November 1, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

ডা. সাবরিনা: মূল অপরাধটি নয়, এ যেন নারীর প্রতি ঘৃণা!

মেহেরুন নূর রহমান।। কোভিড-১৯ টেস্টিং কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার অভিযোগে JKG হেলথ কেয়ারের চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। খুব ভালো কথা, অপরাধী পুলিশের কাছে ধরা পড়বে, বিচার পাবে, শাস্তি পাবে, এটাই আমরা সকলে চাই। মজার ব্যাপার হলো এই ঘটনার পর দেখা গেলো ফেসবুক ভরে গেছে সাবরিনার কিছু ছবিতে। বৃষ্টি ভেজা ছবি। ছোট পোশাক পরা ছবি। সেসব ছবি দিয়ে তাকে ট্রল করা হচ্ছে, তার চরিত্র নিয়ে নোংরা নোংরা কথা বলা হচ্ছে। যেন তার পোশাক, তার চেহারা, তার এই যে বৃষ্টিতে ভেজা ছবি অর্থাৎ তথাকথিত খোলামেলা আচরণ তার কৃত অপরাধের পেছনের মূল কারণ।

আগেও দেখেছি, নারীর দ্বারা কোন কিছু ঘটলে, সেটা অপরাধই হোক বা অন্য কিছু, অসুস্থ মানসিকতার কিছু নারী ও পুরুষ প্রথমে যে কাজটি করে তা হলো সেই নারীর ফেসবুক ঘেঁটে ঘেঁটে  কিছু ছবি আবিষ্কারের চেষ্টা করে। তারপর সেসব ছবি দিয়ে সেই নারীকে ট্রল করে, নোংরা নোংরা মন্তব্য করে। আমাদের সমাজে নারীদের প্রতি যে ডিপ রুটেড তীব্র ঘৃণা আছে এসব কাজকর্ম থেকেই সেগুলো প্রকাশ পেয়ে যায়। যেখানে যেভাবে সুযোগ পায় সেখানেই নারীকে নানাভাবে হেনস্তা করা।

কবে থেকে পোশাক, চেহারা, যৌনতা অপরাধের কারণ হিসেবে সংযুক্ত হলো বলুন তো? অপরাধী পুরুষও হতে পারে, নারীও হতে পারে। পুরুষ অপরাধীর বেলায় তো দেখিনা কেউ ফেসবুক খুঁজে খুঁজে তাদের ছবি বের করছে, যেখানে সে বৃষ্টিতে ভিজছে, নাকি নদীতে সাঁতার কাটছে, নাকি শর্টস পরে দাঁড়িয়ে আছে তা দেখার জন্য! কিন্তু নারীর বেলায় কেন এটা হয়? সুযোগ পেলেই যৌন অবদমিত অসুস্থ একটা বিশাল গোষ্ঠী মেয়েদের নানারকম ছবি নিয়ে এই ধরনের কাজকর্ম করতে উঠে পড়ে লাগে। কারণ তারা বিশ্বাস করে নারীর ঘরে থাকা উচিত, নারীর নিজেকে ঢেকে রাখা উচিত এবং তাদের তৈরি নিয়মে জীবনযাপন করা উচিত। একটি নারী যা ইচ্ছা তাই করবে, যেমন ইচ্ছা পোশাক পরবে, বৃষ্টিতে ভিজবে, আবার সেই  ছবি ফেসবুকে দেবে এটা তাদের জন্য মেনে নেয়া খুবই কষ্টকর। সুতরাং যখনই তারা কোনো অপরাধী নারীকে এই ধরনের পোশাকে দেখে বা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে দেখে, তখনই তারা সেটাকে পয়েন্ট আউট করতে উঠে প’ড়ে লাগে। তারা সবাইকে চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিতে চায় যে- ‘ভাল মেয়েরা এরকম জীবনযাপন করে না, শুধু খারাপ  মেয়েরাই এসব করে’।

