May 15, 2024
নারীবাদ আলোচনাফিচার ৩

পশ্চিমের চোখে মুসলিম নারী, ইসলামী নারীবাদী ভাবনা ও একটি ভূমিকা

বাংলা ভাষার ব্লগার, সামাজিক – রাজনৈতিক বিশ্লেষক, এক সময়ের সক্রিয় বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মী মুহাম্মদ গোলাম সারওয়ার, যিনি স্বপ্ন দেখেন একটি লৈঙ্গিক সমতাভিত্তিক সংস্কৃতি ও সমাজের। নারীবাদ তাই তার চিন্তা, পড়াশোনা ও লেখালেখির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরের পাঠকদের জন্য তিনি ধারাবাহিকভাবে লিখছেন – ইসলামী নারীবাদ: মুসলিম পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিশ্বাসী মানুষের সংগ্রামপড়ুন এর প্রথম পর্ব।।

 

ভূমিকা 

মিশরের নারীবাদীদের ইতিহাস নিয়ে লেখা প্রবন্ধে মোহাম্মদ ইউনিস লিখছেন – সেপ্টেম্বর এগারোর ঘটনার পরে সারা পশ্চিমা দুনিয়া যেভাবে মুসলিম নারীর অধিকার নিয়ে নাওয়া খাওয়া ভুলে গভীর চিন্তায় মুষড়ে পড়েছিল, তাতে মনে হয় যেন সেপ্টেম্বর এগারোর ঘটনার আগে মুসলিম দুনিয়ায় নারীর অধিকার বিষয়ে সবকিছু এরিখ মারিয়া রেমার্কের বর্ণনা করা ‘ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’ এর মত সুভালাভালি আর সুনসান ছিলো।

না, তা ছিল না একেবারেই, বরং মুসলিম নারীর জীবন শতাব্দী ধরেই নিপীড়নের, বঞ্চনার, অধীনস্ততার। যদিও এর সমান্তরাল প্রশ্ন হচ্ছে পৃথিবীর ‘অমুসলিম’ নারীরা কি একইভাবে শতাব্দী ধরে নিপীড়ন, বঞ্চনা ও অধীনস্ততার শিকার নয়? সত্যনিষ্ঠ ইতিহাস বলে যে পূবে বা পশ্চিমের অমুসলিম নারীও বহু বহু বছর ধরে নানানভাবে নিপীড়িত, বঞ্চিত ও অধীনস্থ। ভারতে যে হিন্দু সভ্যতার আভিজাত্যের বন্দনা আমরা জানি, বিশেষত সাম্প্রতিক সময়ের হিন্দুত্ববাদীদের প্রচারণায়, সেই ভারত ‘ফিমেইল ইনফ্যান্টিসাইড’ বা কন্যাশিশুর ভ্রূণ হত্যার মতো ভয়ংকর ঘটনার জন্যে সারাবিশ্বেই আলোচিত। হিন্দু পারিবারিক আইনে কন্যা সন্তানের বঞ্চনার ইতিহাসকেই ‘স্বাভাবিক’ হিসাবে গণ্য করা হয়ে আসছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। আর কন্যা সন্তানের ভ্রূণ হত্যার মতো ভয়ংকর ঘটনা তো ঘটছে এই ঘোর আধুনিক, সেক্যুলার সময়ের ভারতে। বিশেষত ভারতের হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতেই এই কন্যাশিশুর ভ্রূণ হত্যার মতো ঘটনাগুলো বেশি ঘটছে।  অর্থাৎ এই অঞ্চলগুলোতে কন্যাশিশুর জন্মও কাম্য নয়, জন্ম হবার আগেই তাকে হত্যার মতো ভয়ংকর অমানবিক ঘটনার শিকার হতে হচ্ছে। কিছু পার্বত্য প্রদেশ বাদ দিলে সাম্প্রতিক সময়ে সমগ্র ভারতই নারীর প্রতি দারুণ লিঙ্গবৈষম্যবাদী একটি সমাজে পরিণত হয়েছে এবং ক্রমশই তা বাড়ছে। থমসন রয়টার ফাউন্ডেশন ২০১১ এবং ২০১৮ সালে দুটি সার্ভে করেছে সারা পৃথিবীর প্রায় ছয়শ জেন্ডার বিশেষজ্ঞদের নিয়ে। ২০১৮ সালের মতামত জরিপটিতে এই বিশেষজ্ঞদের মতে নারীর জন্যে দুনিয়ার সবচাইতে ভয়ংকর দেশ হিসাবে উঠে আসে ভারতের নাম। ভারত পৃথিবীর বৃহত্তম হিন্দু ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর বসবাসস্থান কিন্তু হিন্দু নারীর লিঙ্গবৈষম্যবাদী শোষণের শিকার হবার বিষয়টি সারা দুনিয়াতে বিশেষত পশ্চিমা সমাজে খুব আলোচ্য বিষয় নয়। নারীর বঞ্চনার ইতিহাসে – আলোচনায় ‘হিন্দু নারী’র বঞ্চনার ইতিহাস বলে অন্তত প্রকাশ্য কিছু নেই। আন্তর্জাতিক পরিসরের আলোচনাগুলোতে হিন্দু নারী মানেই ‘Oppressed’ বা শোষিত নন কিন্তু মুসলিম নারী মাত্রই ‘Oppressed’ বা শোষিত ।

