November 23, 2024
অনুবাদসাহিত্যফিচার ২বই নিয়ে আলাপ

পর্ব-২২: প্রকল্প সমবায়ী এবং শারীরিক অনুভূতির শিল্পরূপ

শিল্প সমালোচক, লেখক শার্লট মালিন্সের A Little Feminist History of Art বইটি বাংলায় অনুবাদ করছেন বিশিষ্ট অনুবাদক, শিক্ষক জি এইচ হাবীব। বইটির অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হচ্ছে ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে। আজ পড়ুন এর বাইশতম পর্ব। সব পাঠকের সুবিধার জন্য প্রতি পর্বের শুরুতে বইটির এবং লেখক শার্লট মালিন্সের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দেয়া থাকবে।।

[নারীবাদী শিল্প আন্দোলনের শুরু ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে। পুরুষ প্রাধান্যবিশিষ্ট রঙ্গমঞ্চে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়ার জন্যে সে সময় নারী শিল্পীরা তাঁদের কাজগুলোর জেন্ডারচ্যুতি ঘটাবার সংগ্রামে নামেন। এরপর থেকে সেই আন্দোলন শিল্প জগতে গোটা বিশ্বজুড়ে অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন ক’রে আসছে। ‘নন্দনতাত্ত্বিক ফরমালিযম’ ব’লে অভিহিত যুগের পর সামাজিকভাবে প্রাসঙ্গিক নানান ইস্যুতে কথা বলার জন্য ‘নারীদৃষ্টি’-র সাহায্যে নারী শিল্পীরা বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ ক’রে জেন্ডার, পরিচয় এবং ফর্মের দিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন, সমালোচনা করেছেন সাংস্কৃতিক প্রত্যাশাগুলোকে এবং নারীকে সনাতনী দৈনন্দিন ধারণায় আটকে ফেলার ব্যাপারটিকে। সমাজের দৃষ্টি ঘোরাতে চেয়েছেন সাম্যের জন্যে নারীর সংগ্রাম এবং নারীদেহকে পণ্য হিসেবে দেখবার মানসিকতা ও ক্রিয়াকর্মের দিকে। “অল্প কথায় নারীবাদী শিল্প-ইতিহাস” (A Little Feminist History of Art) নামের ছোট্ট বইটিকে এই আন্দোলনের ফসল হিসেবে জাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু শিল্পকর্মের সংক্ষিপ্ত কিন্তু সারগর্ভ ভূমিকা বলা যেতে পারে। ১৯৬০-এর দশক থেকে বর্তমান কাল অব্দি পঞ্চাশটি অসামান্য কাজ নারীর জীবন ও অভিজ্ঞতাকে তুলে ধরেছে। সেই সঙ্গে, ভিয্যুয়াল সংস্কৃতির ওপর নারীবাদী আদর্শ ও রাজনীতি যে প্রভাব ফেলেছে সেটাও এই কাজগুলো মেলে ধরেছে। “অল্প কথায় নারীবাদী শিল্প-ইতিহাস” নামের এই গ্রন্থটি জেন্ডার বৈষম্য, যৌনতা, গার্হস্থ্য জীবন, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর নারী দেহের মতো বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা বিংশ শতকের সবচাইতে উচ্চাকাঙ্ক্ষী, প্রভাবশালী ও টেকসই শৈল্পিক আন্দোলনগুলোর একটির আনন্দ উদযাপন। 

শার্লট মালিন্স একজন শিল্প সমালোচক, লেখক এবং সম্প্রচারক। তিনি রেচল হোয়াইরিড, সেসিলি ব্রাউন, র‌্যাচেল লামসডেন,  জেনি স্যাভিল, ক্যাথে ডে মনসাউক্স, স্যু অ্যারোস্মিদ, সুজ্যান কুন, স্যুযি হ্যামিলটন এবং পলা রেগোসহ বিভিন্ন নারী শিল্পীকে নিয়ে লেখালেখি করেছেন। তাঁর রচিত ও প্রকাশিত বিভিন্ন গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে “লাইভ্স অভ দ্য গ্রেট আর্টিস্টস” (২০০৮) এবং “র‌্যাচেল হোয়াইহেড” (২০০৭)। তিনি বিবিসি রেডিও ফোর-এর “ফ্রন্ট রো” এবং “স্যাটারডে রিভিউ’’-র নিয়মিত প্রদায়ক]

সুযান লেসি (Suzanne Lacy)

(জন্ম ১৯৪৫)