অর্থাৎ তুমি যদি ভালো মেয়ে হও নিজেকে ঢেকে রাখবে, খোলামেলা (তাদের কথামত ) ছবি ফেসবুকে দেবে না,  নিজের ইচ্ছামত চলাফেরা করবে না, তথাকথিত শালীনতা বজায় রাখবে। মনে রাখা প্রয়োজন শালীনতার সংজ্ঞাও কিন্তু পুরুষতন্ত্রের তৈরি। পুরুষতন্ত্রই ঠিক করে কী রকম পোশাক একটি নারীর পড়া উচিত,  ঠিক কতক্ষণ সে বাইরে বাইরে থাকবে, কার কার সাথে মিশবে,  কীভাবে সে তার জীবনযাপন করবে ইত্যাদি । যখনই আপনি তাদের তৈরি এই শালীনতার সীমারেখা ভেঙে নিজের মত বাঁচতে চাইবেন তখনই আপনি বেশ্যা এবং খারাপ।

যে কোন সাধারণ মেয়েদের নিয়েই তারা এরকম ইতরামী করে আর সেখানে মেয়েটি যদি কোন অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে জড়িত থাকে তাহলে তারা যে এই  ধরনের নোংরা কার্যকলাপ আরো বেশি করে করবে এটা খুবই স্বাভাবিক। যদি ডঃ সাবরিনা বোরকা পরিহিতা একজন নারী হতো তাহলে কি তারা তার পোশাক নিয়ে কথা বলতো? চরিত্র নিয়ে কথা বলতো? ছবি দিয়ে তাকে ট্রল করতো? কখনোই না। এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নানাভাবে একটি নারীর নিজের ইচ্ছামত, পছন্দমত জীবনযাপনকে অপরাধ হিসাবে প্রমাণ করতে চায়, আর সত্যি সত্যি যদি এই ধরনের কোন নারী কোন অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ে তখন তা তাদের জন্য পোয়াবারো। তারা তখন একটি ভালো উদাহরণ পেয়ে গেছে সবার কাছে তুলে ধরার জন্য, মেয়েদের শিক্ষা দেয়ার জন্য। এই সুযোগ কি তারা হাতছাড়া করবে?

যারা সাবরিনার ছবি নিয়ে ট্রল করছেন, তাদের বলছি, আমরা সকলেই জানি অপরাধমূলক কার্যক্রমের সঙ্গে নারীদের চেয়ে পুরুষরা অনেক অনেক বেশি জড়িত। পুরুষ অপরাধীদের ক্ষেত্রে আপনাদের ভাবনা কি বলেন তো? পুরুষদের ক্ষেত্রে ঠিক কোন ধরনের ছবি ফেসবুকে প্রকাশিত হলে আপনি ট্রল করার কথা ভাববেন? পুরুষদের জন্য ঠিক কোন ধরণের পোশাক অপরাধমূলক আচরণের সাথে মেলানো যায় বলুন তো?

জানি, এর উত্তর আপনি দিতে পারবেন না কারণ আসলেই অপরাধের  সাথে পোশাক কিংবা যৌনতা, বা চেহারা এগুলোর কোন সম্পৃক্ততা নেই। আজকে অপরাধী একজন নারী বলে আপনি এই ধরনের নষ্টামী করছেন। এগুলো আসলে আর কিছু নয়, আপনাদের নারী-বিদ্বেষকেই  তুলে ধরছে।

ছোটবেলার কথা মনে পড়লো। আমাদের প্রতিবেশী একজন ভদ্রমহিলা যিনি সবসময় বোরখা পরে থাকতেন, তিনি এসে চালাকি করে আমাদের বাসা থেকে সোনার গয়না চুরি করে নিয়ে গেয়েছিলেন। আমি নামাজ পরে পরে কপালে দাগ তুলে ফেলা এবং বেশিরভাগ সময় শুভ্র পাজামা-পাঞ্জাবী পরে থাকা অনেক পুরুষকে দেখেছি ভয়ঙ্কর ঘুষখোর, এবং  মানুষকে ঠকানোর মত অপরাধমূলক কর্মের সাথে জড়িত।

আমার দেখা দারুণ সবচেয়ে সুদর্শন একজন পুরুষকে দেখেছি কত ভয়ঙ্কর নারী লোভী এবং কদর্য।  সুপরুষ, সুবেশী ভদ্রলোকের মত দেখতে লোককে দেখেছি  নারীদের ঠকিয়ে, বোকা বানিয়ে সর্বশান্ত করতে।

নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যে কেউ অপরাধ করলে আপনি তার সম্বন্ধে জানতে চাইতেই পারেন। আপনি জানতে চাইতে পারেন সে পূর্বে কোন অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে জড়িত ছিল কি না এবং এ ধরণের কোন প্রমাণ পেলে সেটা আপনি প্রকাশ করতেই পারেন, সবাইকে জানাতেই পারেন। কিন্তু অপরাধী যদি নারী হয় তখন আর সব কিছু বাদ দিয়ে যখন আপনি তার চেহারা কিংবা পোশাক কিংবা তার ফেসবুকে দেয়া কোন ছবিকে হাইলাইট করে তার অপরাধের সঙ্গে সেগুলোতে যুক্ত করতে চান,তখন আপনার আপনার নোংরা পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতাই উন্মোচিত হয়, আর কিছু না।

বেশ কয়েক বছর আগের একটা ঘটনা মনে পড়লো। একজন হাইক্লাস কলগার্ল ধরা পড়েছিল। মেয়েটি যখন পুলিশ স্টেশনে তখন  কিছু ব্যাক্তি নানাভাবে মেয়েটির গায়ে হাত দিচ্ছিল, তার বুকে হাত দেয়ার চেষ্টা করছিল। মেয়েটি ব্যাপারটাতে প্রতিবাদ করলে তারা বলেছিলো আরে তুই তো বেশ্যা, তোর গায়ে হাত দিলে আবার সমস্যা কি? ভাবুন একবার এদের মানসিকতা! নরমাল অবস্থায় এইসব নোংরা লোকজন মেয়েদের মানুষ হিসেবে ট্রিট করে না, ভাবে মেয়েদের সাথে যখন যা ইচ্ছা তাই করা যায় আর সেখানে যদি সত্যি সত্যি মেয়েটি অপরাধী হয়, তখন তো তার সাথে যা কিছু করা যায়, যে কোনো অপবাদ দেয়া যায়, তার সঙ্গে যে কোন লেভেলের নোংরামি করা যায়।

শুনুন, দয়া করে অপরাধের সাথে পোশাক  বা যৌনতা বা চেহারা এসব মেলাবেন না। আপনাদের সংজ্ঞা অনুযায়ী তথাকথিত ভালোমেয়ে, যে যথেষ্ট নিজেকে ঢেকে রাখে, আপনাদের সংজ্ঞামত শালীনতার সাথে জীবনযাপন করে, সেই সব মেয়েদের মধ্যেও আমি চরম অসততা, ভণ্ডামি এবং অপরাধপ্রবণতা দেখেছি। আবার আপনাদের সংজ্ঞা অনুযায়ী উচ্ছন্নে যাওয়া, স্বাধীনভাবে চলাফেরা করা, স্পষ্ট কথা বলা, নিজের পছন্দসই কাপড় পরা মেয়েদের দেখেছি অনেক সততার সাথে জীবনযাপন করতে। সমাজবিজ্ঞানীরা বলেছেন একজন মানুষের অপরাধমূলক আচরণের সাথে অনেক কিছু জড়িত। উচ্চাকাঙ্ক্ষা, লোভ, পারিপার্শ্বিকতা, বেড়ে ওঠা, সমাজব্যবস্থা, অর্থনৈতিক অবস্থা এরকম নানা কারণ। চেহারা, পোশাক যৌনতা এসব নয়। আমি জানি আপনারা নিজেরাও এটা খুব ভালো করে জানেন, কারণ কোন পুরুষ অপরাধীর ক্ষেত্রে আপনারা কিন্তু এই ধরনের জঘন্য আচরণ করেন না। একমাত্র অপরাধী যদি নারী হয়, বা নারী দ্বারা কোন অসততামূলক কার্যকলাপ সংঘটিত হয় তখন আপনারা মেয়েটাকে কীভাবে আরো বেশি হেনস্তা করা যায়, ছোট করা যায়, তার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েন। টেনে নিয়ে আসেন মেয়েটির ব্যক্তিগত জীবন, তার ছবি, তার চেহারা, তার যৌনজীবন।

আপনারা আসলে মেয়েদের হেয় করার কোন সুযোগই ছাড়েন না। আপনাদের নারীবিদ্বেষ আর নারীঘৃনার তীব্র মাত্রা আমাকে বিস্মিত করে না, কিন্তু দুঃখিত করে, বিষন্ন করে, ক্ষুব্ধ করে আর  এই ইতর সমাজকে চড়িয়ে সোজা করে দেবার ইচ্ছাটা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]