এমন কি পশ্চিমের সবচাইতে সমানাধিকারের দেশ বলে খ্যাত স্ক্যান্ডেনেভিয়ান দেশগুলোতেও আজও একই পদে একই শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও নারীকে বেতন বৈষম্যের শিকার হতে হচ্ছে, নারীর শ্রমঘণ্টা আজও পুরুষের চাইতে উল্লেখযোগ্য হারে বেশি এবং পারিশ্রমিক কম। পশ্চিমের দেশগুলোতেও আজও ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স এর ঘটনাগুলোতে নারী এখনও নিপীড়ন ও বৈবাহিক ধর্ষণের প্রধান শিকার। ডেনিশ গবেষক রিক্কে আন্দ্রিয়াসেন তার এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, খোদ ডেনমার্কেও নারী পারিবারিক নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন, এমন কি স্বামীর হাতে খুন হয়ে যাচ্ছে নারী, কিন্তু সেসব ঘটনাকে কেউ ‘খ্রিষ্টান নারীর’ প্রতি ‘খ্রিষ্টান পুরুষের’ করা নিপীড়ন বা শোষণমূলক ঘটনা হিসাবে আলোচনায় নিয়ে আসছে না, সেসব কেবলই নারীর বিরুদ্ধে নিপীড়ন ও বৈষম্যমূলক ঘটনা হিসাবে আসছে।

মুসলিম নারীকে ‘রক্ষা’ করার নামে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি স্বাধীন রাষ্ট্র’র বিরুদ্ধে প্রায় দুই যুগ দীর্ঘ একটি ভয়ংকর যুদ্ধের সূচনা করেছিল, সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে নারীর অবস্থা কেমন? আধুনিক নারীবাদী আন্দোলনের প্রায় সবকয়টি সূচকে মার্কিন নারীর অবস্থা খুবই করুণ। একই পেশায় নারী – পুরুষের মজুরীর তফাৎ (Gender pay gap) হচ্ছে নারীর সমানাধিকারের প্রশ্নে আধুনিক নারীবাদীদের কাছে একটি প্রধান সূচক, এই সূচকে খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা খুবই করুণ। প্রায় সব পেশায় নারীর মজুরির অনুপাত পুরুষের চাইতে কম। গড়পড়তা হিসাবে আমেরিকায় একই কাজের জন্যে পুরুষের আয় একশ ডলার হলে নারীকে দেয়া হয় আটাত্তর ডলার এবং এই বৈষম্য আরও প্রকট হয়ে ওঠে অভিবাসী ও ভিন্ন বর্ণের নারীদের জন্যে। মূলধারার শ্বেতাঙ্গ পুরুষের একশো ডলারের বিপরীতে শ্বেতাঙ্গ মার্কিন নারীর আয় বিরাশি ডলার, কৃষ্ণাঙ্গ নারীকে দেয়া হয় পঁয়ষট্টি ডলার আর সবচাইতে কম দেয়া হয় হিস্প্যানিক নারীকে – মাত্র আটান্ন ডলার। একই বৈষম্য নারীকে মোকাবিলা করতে হয় পেশাভেদে। উচ্চশিক্ষিত নারীর জন্যে এই মজুরি বৈষম্য কমে আসলেও কায়িক শ্রম বা ‘ব্লু কলারড’ পেশায় এই বৈষম্য এখনও প্রকট। ব্যবসা – বাণিজ্যের প্রশাসনিক পেশার নারীদের সমপেশার পুরুষের তুলনায় মজুরির অনুপাত ৮১ শতাংশ হলেও নির্মাণ শ্রমিক নারী তার পুরুষ সহকর্মীর তুলনায় মাত্র ৬৭ শতাংশ মজুরি পেয়ে থাকেন। বৈশ্বিক লিঙ্গ সমতার সূচক হিসাব করার ক্ষেত্রে চারটি প্রধান এলাকাকে মূল ভিত্তি হিসাবে নেয়া হয়েছে; ১. অর্থনৈতিক কার্যক্রমে নারীর অংশগ্রহণ ও অংশ নেয়ার সুযোগ, ২. নারীর শিক্ষাগত অর্জন ৩. নারীর স্বাস্থ্য ও আয়ু এবং ৪. নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন। এই চারটি সূচকের ভিত্তিতে বিশ্বের তাবৎ দেশগুলোর যে র‍্যাংকিং বা ক্রমবিন্যাস করা হয়েছে, গত বছরের হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেই তালিকায় ৫৩ নম্বর দেশ হিসাবে অবস্থান করছে। নারীর স্বাস্থ্য ও আয়ু এই সূচকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সত্তরতম যা পুরুষের তুলনায় মার্কিন নারীর স্বাস্থ্য অধিকারের অসমতার করুণ অবস্থাকেই তুলে ধরছে। শুধুমাত্র লৈঙ্গিকভাবে ‘নারী’ হবার কারণে খোদ মার্কিন সমাজে বিপুল অসমতার শিকার হতে হয় নারীকে, কিন্তু নিশ্চিতভাবেই নারীর প্রতি এই বৈষম্যবাদকে ‘খ্রিষ্টীয়’ ঐতিহ্যের সাথে যুক্ত করা হবে না, এমন কি পশ্চিমের আধুনিকতাবাদ ও প্রগতিশীলতার সাথেও যুক্ত করা হবে না। কিন্তু একই অনুপাতের বৈষম্যবাদের উপস্থিতিকে পাকিস্তানে বা ইয়েমেনের বেলায় এই জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে যুক্ত করা হবে।

