December 24, 2024
ফিচার ২মুক্তমত

নারীর জীবনের গন্তব্য কখনো বিবাহ হতে পারেনা

শামস আবীরুজ্জামান সিয়াম।। আপাতদৃষ্টিতে যদি বলে উঠি এ সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠের মতে, নারীর জীবনের পরিপূর্ণতা হলো বিবাহে, তাহলে মন্দ ঠেকবে না। এই দিনকতক আগের কথা। আয়মান সাদিক টেড টকে ডাক পায়, সেখানে গিয়ে স্পিচ দিয়ে আসে, ফোর্বস ম্যগাজিনেও পৃথিবীর অন্যতম সফল উদ্যোক্তা হিসেবে আয়মান সাদিকের নাম আসে। তখন সারা দেশ, দেশের মানুষ কমেন্টবাক্সে তাকে অভ্যর্থনা দিয়ে ভরিয়ে দেয়, সবার সে কী গর্ব।

সেই একই জায়গায় মুনজারিন সাহিদের অক্সফোর্ডে ডাক পাওয়ার পর দেখা যায় অভ্যর্থনার পাশাপাশি বেশিরভাগ মানুষের এক বক্তব্য। তা হলো মেয়ে মানুষ কাজ করে কী করবে, বিয়ে করে ফেলা উচিত, বয়স ২২ হয়ে গেছে, এখন কেন চাকরি করবে- এসব বলে নোংরা নিন্দা রটনা করা হয়। আয়মান সাদিক, সাদমান সাদিকদের ক্ষেত্রে এমন কথা নেই, মনোভাব নেই,  এরকম প্রশ্ন নেই আমাদের।

কেন জানেন?

কারণ আমরা মনে করি একজন মেয়ের জীবনের সার্থকতা, পরিপূর্ণতা বিয়ে করায়।

জানেন কেন আমাদের দেশে নারী উদ্যোক্তাদের সাফল্যে উৎসাহিত আমরা করিনা, কেন বীভৎস চারিত্রিক প্রশ্ন করি, নিন্দা রটাই, কেন নারী কর্মজীবী, চাকুরীজীবী, উদ্যোক্তা তৈরিতে সমাজের বিরাট একটা অংশ বৈরী মনোভাব রাখে?

কারণ তারা এ ধারণায় বাধা যে নারীর পরিপূর্ণতা হলো বিয়ে করায়, ভালো স্ত্রী হওয়ায়।

আমি তখন পড়ি ক্লাস ফাইভে, সারাদিন বাসায় থাকতাম, বাসা থেকে কম বেরোতাম, তাই  সমাজের রীতিটা বারো বছরের আমার জানা হলনা। বাবা-মা ওপেন মাইনডেড হওয়ায় কখনো ঠুনকো রীতিতে আমার কান দিতে হলনা। ফাইভে থাকতে আমার ক্লাসমেট ছিলো রুনা। রুনার গল্পটা বলি…

সমাপনী পরীক্ষা যখন কড়া নাড়ছে হঠাৎ একদিন শুনলাম রুনা সমাপনী পরীক্ষা দেবে না। কারণ জিজ্ঞেস করায় জানতে পারলাম তার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। তার পরিবার বললো, রুনাকে বিয়ে দিলেই তো সে সুখি, মেয়ে বড় হয়ে গেছে এখন বিয়ে দিয়ে দিতেই হয়, বিয়েটা সারলেই তো কেল্লা ফতে। মেয়েটাকে তাহলে মানুষ করতে পারলো বুঝি তারা!

অতঃপর সে বছর রুনার সমাপনী পরীক্ষা দেয়াটা আর হয়ে উঠলো না। সে কাঁদলো আমাদের সামনে, তার মা-বাবা বলে উঠলেন,‘‘তোকে বিয়ে দিলে, মানুষ করতে পারলে তো মুক্তি”।

মুক্তি!

শব্দটা আমার বুকে গিয়ে বাধল। তাহলে তার মা-বাবা রুনাকে মুক্ত করতে চায়।

বুঝতে বেগ পেতে হলো না, ব্যাপারটা আরো খারাপ। তার মা-বাবা রুনাকে মুক্তি দিতে চায়না, আমি আবিষ্কার করলাম তারা রুনা থেকে মুক্তি পেতে চায়! তাহলে মেয়ে হয়ে জন্মানোটা হয়ে উঠল বোঝা। আর বিয়ে দিলে হবে বোঝা থেকে মুক্তি, রুনা হয়ে উঠবে মানুষ!