মিনিয়াপলিসের একটি বড় শপিং মল ১৯৮৭ সালের ‘মা দিবস’-এ একঘণ্টা কালের একটি পারফরমেন্সের মঞ্চে পরিণত হয়েছিল। আর ঘটনাটা ছিল সুযান লেসির তিন বছর দীর্ঘ প্রকল্পের চূড়ান্ত পর্ব। চার জন ক’রে বসতে পারে এমন বেশ কিছু টেবিলে মোট চারশ তিরিশ জন নারী আসন গ্রহণ করেছিলেন। প্রতি দশ মিনিট অন্তর সেই নারীদের হাতগুলো একটা বিশেষ নকশায় বদলে যাচ্ছিল ওপর থেকে এই পারফরমেন্স উপভোগ করতে থাকা ৩০০০ দর্শকের উদ্দেশে বাজানো ‍সান স্টোনের সঙ্গীতের তালে তালে।

The Crystal Quilt  ছিল সেসময় অব্দি সুযান লেসির সবচাইতে উচ্চাকাঙ্ক্ষী কাজ। শিল্পী ব্যাখ্যা ক’রে বলছেন, “কাজটায় দুটো থিমকে ঘিরে একটা জটিল স্ট্র্যাটেজি অবলম্বন করা হয়েছে। একটা হচ্ছে অপেক্ষাকৃত বয়স্ক নারীদের দৃশ্যমানতা এবং অদৃশ্যমানতা, আর অন্যটি হলো তাঁদের নেতৃত্বদানের ক্ষমতা।” এই প্রকল্পে ষাটোর্ধ নারীদের তুলে ধরা হয়েছিল, এবং সেই সঙ্গে ছিল শিল্প প্রদর্শনী, বক্তৃতা, আর আলোচনা সভা। প্রকল্পটির পারফরমেন্সকে চিহ্নিত করতে আর সেটার পারস্পরিক সহযোগিতামূলক দিকটিকে প্রতীকের মাধ্যমে তুলে ধরতে মিরিয়াম শাপিরোর একটি চিত্রকর্ম অনুসরণে একটি কাঁথা তৈরি করা হয়েছিল, আর সেটা একটা ব্যাকড্রপ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল।

লেসি তাঁর কাজ সাধারণত একা করেন না, আরো কিছু মানুষকে সেটার সঙ্গে সম্পৃক্ত ক’রে নেন, এবং কোনো পারফরমেন্স বা অ্যাকশনের সঙ্গে তিনি ব্যবহারিক কর্মশালা ও বক্তৃতাও যোগ করেন। ১৯৭৮ সালে তাঁর গোড়ার দিকের একটি কাজ In Mourning and In Rage-এ তিনি লস এঞ্জেলস-এ সাম্প্রতিককালে পরপর সংঘটিত কিছু হত্যা আর ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদ হিসেবে একটা অন্তেষ্ট্যিক্রিয়ামূলক শবযাত্রার আয়োজন করেছিলেন।

 

শিল্পকর্ম পরিচিতি:

The Crystal Quilt  ১৯৮৫-৭

তুলোর লেপ, ৩৬টি আলোকচিত্র, স্বাক্ষরিত পোস্টার, পারফরমেন্স-এর রেকর্ডিং, টেপে সাউন্ডট্র্যাক, সিঙ্গেল-স্ক্রীন ডকুমেন্টারি উইদ অডিও

৫০ মিনিট দীর্ঘ, সিঙ্গেল-স্ক্রীন ১৬ এমএম ফিল্ম প্রজেকশন (স্থয়িত্বকাল ২ মিনিট)

হেলেন চ্যাডউইক (Helen Chadwick)

(১৯৫৩ – ১৯৯৬)

হেলেন চ্যাডউইকের সবচাইতে উচ্চাকাঙক্ষী ইন্সটলেশন The Oval Court-কে তাঁর ভ্রাম্যমাণ শো Of Mutability-র মধ্যমণি বলা যেতে পারে, ১৯৮৬ সালে লন্ডনের দ্য ইন্সটিটিউট অভ্ মডার্ন আর্ট থেকে যার যাত্রা শুরু হয়েছিল। একটা অফিস কপিয়ারে ব্লু টোনার ব্যবহার ক’রে সেটা তৈরি করা হয়েছিল। একটা রাজহাঁস, একটা মেষশাবক আর একটা রে মাছের ছবির ফটোকপির সঙ্গে নিজের নগ্ন দেহের ফটোকপি আর চারপাশে কয়েক বুশেল গম আর বেশ কিছু ফুল ছড়িয়ে একটি কোলাজ তৈরি করেছিলেন তিনি। ফিগারগুলো দেখে মনে হয় যেন সেগুলো পানির নীচে রয়েছে। তলটার ওপর পাঁচটা সোনালী গোলক ছড়িয়ে দেয়া, আর ওদিকে চ্যাডউকের কিছু প্রতিকৃতি দেয়ালজুড়ে থাকা অলংকৃত স্তম্ভের চূড়ায় শোভা পাচ্ছে, যেখানে চ্যাডউকের অশ্রুর ফোঁটাগুলো দেখতে পাতার মতো।