সুতরাং এটা খুবই সুস্পষ্ট, খুব সামান্য অনুসন্ধান আমাদের বলে দেয় যে নারীর বঞ্চনার স্বরূপটি সমাজ নিরপেক্ষভাবে খুব বেশি তফাতের নয় আজও। নরডিক দেশগুলো (আইসল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক, সুইডেন, নরওয়ে) ব্যতীত অপরাপর পশ্চিমা দেশগুলোতে নারীর সমানাধিকারের প্রশ্নটি এখনও বিপুল সংগ্রামের অধীন। তাহলে কেন ‘মুসলিম’ নারীর লিঙ্গবৈষম্যবাদী শোষণের শিকার হবার বিষয়টি এভাবে আলাদা করে বিপুল আলোচনার দাবি রাখে? মুসলিম নারীর অধিকারহীনতা ও তার ‘পিছিয়ে থাকার’ প্রসঙ্গকেই কেন এক রকমের ‘ইউনিক’ সমস্যা হিসাবে শ্রেণিবদ্ধ করা হচ্ছে সারা দুনিয়াব্যাপী? কেন মুসলিম নারীমাত্রই মনে করা হচ্ছে ‘শোষিত’ ও বঞ্চিত নারী?  অমুসলিম সমাজগুলোতে নারীর অবস্থা কি ভিন্ন কিছু? না, সারা দুনিয়াব্যাপী নারীর বঞ্চিত হবার যে সাধারণ ইতিহাস, মুসলিম নারী সেই ইতিহাসেরই অংশ। অমুসলিম সমাজে নারীর অবস্থান আর মুসলিম অধ্যুষিত সমাজে নারীর প্রতি যে বৈষম্যমূলক বাস্তবতা তার মাঝে তফাত কতটা গুনগত আর কতটা পরিমাণগত? আর এই দুই বাস্তবতার মূল কারণ কতটা সাংস্কৃতিক ও আর্থ-রাজনৈতিক আর কতটা ধর্মীয় বিধিবিধানপ্রসূত সেই প্রশ্নটি নিয়ে পশ্চিম ও অপশ্চিমা বিদ্যায়তনিক পণ্ডিতদের মাঝে ব্যাপক আলোচনা ও বিতর্ক জারি রয়েছে। সেই বিতর্কের খানিকটা এই লেখায় উঠে আসবে।

তবুও মুসলিম নারীর অবস্থা নিয়ে আলাদা করে আলোচনা হচ্ছে। এই আলোচনা যে শুধু পশ্চিমা চত্বরেই হচ্ছে তা নয়, খোদ মুসলিম নারী ও নারীর সংগ্রামের সারথী মুসলিম পুরুষের মাঝেও এই আলাপ জোরেশোরেই হচ্ছে। মুসলিম অধ্যুষিত সমাজে তো বটেই, পশ্চিমে বা অমুসলিম সমাজেও হচ্ছে। এই সকল আলাপ আলোচনার অন্তত প্রধান দুইটি ধারা আমরা দেখতে পাই খুব সাদা চোখেই।

প্রথমত –  পশ্চিমা দুনিয়ায় যেভাবে মুসলিম নারীর অবস্থা নিয়ে আলাপ আলোচনা হয়, যেভাবে মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোর নারীর অবস্থাকে চিত্রিত করা হয় এবং তার সাথে ধর্ম হিসাবে ইসলামকে যুক্ত করা হয়, তার সাধারণ বয়ান বা আখ্যানটি  হলো  ‘ইসলাম’ এর ‘নিপীড়নমূলক চরিত্র’ই এই সকল জনপদে নারীর পিছিয়ে থাকার, লিঙ্গ বৈষম্যবাদের শিকার হবার মূল কারণ। পশ্চিমের এই অংশের মতে ধর্ম হিসাবে ইসলাম অন্তর্নিহিতভাবেই, সহজাতভাবেই নিপীড়নমূলক বা Oppressive, সেজন্যেই একই পরিবারের ধর্ম হওয়া সত্ত্বেও খ্রিস্টধর্ম প্রভাবিত পশ্চিমের নারীদের চাইতে মুসলিম অধ্যুষিত নারীদের বঞ্চনা অনেক বেশি। মুসলিম নারীর বঞ্চনার কারণ পিতৃতন্ত্র বা আর্থ-রাজনৈতিক সংস্কৃতি নয়, তার ধর্ম ‘ইসলাম’ হচ্ছে মূলত দায়ী। এটাই হচ্ছে মুসলিম নারীর অবস্থা প্রসঙ্গে পশ্চিমের মূলধারার বয়ান। সাম্প্রতিক সময়ে, বিশেষত সেপ্টেম্বর এগারোর ঘটনার পরে সারা দুনিয়াতে যে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ’ জারি হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র রাষ্ট্রগুলোর দ্বারা, এই পরিবর্তিত সময়ে পশ্চিমের এই বয়ান আরও অনেক বেশি শক্তপোক্ত হয়েছে।