যে ধারণার আদলে এই ভাবনা তীব্রতর তা আমার আর মানা হলো না, আমি কুণ্ঠিত বোধ করলাম।

পরিপূর্ণতা আর মানুষ হয়ে ওঠার সংজ্ঞায়ন আমার পুরোপুরি চেনা হয়নি, বছর বারোর আমি মানতাম একটু ভিন্ন, ভাবতাম পরিপূর্ণতা বা মানুষ হওয়া যখন কেউ তার স্বপ্নকে বাস্তব করতে পারে, তার কাজের মাধ্যমে বেঁচে রয় আর গন্তব্যে পৌছাতে পারে, তখনই সে বুঝুক সে পরিপূর্ণ।

তাহলে ছেলেদের ক্ষেত্রে মানুষ হওয়া ও পরিপূর্ণতার সংজ্ঞায়ন একটা, আর মেয়েদের ক্ষেত্রে আরেকটা কেন? সবাইকে আমরা এক নজরে দেখি বা মূল্যায়ন করি না কেন? সবাইতো মানুষ!

তো আমার আর মানুষ হয়ে ওঠার ব্যাপারটা আদতে তখনই বোধগম্য হলনা, মানুষ হয়ে ওঠা বা পরিপূর্ণতার চলিত রীতিটাও বোঝা হয়ে উঠল না। এ অবস্থা দেখে নিজের উপর করুণা হলো, আজ যদি মেয়ে হয়ে জন্মাতাম তাহলে! যাকগে পুরুষ হয়ে জন্মানোয় সেবারকার জন্য নাহয় রক্ষে পেলাম, বার্থ লটারির জন্য বেঁচে গেলাম!

আরো কয়েক বছর গেলো, তখন ক্লাস এইটে পড়ি, আমার এক বান্ধবী খুব ভালো পড়াশোনা করত, স্বপ্নটাও অনেক বড় ছিল; কিন্তু তার এইটের রেজাল্টটা মনমতো হলনা। দিনকতক পর জানতে পারলাম তারও নাকি বিয়ে হয়ে গেছে, রেজাল্ট খারাপ হওয়ায় তার পরিবার তাকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। তার মা একদিন আমার সামনে বসে গল্প করছেন যে উনি বহুত কষ্টে উনার মেয়েকে এক এলাকার বড়লোকের ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে মানুষ করেছেন।

আর আমি?

আমি তখন উনার গল্পতে আমার বন্ধুর মানুষ হয়ে উঠা দেখছিলাম। কিন্তু তখনকার আমারও ব্যাপারটা মেনে নেয়া হলোনা, আবিষ্কার করলাম রেজাল্ট খারাপ করলে মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিতে হয়।

ভাবলাম হায় সেলুকাস!

বড্ড বিচিত্র এ পৃথিবী। একজন ছেলের ক্ষেত্রে যদি আজ এই রেজাল্ট হতো তাহলে তাকে এই দিকে ঠেলে দেয়া হতোনা কিন্তু আজ শুধু মেয়ে বলে এ পরিণতি সহ্য করতে হলো তার।  নিজের রেজাল্টটাও নিজের জন্য রইলো না!

এ সমাজে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মেয়েদের পড়ানো হয় তারা যাতে তাদের স্বপ্নে বাঁচে, স্বপ্ন দেখে এ আশা নিয়ে নয় বরং ভালো রেজাল্ট করে ভালো একটা জায়গায় যাতে বিয়ে করতে পারে এ আশায়, আবার রেজাল্ট খারাপ করলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এক কথা-‘‘তোকে কে বিয়ে করবে?”

অনেককে তো বিয়ে দিয়েই দেয়া হয়।

ভাবতে আশ্চর্য লাগলো আমরাই ছেলেরা যেখানে পড়ালেখা করলে বাইরে কাজ করার জন্য সাপোর্ট করি, বলি তখনই সে প্রতিষ্ঠিত সেখানে এই আমরাই মেয়েদের পড়ালেখা  বা বড় ডিগ্রি অর্জনের পর একই কথা বলতে কুণ্ঠিত হই, তখন তার সার্থকতা হয় বাইরে জব করায় নয় বরং বিয়ে করাতে।

কিচ্ছুই কান এড়ালো না, সমাজের নোংরামো দেখে চলেছি, তখন আরেক ধাক্কা, নাইনে পড়ি, হঠাৎ বাবা মারা গেলেন। সব গেলো বদলে। বড় বোন কলেজে উঠল,তার ইচ্ছে সে বিসিএস দিবে, চাকরি করবে। কিন্তু ঠিক তখন এক তথাকথিত আত্মীয় কল দিয়ে বলে উঠলো, মেয়ের জন্য ভালো বর দেখেছেন, পড়ালেখা করে কী হবে, বিয়েটা করিয়ে দেয়া উচিত।

অন্তত মা মানুষকে তো বলতে পারবেন একটা মেয়েকে তো মানুষ করতে পারলেন!