এই জগতে নারী হওয়া বলতে কী বোঝায় সেটি চ্যাডউকের সার্বক্ষণিক অনুসন্ধানের বিষয়। The Oval Court- দেখলে মনে হয় যেন কেবল নারীই অবশিষ্ট রয়েছে, আর সব কিছু বিলুপ্ত, এবং সেই নারীরা প্রকৃতিকে আলিঙ্গন ক’রে আছে ব্যক্তিগত পৌরাণিক আখ্যানের মধ্যে। কাজটার মধ্যে একটা সুপ্ত যৌনতা রয়েছে – রে মাছটির ইঙ্গিতময় তলপেট, লেডা আর রাজহাঁসের সর্পিল বাঁক, চ্যাডউকের গোগ্রাস ফল ভক্ষণ। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, “দেহের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া শারীরিক অনুভূতিগুলোকে আমি ধরতে চাই- হাঁপানোর, আকুলতার, শ্বাস-প্রশ্বাসের, পরিপূর্ণতার অনুভূতিগুলোকে। এইসব অনুভূতির প্রত্যেকটিই, মোড় ফেরার আগে আনন্দে একেবারে ফুলে ওঠে, ক্ষয়ে যেতে শুরু করার আগে, ফাঁকা হয়ে যাওয়ার আগে প্রত্যেকটি অনুভূতি পরিপূর্ণতার শিখরে পৌঁছয়।”

শিল্পকর্ম পরিচিতি:

The Oval Court ১৯৮৬

সায়ান পাউডার টোনার ব্যবহার ক’রে করা ফটোকপি, জেসো দিয়ে ফিনিশ করা টারনড প্লাই উড

গোল্ড সাইয এবং গোল্ড লীফ

বিচিত্র মাত্রিক

(চলবে)

পর্ব-১: শিরীন নিশাত ও যারিনা হাশমি- দ্রোহ আর স্মৃতিকাতরতা

পর্ব-২: মহাজাগতিক সৃজনকারী শক্তি ও নারীর স্বরূপে ফেরা

পর্ব-৩: শিল্পের নতুন বিষয় ও শিল্পীর শরীর

পর্ব-৪: শ্রম বৈষম্য এবং সন্তান পালনের দলিল

পর্ব-৫: নারীর প্রতীকী ইতিহাস এবং শিল্পকর্ম হিসেবে দেহ

পর্ব-৬: দেহ ভাস্কর্য ও চিরন্তন মাতৃসত্তার বিরুদ্ধচিত্র

পর্ব-৭: গার্হস্থ্য জীবন আর অন-স্ক্রীন নারীত্বের স্বরূপ উন্মোচন

পর্ব-৮: দেহাস্ত্র এবং অনিরপেক্ষ প্রতিচ্ছবি

পর্ব-৯: বোধ স্বতন্ত্র এবং ফিউশন অস্বস্তিকর

পর্ব-১০ নির্যাতন নিরন্তর ও পিতৃতান্ত্রিক বিশ্বে নারী হওয়ার জটিলতা

পর্ব-১১: ব্যক্তিগত ক্ষমতায়ন এবং কৃষ্ণাঙ্গ নারী সমকামীর অভিজ্ঞতা

পর্ব-১২: পেশল বাস্তবতা আর পূর্বকল্পিত জেন্ডার বিষয়ক মতামত

পর্ব-১৩: সঙ্গীতের মহাফেজখানা আর ঐতিহাসিক পেইন্টিং-এর ভিন্ন বয়ান

পর্ব-১৪: সাদা কার্ড বাদামি কার্ড আর নারীর চোখে নারী

পর্ব-১৫: দৈনন্দিনের একঘেয়েমি আর শিল্পে গেরিলাযুদ্ধ

পর্ব-১৬: আশ্রয়স্থল কিংবা কারাগার আর ফিমেল আর্টের অনুসন্ধান

পর্ব-১৭: নারীর দেহভাষা আর পুরুষের প্রত্যাশার বিরুদ্ধাচারণ

পর্ব-১৮: পরিচয় পুনরুদ্ধার এবং ইতিহাসে স্থান পুনর্দখল

পর্ব-১৯: সহজাত প্রবৃত্তিভিত্তিক শিল্প আর শিশু ও মাতার ভিন্ন যাত্রা

পর্ব-২০: দানবীয়তায় ঝোঁক আর মিথ্যে দিয়ে নিজেকে পুনরাবিষ্কার

পর্ব-২১: জেন্ডার ভিন্নতা ও নারীবাদের মূল্য পরীক্ষা