মুশকিলের কথা হচ্ছে মুসলিম নারীদের নিয়ে পশ্চিমের এই বয়ান বা আখ্যানের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য উন্মোচন করেছেন পশ্চিমেরই অনেক বিদ্যায়তনিক তাত্ত্বিক ও সক্রিয়তাবাদী। অপশ্চিমা গবেষকেরা তো বটেই, এমনকি পশ্চিমের বিকল্প ধারার বিদ্যায়তনিক গবেষকেরাও তাদের বিভিন্ন গবেষণা, লেখালেখি, বিশ্লেষণে দেখিয়েছেন মুসলিম নারীর এই বঞ্চনার বয়ান বা আখ্যানটি যতটা ঔপনিবেশিকতাবাদী রাজনৈতিক উদ্দেশ্যতাড়িত, ততটা মুসলিম নারীর সত্যিকারের বাস্তব সংগ্রামের অভিজ্ঞতা থেকে নেয়া নয়। পশ্চিমের ও পূবের বিউপনিবেশায়নবাদী তাত্ত্বিকেরা ইতিহাসের নানান পর্বের ভুতাপেক্ষ বিশ্লেষণ (Retrospective analysis) করে দেখিয়েছেন, মুসলিম নারীর মুক্তির প্রশ্নটি আসলে পশ্চিমের একটি রাজনৈতিক এজেন্ডা, মুসলিম নারীর জন্যে পশ্চিমের হাহাকার,  যা শুরু থেকেই উপনিবেশবাদী উদ্দেশ্যর কারণে দূষিত। তাই মুসলিম অধ্যুষিত সমাজের নারীদের নিয়ে পশ্চিমের দুশ্চিন্তা এতদিনে ছদ্ম-আবেগ হিসাবে প্রমাণিত হয়ে গেছে। মুসলিম নারীর বঞ্চনা নিয়ে পশ্চিমের মূলধারার মতামতগুলো তাই ঔপনিবেশিক রাজনীতির ছায়া থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। লায়লা আহমেদ যেমন ‘মুসলিম নারী’ এই বর্গীকরণের ঐতিহাসিক সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা হাজির করেছেন, তেমনি ফাদওয়া আল গুন্দি’র মতো নৃবিজ্ঞানীরা হাজির করেছেন মুসলিম নারীর পোশাকের সাথে ‘শোষিত’ হবার অভিজ্ঞতাকে জুড়ে দেয়ার পশ্চিমা আখ্যানের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট।

ঔপনিবেশিক রাজনীতির ছায়া ছাড়াও আরও একটি কারণ পশ্চিমের এই ‘মুসলিম নারী’ নামের বর্গটি তৈরির পেছনে ভূমিকা রেখেছে। তা হচ্ছে মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিষয়ে পশ্চিমের  সীমাহীন অজ্ঞতা ও অজ্ঞতাপ্রসূত সংস্কার। স্ক্যান্ডেনেভিয়ার দেশ ডেনমার্কে যখন মুসলিম নারীর পোশাক ‘বুরকা’ নিষিদ্ধ করার জোরালো দাবি উঠেছিল, এই একটি প্রসঙ্গে যখন দেশের চরম ডানপন্থী ও আপাত উদারনৈতিক হিসাবে স্বীকৃত বামপন্থীরা এক হয়ে গিয়েছিল, সেই বিতর্ককে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ডেনিশ মিডিয়া ও জেন্ডার বিষয়ের গবেষক অধ্যাপক রিক্কে আন্দ্রিয়াসেন বলছেন, মুসলিম নারী প্রসঙ্গে পশ্চিমাদের জ্ঞানের বহর কতটা ভয়াবহ যে এই বিতর্কে অংশ নেয়া বিভিন্ন জাতীয় গণমাধ্যমগুলোর একজন সাংবাদিকও পাওয়া যায়নি যে ‘বুরকা’ ও ‘নিকাব’ এর তফাত জানেন। এরা মুসলিম নারীর মুখ ঢাকার পর্দা বা নিকাবকেই ‘বুরকা’ হিসাবে চিহ্নিত করে ‘বুরকা নিষিদ্ধ’ করার আইন প্রস্তাব করে বসলেন। ডেনমার্ক ২০০৯ সালে ‘বুরকা নিষিদ্ধ’ করে আইন পাশও করলো অথচ পরবর্তীকালে ডেনিশ সরকারেরই করা জরিপে দেখা গেল সারা ডেনমার্ক জুড়ে মাত্র একশ থেকে দুইশ মুসলিম নারী বুরকা নামের পোশাকটি পরিধান করে, যেখানে ডেনমার্কে মুসলিম জনগোষ্ঠী প্রায় তিন লাখের মতো। অর্থাৎ একটি জনগোষ্ঠীর ঠিক কত অংশ বুরকা পরিধান করে, আদৌ বুরকা ‘মুসলিম’ জনগোষ্ঠীর পোশাক কিনা, এমন কি প্রথাগত ‘পর্দা’ ধারণাটিও যে মুসলিম জনগোষ্ঠীর ভিন্ন ভিন্ন অংশে ভিন্ন ভিন্ন বোঝাপড়া হিসাবে হাজির থাকতে পারে, ‘পর্দা’ প্রথাটি পারস্যের মুসলমানেরা যেভাবে বোঝেন মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম জনগোষ্ঠী সেভাবে বোঝেন না বা উত্তর আফ্রিকার মুসলিম জনগোষ্ঠী একইভাবে বোঝেন না, এইসব বিস্তারিত না জেনেই একটি রাষ্ট্র তার জনগোষ্ঠীর একাংশকে লক্ষ্য করে একটি আইন করে বসলো। রিক্কে আন্দ্রিয়াসেন এভাবেই ব্যাখ্যা করেছেন সাম্প্রতিক পশ্চিমা সমাজের অজ্ঞতা কিভাবে ‘মুসলিম নারী’ এই বর্গটিকে তৈরি করতে সাহায্য করেছে।

