পর্ব-২০: দানবীয়তায় ঝোঁক আর মিথ্যে দিয়ে নিজেকে পুনরাবিষ্কার
শিল্প সমালোচক, লেখক শার্লট মালিন্সের A Little Feminist History of Art বইটি বাংলায় অনুবাদ করছেন বিশিষ্ট অনুবাদক, শিক্ষক জি এইচ হাবীব। বইটির অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হচ্ছে ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে। আজ পড়ুন এর বিশতম পর্ব। সব পাঠকের সুবিধার জন্য প্রতি পর্বের শুরুতে বইটির এবং লেখক শার্লট মালিন্সের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দেয়া থাকবে।।
[নারীবাদী শিল্প আন্দোলনের শুরু ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে। পুরুষ প্রাধান্যবিশিষ্ট রঙ্গমঞ্চে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়ার জন্যে সে সময় নারী শিল্পীরা তাঁদের কাজগুলোর জেন্ডারচ্যুতি ঘটাবার সংগ্রামে নামেন। এরপর থেকে সেই আন্দোলন শিল্প জগতে গোটা বিশ্বজুড়ে অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন ক’রে আসছে। ‘নন্দনতাত্ত্বিক ফরমালিযম’ ব’লে অভিহিত যুগের পর সামাজিকভাবে প্রাসঙ্গিক নানান ইস্যুতে কথা বলার জন্য ‘নারীদৃষ্টি’-র সাহায্যে নারী শিল্পীরা বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ ক’রে জেন্ডার, পরিচয় এবং ফর্মের দিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন, সমালোচনা করেছেন সাংস্কৃতিক প্রত্যাশাগুলোকে এবং নারীকে সনাতনী দৈনন্দিন ধারণায় আটকে ফেলার ব্যাপারটিকে। সমাজের দৃষ্টি ঘোরাতে চেয়েছেন সাম্যের জন্যে নারীর সংগ্রাম এবং নারীদেহকে পণ্য হিসেবে দেখবার মানসিকতা ও ক্রিয়াকর্মের দিকে। “অল্প কথায় নারীবাদী শিল্প-ইতিহাস” (A Little Feminist History of Art) নামের ছোট্ট বইটিকে এই আন্দোলনের ফসল হিসেবে জাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু শিল্পকর্মের সংক্ষিপ্ত কিন্তু সারগর্ভ ভূমিকা বলা যেতে পারে। ১৯৬০-এর দশক থেকে বর্তমান কাল অব্দি পঞ্চাশটি অসামান্য কাজ নারীর জীবন ও অভিজ্ঞতাকে তুলে ধরেছে। সেই সঙ্গে, ভিয্যুয়াল সংস্কৃতির ওপর নারীবাদী আদর্শ ও রাজনীতি যে প্রভাব ফেলেছে সেটাও এই কাজগুলো মেলে ধরেছে। “অল্প কথায় নারীবাদী শিল্প-ইতিহাস” নামের এই গ্রন্থটি জেন্ডার বৈষম্য, যৌনতা, গার্হস্থ্য জীবন, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর নারী দেহের মতো বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা বিংশ শতকের সবচাইতে উচ্চাকাঙ্ক্ষী, প্রভাবশালী ও টেকসই শৈল্পিক আন্দোলনগুলোর একটির আনন্দ উদযাপন।
শার্লট মালিন্স একজন শিল্প সমালোচক, লেখক এবং সম্প্রচারক। তিনি রেচল হোয়াইরিড, সেসিলি ব্রাউন, র্যাচেল লামসডেন, জেনি স্যাভিল, ক্যাথে ডে মনসাউক্স, স্যু অ্যারোস্মিদ, সুজ্যান কুন, স্যুযি হ্যামিলটন এবং পলা রেগোসহ বিভিন্ন নারী শিল্পীকে নিয়ে লেখালেখি করেছেন। তাঁর রচিত ও প্রকাশিত বিভিন্ন গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে “লাইভ্স অভ দ্য গ্রেট আর্টিস্টস” (২০০৮) এবং “র্যাচেল হোয়াইহেড” (২০০৭)। তিনি বিবিসি রেডিও ফোর-এর “ফ্রন্ট রো” এবং “স্যাটারডে রিভিউ’’-র নিয়মিত প্রদায়ক]
