November 21, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

বৈবাহিক ধর্ষণ: ভয়ংকর এক ট্যাবু

ফারজানা   টুম্পা।। বর্তমানে অনেকেই সমাজের প্রচলিত ট্যাবু ভাঙার প্রচেষ্টায় সেগুলো নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছেন। আমাদের সমাজে পিরিয়ডের মতো সহজ স্বাভাবিক বিষয়টাও ট্যাবুতে পরিণত হয়েছে, সেখানে ম্যারিটাল রেপ বা বৈবাহিক ধর্ষণ নিয়ে কথা বলাটা তো অবশ্যই অনেকখানি সাহসের ব্যাপার।

ম্যারিটাল রেপ বা বৈবাহিক ধর্ষণ আসলে কী?

ম্যারিটাল রেপ বলতে বিয়ের পরে স্বামী বা স্ত্রী কর্তৃক একে অন্যের অনিচ্ছায় জোরপূর্বক শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করাকেই বোঝানো হয়ে থাকে। আমাদের সমাজে একটা মেয়েকে জন্মের পর থেকেই এমন মানসিকতার মধ্যে দিয়ে বড় করা হয় যেখানে তাকে বোঝানো হয় বিয়ের পরে স্বামীর অন্যায়টাও ন্যায়।

এই বিষয়ে চুপ থাকার কারণ কী?

বিয়ে এমন একটি সম্পর্ক যার মাধ্যমে  শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন বৈধতা পায়। বিয়ের আগে নারীকে সাজিয়ে গুছিয়ে স্বামীর মনোরঞ্জনের বস্তুতে পরিণত করা হয় যাতে সে হয়ে ওঠে পুরোপুরি সম্ভোগের বস্তু। এটা যেন এক অলিখিত আইন, যাতে স্বামীর ডাকে সাড়া দেওয়া স্ত্রীর প্রধান দায়িত্ব এবং কর্তব্য। অনেকেই বিয়ের পরে প্রতিনিয়ত ধর্ষণের শিকার হয়ে থাকেন কিন্তু লোকলজ্জার ভয়ে মুখ খুলতে পারেন না। কেননা তারা মনে করেন এখানে জড়িয়ে আছে পরিবারের সম্মান, সমাজের অগ্নিচক্ষু।

বৈবাহিক ধর্ষণের পরিণতি কেমন হয়?

এর পরিণতি হয় মারাত্মক। সম্প্রতি একটি মেয়ের বৈবাহিক ধর্ষণ এবং এর ভয়াবহতা সম্পর্কে জানতে পারলাম। অল্প বয়সী একটি মেয়ে বিয়ের মাসখানেক পরে বাবার বাড়িতে এসে আর স্বামীর বাড়িতে ফিরে যেতে চাইছে না। অনেক বোঝানোর পরেও সে কিছুতেই ফেরত যাবে না। এরপর গ্রামে সালিসি বসানো হলো। দু’পক্ষই উপস্থিত। এবার চেয়ারম্যান মেয়েকে আড়ালে ডেকে জানতে চাইলেন আসলে কী হয়েছে?

এরপর টেস্ট করার পরে জানা গেলো মেয়েটার যৌনাঙ্গে ইনফেকশন হয়ে গেছে। বিয়ের পর থেকে সে প্রতিনিয়ত ধর্ষিত হয়েছে। একটা বার ভেবে দেখুন তো পুরো একটা মাস মেয়েটাকে কতোটা নির্যাতন নিপীড়ন সহ্য করতে হয়েছে?

অনেক সময় নারী বুঝতেই পারে না যে সে প্রতিনিয়ত নিজের সঙ্গীর দ্বারাই ধর্ষিত হচ্ছে। কেননা সে মনে করে এটা স্বামীর অধিকার। স্বামী যেভাবে খুশি যখন খুশি তাকে ভোগ করার ক্ষমতা রাখে। এর বিপরীতে সে পাবে একটা সংসার, গুটিকয়েক সন্তান, চিন্তাহীন আর্থিক সচ্ছলতা।

কিন্তু শুধুমাত্র গৃহিণীরাই যে এর শিকার হয়ে থাকেন তা কিন্তু নয়। অনেক উচ্চশিক্ষিতা চাকুরিজীবী নারীও প্রতিনিয়ত ম্যারিটাল রেপের শিকার হয়। এবং এক্ষেত্রে আওয়াজ তোলাকে বরং অকার্যকর বলে মনে করে। কেননা আওয়াজ তুললে তাকেই বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। যার যথাযথ উত্তর না পেলে সমাজে তাকে হেনস্তা করতে ছাড় দেয় না।