পশ্চিমা ঔপনিবেশিক শক্তি তো বটেই এমন কি পশ্চিমা নারীবাদী গোষ্ঠীও মুসলিম নারীকে তার প্রেক্ষিত থেকে না দেখে বরং মুসলিম নারীকে বিশ্লেষণ করেছে পশ্চিমা প্রেক্ষিত থেকেই। সে কারণে পশ্চিমা নারীবাদ যা মূলত নারীর সংগ্রামকে এগিয়ে নেয়ার জন্যেই লড়াই করেছে বহু বছর ধরে, সেই নারীবাদেরও অনেক ধারা মুসলিম নারীর সংগ্রামকে বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে। এমন কি পশ্চিমা নারীবাদেরও কোনো কোনো ধারা সরাসরি ঔপনিবেশিক শক্তির এবং হাল আমলের নয়া-ঔপনিবেশিক শক্তির পক্ষের হাতিয়ার হিসাবে কাজ করেছে। রিক্কে আন্দ্রিয়াসেন তার প্রবন্ধে ব্যাখ্যা করেছেন ডেনমার্কের ইতিহাসে যে সকল চরম দক্ষিনপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো নারীর সমানাধিকারের প্রশ্নে সবসময়ই বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে, নারীর অধিকারের বিভিন্ন প্রশ্নে বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে তারাই ‘মুসলিম নারী’র অবস্থা প্রসঙ্গে পশ্চিমা নারীবাদের বিভিন্ন মতামত ও বয়ানকে ব্যবহার করছেন, নিজেদেরকে হাজির করছেন ‘মুসলিম নারী’র উদ্ধারকর্তা হিসাবে। অর্থাৎ যেসব রাজনৈতিক দল ঐতিহাসিকভাবে তাদের স্বদেশী (খ্রিষ্টান ও ডেনিশ বা ডেনমারকীয় অর্থে) নারীর অধিকারের পক্ষে দাঁড়ায়নি কখনো, তারাই আবার অভিবাসী মুসলিম নারীর উপরে হওয়া অসমতার বিরুদ্ধে নিজেদের হাজির করছে পশ্চিমা নারীবাদের বয়ান ব্যবহার করে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও এই প্রেক্ষিতে পশ্চিমা নারীবাদ পশ্চিমের চরমদক্ষিনপন্থীদের রাজনৈতিক হাতিয়ার বা ‘Political Tool’ হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে।

কিন্তু মুসলিম নারীকে নিয়ে ঔপনিবেশিক শক্তির এই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যতাড়িত বয়ান কিংবা পশ্চিমা নারীবাদের প্রসঙ্গে অতি সাধারণীকরণের কথা যদি আমরা খানিকটা পাশে তুলে রেখে প্রশ্ন করি, এই সকল বয়ানের বাইরে সত্যিকারের প্রাত্যহিক দুনিয়ায় মুসলিম নারীর জীবন কেমন? মুসলিম অধ্যুষিত সমাজগুলোতে নারী কি সমানাধিকার ভোগ করে থাকে? ঘরে ও বাইরে নারীর চলাচল কতটা স্বাভাবিক? শিক্ষায়, পেশায়, পারিশ্রমিকে, জীবনযাপনে, শখে – আহ্লাদে মুসলিম নারী কতটা সমানাধিকার ও নিজের স্বাধীনতা ভোগ করে থাকে? এইসব প্রশ্নের খোঁজে যদি আমরা পশ্চিমা ঔপনিবেশিক ও নয়া-উদারনীতিবাদী দক্ষিনপন্থী বয়ানগুলোর দিকে না-ও তাকাই, আমরা যদি কেবল মুসলিম নারীদের অভিজ্ঞতা থেকেই এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে চাই, যদি মুসলিম সমাজে সারাজীবন ব্যয় করা নারীদের কাছ থেকেই জানতে চাই, তাহলে যে চিত্রটি উঠে আসবে তা খুব একটা আলোকোজ্জ্বল ছবি নয়। সে ছবিটিও ঝাপসা, ধূসর, করুণ, বেদনার। মুসলিম নারীর এই ছবিটিকে আমি বলতে চাই তার দ্বিতীয় ছবি বা বিকল্প ছবি, যা পশ্চিমা ঔপনিবেশিক চোখ দিয়ে দেখা নয়। এই ছবিটি খোদ মুসলিম নারীদের চোখেই দেখা।