লী বুল (Lee Bul)
(জন্ম ১৯৬৪)
আমাদের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে-সমস্ত চিন্তাধারা ঢুকে আছে সেগুলো লী বুল তাঁর শিল্পকর্মের মাধ্যমে উন্মোচন ক’রে দিয়ে পিতৃতান্ত্রিক কর্তৃত্ব আর নারীকে প্রান্তিক দশায় ঠেলে দেয়ার বিষয়গুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন। তাঁর প্রথম দিকের কাজগুলো ছিল পারফরমেন্স, সিওলের আশেপাশে বাড়িতে-তৈরি জটিল কস্টিউম পরে তিনি সেসব পারফরমেন্স করতেন। পোশাকগুলো হোতো অদ্ভুত রকমের স্ফীতি আর অনভিপ্রেত অঙ্গবৃদ্ধি বিশিষ্ট। Untitled (Cravings White) ছিল তাঁর ১৯৮৯ সালের পারফরমেন্স Cravings –এর পোশাক (এক বন্যায় স্টুডিওটি পানিতে সয়লাব হয়ে গিয়ে সেটা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ২০১১ সালে পোশাকটি আবার তৈরি করা হয়)। পরিচ্ছদটির মানুষের মতো এবং অদ্ভুতুড়ে কাঠামোতে একটা স্বপ্নসুলভ বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা ১৯৬০-এর দশকের ইয়াইওয়ি কুসামা-র (Yayoi Kusama) Accumulations-এর কথা মনে পড়িয়ে দেয়। জিনিসটাকে এখন একটা বস্তুর মতো লাগে বটে, কিন্তু মনে হয় যে-কোনো মুহূর্তে সেটার মধ্যে প্রাণের সঞ্চার হবে, ওল বা কন্দের মতো স্ফীতিগুলো আগ্রাসী হাতের মতো আঁকড়ে ধরবে।
লী বুল-এর গোড়ার দিকের পারফরমেন্সগুলো রাস্তায় হোতো, অথবা খুবই শুকনো ভূমিতে, যেমনটি Cravings হয়েছিল। পোশাকের ভেতর লুকানো মাইক্রোফোনগুলো মাটির ওপর দিয়ে ছুটে চলা তাঁর দেহের নানান শব্দ বাড়িয়ে দিচ্ছিল। শুরুর দিকের অন্যান্য পারফরমেন্সে তিনি পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারী হওয়ার অবমাননা নিয়ে কথা তুলেছিলেন। দক্ষিণ কোরীয় নারীদের ওপর চাপিয়ে দেয়া প্রত্যাশাগুলোকে তিনি চ্যালেঞ্জ করতে চেয়েছিলেন। এবং পারফরমেন্সের সময় পরার জন্য তিনি যেসব পোশাক তৈরি করেছিলেন সেগুলো প্রায়ই হতো অদ্ভুতড়ে রকমের ফোলা। লী এর ঝোঁকটা দানবীয়তার দিকে, যা ‘নির্দেশিত সীমানা পেরিয়ে যায়’।
শিল্পকর্ম পরিচিতি:
Untitled (Cravings White) ১৯৮৮ (২০১১ সালে পুনর্নির্মিত)
কাপড়, এক্রিলিক পেইন্ট, কাঠ, মরিচা ধরে না এমন ইস্পাতের তৈরি ক্যারাবিনার, এবং একই উপাদানের শেকল
২৪৪ X ১৫৫ X ৯৫
আমালিয়া উলম্যান (Amalia Ulman)
(জন্ম ১৯৮৯)