আগে যেমন বলেছিলাম, আমার পরিবার এসব ঠুনকো ধারণা পরোয়া করে না, তাই স্বভাবতই আমার মা রাজি হলেন না।

আমার ভেবে কষ্ট হলো যে চিন্তাধারায় নারীদের তুচ্ছ করে দেখা হয়, সেই সে ধারণায় মুক্তি কোথায়? যে মানসিকতায় ছেলে-মেয়ের মানুষ হওয়াটা আলাদা, তাদের জীবনের পরিপূর্ণতা আলাদা,  সেটি নিজেই আদৌ কতটা পরিপূর্ণ?

আমরা সবাই যেখানে মানুষ, তাহলে জীবনের পরিপূর্ণতা ও মানুষ হয়ে উঠার সংজ্ঞা আলাদা  হওয়া অন্যায়, বড় রকমের অন্যায়।

সার্থকতা যখন একপক্ষের স্বপ্ন, ইচ্ছে, আকাঙক্ষা সব মাড়িয়ে চলে তখন সেটা বড় অন্যায় মনে হয়, পড়ালেখাটা যদি অন্যের জন্য করা লাগে তাহলে পড়ালেখাটা খেলো হয়ে ওঠে, মানুষ হওয়া যদি নিজেকে বোঝা ভাবাতে বাধ্য করে, লক্ষ্য স্বপ্নের বিসর্জনে হয়, বেঁচে থাকাটা তখন দুষ্কর হয়ে ওঠে।

ছোটবেলা থেকে অবলীলায় এত নোংরামো দেখতে দেখতে আমার মানুষ হয়ে ওঠার সংজ্ঞা হয় ভিন্ন, পরিপূর্ণতার সংজ্ঞা ভিন্ন। একজন নারীর জন্ম থেকে উদ্দেশ্য বা গন্তব্য কখনো বিবাহ সম্পন্ন করাটা হতে পারেনা, সে লক্ষ্যে সে বড় হয়না, অমন যদিহয় তাহলে সে ‘অপরিপূর্ণ’ হয়েই বাঁচুক, নিজের জন্য বাঁচুক, স্বপ্নপূরণে বাঁচুক, রুনাদের হয়ে বাঁচুক। নিজের স্বপ্নের জন্য বাঁচা, বাইরে গিয়ে কাজ করা, এই ঠুনকো রীতি না মানা  যদি অপরিপূর্ণতা হয়, তাহলে এরচেয়ে ভালো কী হতে পারে! এইতো সেই ঠুনকো রীতি যার কারণে মুনাজরিনরা অক্সফোর্ডে যেতে চাইলে হৈহৈ রব ওঠে ‘এ মেয়েদের উচিত বিবাহ করা, এতেই তার পরিপূর্ণতা’।

এই ঠুনকো রীতিকে তারা বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজের স্বপ্নে বাঁচুক, বোঝা না হয়ে বাঁচুক, মুনজারিনরা অক্সফোর্ডে যাক, রুনাদের সমাপনী পরীক্ষটা দেওয়া হোক।

আর ওই মানুষগুলা যারা কথা বলবে, তাদের কী? তারা কথা বলতে থাকুক, এই স্বল্প জ্ঞান নিয়ে তারা বেঁচে থাকুক। জীবনের শেষ তারা দেখু,ক তারাই মানুষ হতে পারে নাই, আজ তারা কতটা অপরিপূর্ণ।

সবচেয়ে বড় দুঃখের ব্যাপার জানেন কী? যারা এভাবে স্বপ্ন বিসর্জন দিয়েছেন, হেনস্তার শিকার হয়েছেন, সমাজের কটুক্তি আর নোংরামোয় বড় হয়েছেন, তাদেরকেও আমি একই ধারণা নিয়ে নিজেদের মেয়েদের বড় করতে দেখেছি। তারাই দেখি মেয়ে সন্তান জন্মানোর পর তাকে এই বিয়ের চিন্তায় বড় করে তুলছেন, সমাজের ভয়ে মেয়েদের ঘরের বাইরে চাকরি করতে দেন না।

যতবার আপনারা এ ধারণা নিয়ে এগোবেন ততবার মুনজারিনরা অক্সফোর্ডেে ডাক পেলে তাকে ধরে প্রশ্ন করার মতো একজন  মানুষ থাকবে, রেজাল্ট খারাপ হলে বিয়ে করে মুক্তি দিয়ে দেয়ার জন্য উপদেশ দেয়ার মতো একজন মানুষ থাকবে।

তাই একবার এই নীতিকে, এই ধারণাকে, এই সমাজকে আপনারা ‘না’ বলেন, নিজের মতো মেয়েরা বাঁচুক, তাদের পড়ালেখাটা হোক, তাদের স্বপ্নের জন্য তারা নিজেদের বোঝা না ভেবে মানুষ ভাবতে পারুক, নিজেদের কাঠের পুতুলনাচে বন্দি না ভেবে স্বস্তিতে থাকুক।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]