মুসলিম নারীর এই পিছিয়ে থাকা, নিপীড়ন ও বঞ্চনার শিকার হওয়ার ইতিহাসকে ব্যাখ্যা করার যে দ্বিতীয় ধারাটি তা হচ্ছে –  খোদ মুসলিম নারী ও নারীবাদী তাত্ত্বিকদেরই ব্যাখ্যা করা। অর্থাৎ শুধুমাত্র পশ্চিমা ঔপনিবেশিক শক্তির তাবেদার রাজনৈতিক মহলই কেবল মুসলিম নারীর এই ‘শোষণমূলক’ ও ‘লিঙ্গ বৈষম্যবাদী’ অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরছে সারা দুনিয়াব্যাপি, তা নয়, বরং  মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজে নারীর বঞ্চনার ইতিহাসকে নিখাদ বাস্তবতা হিসাবে উল্লেখ করে মুসলিম নারীবাদী তাত্ত্বিকেরাও এর কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছেন। মুসলিম নারীবাদীরা নানান বৈচিত্র্যময় ধারায় অনুসন্ধান করেছেন মুসলিম নারীর পিছিয়ে পড়ার ইতিহাস আর তার সাথে ধর্ম হিসাবে ইসলামের সংযুক্তির সম্ভাবনাকে। বিভিন্ন প্রসঙ্গে এইসব নারীবাদী তাত্ত্বিকদের মাঝে মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও একটি বিষয়ে তারা প্রায় সকলেই একমত তা হচ্ছে আজকের জমানায় ‘ইসলাম’ বলে আমাদের সামনে যা হাজির হয়ে আছে এক সুবিশাল সৌধের মতো, তা আসলে অনেকাংশেই আরব পিতৃতন্ত্রের সাংস্কৃতিক রূপ যা গড়ে উঠেছে পিতৃতান্ত্রিক নৈতিকতাভিত্তিক ও পুরুষরচিত তাফসীর বা কুরআনের ব্যাখ্যার উপর ভর করে। ‘ইসলাম’ এর নামে এই আরব পিতৃতন্ত্র দেশে দেশে রফতানি হয়েছে, কখনও সরাসরি ক্ষমতাকেন্দ্রিক উদ্যোগে আবার কখনও বা অর্থনৈতিক সাহায্যের শর্ত হিসাবে। আর এর সাথে যুক্ত হয়েছে স্থানীয় পিতৃতন্ত্রের বহু বছরের ক্ষমতাতান্ত্রিক রীতিনীতি এবং আরও জটিল রূপ ধরে হাজির হয়েছে ‘ধর্ম’ ও ‘ধর্মীয় বিধান’ নামধারণ করে এবং প্রায় সব সমাজেই যার প্রধান শিকার হয়েছে নারী।

অর্থাৎ উপনিবেশবাদী বয়ানই মুসলিম নারীর জীবনের লিঙ্গবৈষম্যবাদী শোষণের অভিজ্ঞতার একমাত্র আখ্যান নয়, বরং মুসলিম জনগোষ্ঠীর বুদ্ধিবৃত্তিক চত্বর থেকেই মুসলিম নারীদের প্রতি পদ্ধতিগত বৈষম্যের বিষয়টি উঠে এসেছে যার সাথে ‘ইসলাম ধর্ম’কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা পিতৃতন্ত্রের সংযোগ সরাসরি। বরং এটা বলা হয়তো ভুল হবেনা যে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো এই সুযোগটিও কাজে লাগিয়েছে তাদের উপনিবেশবাদী বয়ান তৈরি করতে।

এই লেখাটির উদ্দেশ্য 

এই লেখাটির উদ্দেশ্য হচ্ছে পৃথিবীর দেশে দেশে মুসলিম নারীর পিছিয়ে পড়ার, পিছিয়ে থাকার, মুসলিম নারীর লৈঙ্গিক পরিচয়ের কারণে বৈষম্যবাদের শিকার হবার যে অভিজ্ঞতা তার নানান ব্যাখ্যা – বিশ্লেষণকে হাজির করা, খোদ বিশ্বাসী মুসলিম নারীদেরই বয়ানে।  বলাই বাহুল্য এই প্রসঙ্গে মুসলিম নারীদের মতামত কোনো ‘এক পাথরে লেখা’ আখ্যান নয়, বরং এ বিষয়ে নানান মত ও ব্যাখ্যা রয়েছে। যদিও এই সকল নানান মত ও ব্যাখ্যার মাঝেও এক ধরনের মিহি সুতার গাঁথুনি রয়েছে। এই মিহি সুতার গাঁথুনির কাজটি করেছে যা তার নাম হচ্ছে ‘বিশ্বাস’। এরা সকলেই বিশ্বাসী নারী (এবং পুরুষ), এরা সকলেই ইসলাম ধর্মের খুব গভীর মর্মশাঁসটিকে অন্তরে ধারণ করেন। তাই এই লেখাটিতে উপস্থাপন করা হবে বিশ্বাসী মুসলিম নারীর (এবং পুরুষের) বয়ানে মুসলিম নারীর বঞ্চনা ও এই বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রামের আখ্যানকে। যদিও লিখছি বটে ‘বিশ্বাসী মুসলিম নারীর’ বয়ানে এই লেখায় উল্লেখ করবো মুসলিম নারীর বঞ্চনা ও তার বিরুদ্ধে সংগ্রামের আখ্যানকে, কিন্তু বাস্তব ইতিহাস হচ্ছে এই সংগ্রামের নানান বাঁকে অংশগ্রহণ করেছেন অনেক মুসলিম বুদ্ধিবৃত্তিক সক্রিয়তাবাদী মানুষ, লৈঙ্গিক পরিচয়ে যারা পুরুষ। তাই ইসলামী নারীবাদী আখ্যান আসলে কেবল মুসলিম নারীর সংগ্রামের ইতিহাস নয়, সংখ্যায় খুব অল্প হলেও মুসলিম নারীর এই ঐতিহাসিক সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ রয়েছে মুসলিম বিশ্বাসী পুরুষেরও।