স্ক্রিপ্টভিত্তিক “লাইভ“ পারফরমেন্সের মাধ্যমে বাস্তব আর কল্পনার সীমারেখা ঝাপসা ক’রে দিয়ে আর্জেন্টিনার তরুণ শিল্পী আমালিয়া উলম্যান ২০১৪ সালে পাঁচ মাস ধ’রে ইন্সটাগ্রামে (@amaliaulman) নিজেকে পুনরাবিষ্কার ক’রে গিয়েছিলেন। পোস্টগুলো নিয়ে তাঁর বন্ধুরা নানান প্রশ্ন তুলেছিলেন, অপরিচিতরা তাঁকে অভব্য অশালীন প্রস্তাব পাঠিয়েছিল, আর তাঁর শেয়ার করা নানান ছবি, ক্যাপশন আর ইমোজির মাধ্যমে তিনি যেসব গল্প বলেছিলেন অন্যরা সেসবের সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করেছিলেন। নিজেকে তিনি লস এঞ্জেলেস-এর এমন এক তরুণী হিসেবে উপস্থাপন করলেন যিনি নিজের ‘উত্তরণ’ ঘটাতে চান। নানান জিনিস পোস্ট করতেন তিনি: উচ্চাকাঙ্ক্ষামূলক উদ্ধৃতি, ছুটি কাটানোর ছবি, ল্যাঞ্জেরি (lingerie) পরিহিত সেলফি, স্তন বড় করার অপারেশনের একটা ছবি (সেটা অবশ্য জাল), প্রেমাবসান, গোলাপ পাপড়ি, মেক-আপের তুলি, বন্দুক। স্বর্ণকেশী থেকে তিনি কালোকেশীতে পরিণত হলেন – “কারণ আমার চুল সোনালী হওয়াতে লোকে আমায় নির্বোধ ভাবে, এটা দেখে দেখে আমি তিতিবিরক্ত হয়ে গিয়েছিলাম।” – এবং তাঁর ৮৯,০০০ ফলোয়ারের সঙ্গে কথা বলতেন।
ইন্সটাগ্রামের রীতি অনুযায়ী তিনি অতিরঞ্জিত পোস্ট দিতেন, কিন্তু তাঁর অনলাইন জীবনের প্রেক্ষিতে সেসব বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করেছিল। শেষ অব্দি তাঁর ‘fiction’ অসংখ্য মানুষের ‘truth’ ব’লে পরিণত হলো। “আমি ‘ফিকশন’ ব্যবহার করায় লোকজন আমার ওপর ভীষণ ক্ষেপে গেল। Excellences and Perfections –এর ব্যাপারে এটাই ছিল প্রধান সমালোচনা : ‘এসব সত্য ছিল না? কী সাহস আপনার! আপনি মানুষের কাছে মিথ্যে বললেন!’ দেখুন, কাজটা করেছি কারণ অনলাইনে সবাই মিথ্যে কথা বলছে। আমিই প্রথম নই।”
শিল্পকর্ম পরিচিতি:
Excellences and Perfections (ইন্সটাগ্রাম আপডেট, ৫ই সেপ্টেম্বর ২০১৪) ২০১৫
ইন্সটাগ্রামে পাঁচ মাসব্যাপী পারফরমেন্স। ১৫ই এপ্রিল থেকে ১৪ই সেপ্টেম্বর ২০১৪
(চলবে)
পর্ব-১: শিরীন নিশাত ও যারিনা হাশমি- দ্রোহ আর স্মৃতিকাতরতা
পর্ব-২: মহাজাগতিক সৃজনকারী শক্তি ও নারীর স্বরূপে ফেরা
পর্ব-৩: শিল্পের নতুন বিষয় ও শিল্পীর শরীর
পর্ব-৪: শ্রম বৈষম্য এবং সন্তান পালনের দলিল
পর্ব-৫: নারীর প্রতীকী ইতিহাস এবং শিল্পকর্ম হিসেবে দেহ
পর্ব-৬: দেহ ভাস্কর্য ও চিরন্তন মাতৃসত্তার বিরুদ্ধচিত্র
পর্ব-৭: গার্হস্থ্য জীবন আর অন-স্ক্রীন নারীত্বের স্বরূপ উন্মোচন
পর্ব-৮: দেহাস্ত্র এবং অনিরপেক্ষ প্রতিচ্ছবি
পর্ব-৯: বোধ স্বতন্ত্র এবং ফিউশন অস্বস্তিকর
পর্ব-১০ নির্যাতন নিরন্তর ও পিতৃতান্ত্রিক বিশ্বে নারী হওয়ার জটিলতা
পর্ব-১১: ব্যক্তিগত ক্ষমতায়ন এবং কৃষ্ণাঙ্গ নারী সমকামীর অভিজ্ঞতা
পর্ব-১২: পেশল বাস্তবতা আর পূর্বকল্পিত জেন্ডার বিষয়ক মতামত
পর্ব-১৩: সঙ্গীতের মহাফেজখানা আর ঐতিহাসিক পেইন্টিং-এর ভিন্ন বয়ান
পর্ব-১৪: সাদা কার্ড বাদামি কার্ড আর নারীর চোখে নারী
পর্ব-১৫: দৈনন্দিনের একঘেয়েমি আর শিল্পে গেরিলাযুদ্ধ
পর্ব-১৬: আশ্রয়স্থল কিংবা কারাগার আর ফিমেল আর্টের অনুসন্ধান
পর্ব-১৭: নারীর দেহভাষা আর পুরুষের প্রত্যাশার বিরুদ্ধাচারণ
পর্ব-১৮: পরিচয় পুনরুদ্ধার এবং ইতিহাসে স্থান পুনর্দখল
পর্ব-১৯: সহজাত প্রবৃত্তিভিত্তিক শিল্প আর শিশু ও মাতার ভিন্ন যাত্রা