ম্যারিটাল রেপের ক্ষেত্রে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ যতোটা দায়ী তার চেয়েও অনেক বেশি দায়ী নারীর ভেতরকার পুরুষতান্ত্রিকতা। কেননা এই সমাজের নারীদের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয় সে কেবলই সম্ভোগের বস্তু। তার বৈবাহিক অবস্থানও তাকে বারবার স্মরণ করিয়ে দেয় সে স্বামীর হাতের পুতুল। স্বামী যখন খুশি যেভাবে খুশি তাকে ভোগ করার ক্ষমতা রাখে।

এই ধারণা বহু পুরনো। কোনো ধর্মই নারীকে যৌনসঙ্গী খুঁজে নেওয়ার ক্ষমতা যেমন দেয়নি, তেমন দেয়নি বিয়ের পরে স্বামীকে ‘না’ বলবার ক্ষমতা। কিন্তু স্বামীকে প্রভুর মতো সম্মান করতে গিয়ে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নারী নিজে। স্বামীকে স্বামী না ভেবে বন্ধু ভাবলে এই সমস্যা অনেকখানি উপশম করা সম্ভব।

অপরিচিত ব্যক্তি কর্তৃক ধর্ষণের চেয়েও কয়েকগুণ ভয়াবহ বৈবাহিক ধর্ষণ। এতে যে মানসিক অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে একজন নারীকে প্রতিনিয়ত যেতে হয় তা শুধুমাত্র ভুক্তভোগী নারীই উপলব্ধি করতে পারেন। এক্ষেত্রে সমাজ মৌনতা অবলম্বন করে। সমাজ বলে, যত যা-ই হয়ে যাক না কেন, সে তোমার স্বামী। তাই একজন নারী যখন তার পরিবারের কোনো নারী সদস্যের কাছে তার বৈবাহিক ধর্ষণের কথা উল্লেখ করে তখন তাকে শুনতে হয় “এটা স্বাভাবিক”। এবং এই একটি বাক্যই তাকে লড়াই করার আগেই হারিয়ে দেয়। অনেক সময় এই ট্রমা তাকে আত্মঘাতী হতে শেখায়।

আইন কী বলে?

সবচেয়ে দুঃখের বিষয় এই যে, বাংলাদেশের ধর্ষণসংক্রান্ত কোনো ধারার কোথাও বৈবাহিক ধর্ষণের কথা উল্লেখ নেই। ধর্ষণ বলতে কেবল স্ত্রী ব্যাতীত অন্য কোনো নারীর সাথে স্থাপিত শারীরিক সম্পর্ককে বোঝানো হয়ে থাকে। দণ্ডবিধি ৩৭৫ নম্বর ধারা অনুযায়ী ১৩ বছরের উর্ধ্বে বিবাহিত স্ত্রীর সাথে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করা ধর্ষণ হিসেবে স্বীকৃত হয় না।

প্রতিবছর প্রায় ৬০ শতাংশ নারী ম্যারিটাল রেপের শিকার হয়, কিন্তু এই অপরাধ কোনো অপরাধ বলে বিবেচিত হয় না। আর এশিয়া মহাদেশ এক্ষেত্রে সবচেয়ে পিছিয়ে আছে। পিছিয়ে আছে আমাদের বাংলাদেশ।

শুধু কী নারীরাই ম্যারিটাল রেপের স্বীকার হচ্ছে?

না শুধুমাত্র নারীরাই যে এর স্বীকার হয়ে থাকেন তা নয়। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় ১৩-১৬ শতাংশ পুরুষও কোনো না কোনো সময় বৈবাহিক ধর্ষণের স্বীকার হয়ে থাকেন।

শারীরিক সম্পর্ক হবে মধুর, দুজন ব্যক্তির পূর্ণ সম্মতিতে। সেখানে যখনই আগ্রাসী মনোভাব জেঁকে বসে তখন তা বিষের মতো হয়ে ওঠে। মূলত এখন সময় এসেছে নারী পুরুষের উভয়েরই এই বিষয়ে আওয়াজ তোলার। আইনে নতুন ধারা সংযোজন করার। নারীরা বদ্ধমূল ধারণা থেকে বেরিয়ে নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হোক। তবেই তাদের জন্য পৃথিবী হয়ে উঠবে বসবাসের উপযোগী এক গ্রহ।