সমতা ও ইনসাফ এর লড়াইয়ে শামিল এই সকল বিশ্বাসী নারীদের বয়ান কখনো প্রকাশিত হয়েছে কবিতা, গল্প, সাধারণ কেচ্ছা – কাহিনী, সংবাদ বিশ্লেষণ, সবাদপত্রের কলাম, সরকারের কাছে দাবিনামা এমন কি দীর্ঘ বিদ্যায়তনিক গবেষণার মধ্যে দিয়ে। তাদের সেই সকল লেখালেখির সাথে সংগ্রামী নারীদের পরিচিত করে তোলাও এই রচনাটির আরেকটি উদ্দেশ্য। যেহেতু এই সকল নারীবাদীদের প্রায় সকলেই (অন্তত পক্ষে বড় অংশই) ধর্মবিশ্বাস ও অনুশীলনের দিক থেকে নিজেদের মুসলিম বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন এবং এদের অনেকেই মুসলিম নারীর এই সংগ্রামকে ‘ইসলামী নারীবাদ’ হিসাবে উল্লেখ করেছেন, তাই এই রচনাটির শিরোনামে ‘ইসলামী নারীবাদ’ শব্দবন্ধটি ব্যবহার করা হয়েছে। ‘ইসলামী নারীবাদ’ এই ধারণা নিয়ে মুসলিম নারীবাদীদের মতামত আরও একটু বিশদ উল্লেখ করা হবে এই প্রবন্ধে।

স্থান কাল ও পাত্র 

বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলে নারীবাদকে একটি পশ্চিমা প্রপঞ্চ হিসাবেই দেখতে শিখেছি আমরা। নারীবাদের প্রতিপক্ষ মানুষেরা তো বটেই এমনকি নারীর মুক্তি সংগ্রামের পক্ষেরও বহু মানুষ মনে করেন ‘নারীবাদ’ একটি পশ্চিমা প্রপঞ্চ। ডানপন্থী বা বামপন্থী উভয় ঘরানার রাজনীতির সমর্থকদের মাঝেই এই ধারণাটির ব্যাপক প্রচলন রয়েছে যে ‘নারীবাদ’ একটি পশ্চিমা বিষয়। নারীবাদকে পশ্চিমা বিষয় হিসাবে হাজির করার উদ্দেশ্য দ্বিবিধ, এক – পশ্চিমা বলে একে যেমন ‘অভিজাত’ হিসাবে দাঁড় করানো যায় তেমনি কেবল পশ্চিমা চিন্তা এমন হবার কারণেই একে ঔপনিবেশিক বলে খারিজও করে দেয়া যায়। নারীবাদকে কেবল ‘পশ্চিমা’ হিসাবে এক ‘মোটা তুলি’ দিয়ে রঙ করানোর প্রচেষ্টা নিশ্চিতভাবেই উদ্দেশ্য প্রণোদিত, কেননা খোদ পশ্চিমা নারীবাদীদের মাঝেই রয়েছে মোটা দাগে দশ – বারোটি ভাগ (কিংবা আরও অনেক বেশি)। অন্তত তাত্ত্বিক দিক থেকে প্রধান পাঁচ – ছয় ধারার সাথে আমরা বাংলা ভাষাতেই পরিচিত এবং এদের মাঝে রয়েছে মৌলিক ভিন্নমত ও পথের উপস্থিতি। সুতরাং নারীবাদকে কেবল ‘পশ্চিমা’ ধ্যান ধারণা এইভাবে চিহ্নিত করার প্রচেষ্টা আর তার উপরে ভর করে তাকে খারিজ করে দেয়ার চেষ্টা আর যাই হোক নারীর পক্ষের সংগ্রামের সহায়ক নয়। আবার নারীবাদ পশ্চিমা বলে তাকে ‘ঔপনিবেশিক তল্পিবাহক’ তকমা দিয়ে খারিজ করে দেয়াটাও এক ধরনের অন্ধত্ব, একদেশদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি, কেননা এই পশ্চিমের নারীবাদীদের মাঝেই একটা উল্লেখযোগ্য ধারা রয়েছে যারা দেশে দেশে ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে ইতিহাসের নানান পর্বে। মিশরের উনিশ শতকের নারীবাদী মালাক হিফনি নাসিফ বলেছিলেন, ‘যা সালাম পাবার যোগ্য, তাকে তো সালাম করতে হবে, তা সে পশ্চিমা হোক বা নিজ দেশের হোক’। অর্থাৎ নারীবাদ যদি নারীর মুক্তির প্রশ্নে সংগ্রামের কথা বলে, সংগ্রামের সাথে যুক্ত হবার আহ্বান করে, তাকে কেবল পশ্চিমা – অপশ্চিমা এই বিভাজনে ফেলে বিভেদজ্ঞান করার প্রবণতাকেও সন্দেহের চোখে দেখা দরকার।

