতান্ত্রিক বিশ্বে নারী হওয়ার জটিলতা

পর্ব-১১: ব্যক্তিগত ক্ষমতায়ন এবং কৃষ্ণাঙ্গ নারী সমকামীর অভিজ্ঞতা

পর্ব-১২: পেশল বাস্তবতা আর পূর্বকল্পিত জেন্ডার বিষয়ক মতামত

পর্ব-১৩: সঙ্গীতের মহাফেজখানা আর ঐতিহাসিক পেইন্টিং-এর ভিন্ন বয়ান

পর্ব-১৪: সাদা কার্ড বাদামি কার্ড আর নারীর চোখে নারী

পর্ব-১৫: দৈনন্দিনের একঘেয়েমি আর শিল্পে গেরিলাযুদ্ধ

পর্ব-১৬: আশ্রয়স্থল কিংবা কারাগার আর ফিমেল আর্টের অনুসন্ধান

পর্ব-১৭: নারীর দেহভাষা আর পুরুষের প্রত্যাশার বিরুদ্ধাচারণ

পর্ব-১৮: পরিচয় পুনরুদ্ধার এবং ইতিহাসে স্থান পুনর্দখল