বাংলাদেশে সম্ভবত নারীবাদ প্রসঙ্গ নিয়ে প্রথম গোছানো বই পেয়েছি আমরা অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের লেখা ‘নারী’ বইটির মাধ্যমে। যেখানে তিনি বিষয় হিসাবে নারীবাদকে আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন ইউরোপীয় নারীবাদের মাধ্যমে। হুমায়ুন আজাদের ‘নারী’ পুস্তকে পশ্চিমের নারীবাদীদের চিন্তার সাথে তুলনামূলকভাবে হাজির করেছেন ভারতবর্ষের নারীর অধিকারের ‘শত্রু-মিত্র’দের, সেখানে এসেছেন রাজা রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর এবং বেগম রোকেয়া। বইটির শেষ অংশে অধ্যাপক আজাদ নারীবাদের একটি কালপঞ্জী উল্লেখ করেছেন সেই কালপঞ্জি তিনি শুরু করেছেন ইউরোপীয় নারীবাদী মেরি ওলস্টোনক্রাফটকে দিয়ে যখন সময়কাল ছিল ১৭৯২ সাল আর এই কালপঞ্জি তিনি শেষ করেছেন তার নিজেকে দিয়ে, ১৯৯৫ সালে তার নিজের গ্রন্থ ‘নারী’ নিষিদ্ধ হবার ঘটনা এবং ২০০১ সালে উচ্চ আদালতে ‘নারী’র নিষিদ্ধ ঘোষণা অবৈধ হবার রায় এর তথ্য দিয়ে। অর্থাৎ আজাদের নারীবাদী ইতিহাসের কালপঞ্জিতে ইউরোপীয় নারীবাদীরা আছেন, ভারতীয় নারীবাদীরা আছেন, এমন কি বাংলাদেশের নারীবাদী হুমায়ুন আজাদও আছেন, কিন্তু এক ফোঁটাও নেই যে ইতিহাস তা হচ্ছে আরব, মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা ও পারস্যের নারীবাদীদের উল্লেখ। সেখানে নেই সিরিয়া, জর্ডান, প্যালেস্টাইন, ইরাক, মিশর, ইরান, কুয়েত, আরব আমিরাত, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, মরক্কো, তিউনিসিয়া, ইয়েমেন এর নারীবাদীদের ইতিহাস, যারা ঘটনাক্রমে ধর্ম বিশ্বাসের দিক থেকে মুসলমান (শুধুমাত্র মিশরের সেক্যুলার নারীবাদী নাওয়াল সাদাওই’র চাকুরী হারানোর ও কারারুদ্ধ হবার ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন হুমায়ুন আজাদ)। অর্থাৎ আজাদের ‘নারী’তে নারীবাদের ইতিহাসের যে পর্বটি বাদ পড়েছে, সেই পর্বটিই এই লেখার মূল আগ্রহের বিষয়। সময়কালটি হচ্ছে ঠিক একই সময়কাল যখন ইউরোপের পাশাপাশি আরব, মধ্যপ্রাচ্য, পারস্য ও উত্তর আফ্রিকার নারীবাদীরা সংগঠিত হচ্ছেন তাদের প্রতিবাদ নিয়ে, ১৮০০ সাল থেকে আজকের সময় পর্যন্ত। অবশ্য বলে রাখা ভালো যে অধ্যাপক আজাদের ‘নারী’র উল্লেখ করা হলো কেবলই প্রসঙ্গক্রমে। আজাদের কাজে ইসলামী নারীবাদ ও ইসলামী নারীবাদীদের বাদ পড়ে যাওয়াটা একেবারেই অনিচ্ছাকৃত হতে পারে এবং কেবলই বইটির আওতা বা Scope এর কারণেই হতে পারে। একই বইয়ে দুনিয়ার সকল নারীবাদকে তুলে ধরা নিশ্চিতভাবেই খুব কঠিন কাজ এমন কি আবশ্যকও নয়।

বর্তমান লেখাটির পদ্ধতি  

এই লেখাটি ইসলামী নারীবাদের ‘ইতিহাস’ নয়। বরং এই লেখার মধ্যে দিয়ে সেই সকল নারীদের ভাবনাগুলোকে উপস্থাপন করা হবে যারা ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে অনুধাবন করেছিলেন মুসলিম সমাজে নারীর অবস্থান সমতাভিত্তিক নয়। শুধু এ অনুধাবন করেই এরা থেমে থাকেন নি, তারা এর কারণ অনুসন্ধান করেছেন, এই বঞ্চনার অবসান ঘটানোর উদ্দেশ্যে তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা রচনা করেছে এবং এর পাশাপাশি নারীর মুক্তির জন্যে পথের সংগ্রাম করেছেন। সুতরাং এই লেখায় ব্যক্তি নারী ও তাদের ভাবনাগুলো উঠে আসবে, যা এখন পর্যন্ত আমাদের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলের মূলধারার নারীবাদী আলাপ আলোচনায় বিস্ময়করভাবে অনুপস্থিত।

এই লেখাটি বিদ্যায়তনিক ঢঙের নয়, লেখাটি বিদ্যায়তনিক পাঠকের উদ্দেশ্যেও রচিত নয়। এই লেখাটির পদ্ধতি বা মেথডকে খুব নিয়মানুগ বা Systematic দাবি করছি না। ইসলামী নারীবাদের উপরে হাতের কাছে সুলভ কিছু বই, গুগল স্কলার থেকে নির্বাচিত বিদ্যায়তনিক গবেষক ও পণ্ডিতদের কিছু পরিচিত নিবন্ধ, সংবাদপত্রের চলতি সংবাদ মতামত ইত্যাদির উপরে ভিত্তি করেই লেখাটি প্রস্তুত করা হয়েছে। বিদ্যায়তনিক লেখালেখিতে যে ‘systematic search and review’ বা ‘নিয়মানুগ পর্যালোচনা’র আশ্রয় নেয়া হয় তা এই লেখার জন্যে করা হয়নি। সুতরাং লেখাটিকে এইসব সীমাবদ্ধতার কথা মাথায় রেখেই পাঠ করতে হবে। সহজবোধ্যতার জন্যে লেখাটিকে পরিকল্পিতভাবেই রেফারেন্স বা তথ্যসূত্র ভারাক্রান্ত করা হবে না, তবে প্রয়োজনীয় সূত্রগুলো সাধারণভাবে যুক্ত করে দেয়া হবে। প্রয়োজনে তথ্যসূত্রগুলো ক্রমান্বয়ে হালনাগাদ করা হবে।

[চলবে]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *