ফিদেল কাস্ত্রো: বিপ্লবে আর বিজয়ে
শাহান আহমদ।। মাত্র ৮২ জন সাধারণ লোক নিয়ে ১০ হাজার সুশৃঙ্খল সৈন্যের বিপক্ষে যুদ্ধে নামেন; বিশ্বাস, আদর্শ, এবং কর্মপরিকল্পনা তাকে যে বিজয় এনে দেয় তাতে প্রায় অর্ধশত বছর ক্ষমতার শীর্ষে থেকে কিউবা’র ইতিহাস বদলে দেওয়া এক নেতায় পরিণত হোন। ফিদেল কাস্ত্রো, যিনি গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে তার দেশের সরকার প্রধান বাতিস্তাকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেন এবং সমাজতন্ত্র স্থাপনের মাধ্যমে নতুন দিনের সূচনা করেন।
সেই মহান ব্যাক্তি ফিদেল আলেসান্দ্রো কাস্ত্রো রুজ যাকে এ বিশ্ব ফিদেল কাস্ত্রো নামে চেনে- বর্তমান বিশ্বের সমাজতন্ত্র বিপ্লবের সফল প্রতিকৃতি।
আজকের দিন ১৩ই আগস্ট ১৯২৬ সালে তৎকালীন পূর্ব কিউবার ওরিয়েন্ট’ প্রদেশে জন্মগ্রহণ করেন এই মহান বিপ্লবী নেতা। তার বাবা এঙ্গেল ছিলেন স্পেন থেকে কিউবায় আসা এক ধনী চিনি ব্যবসায়ী, যিনি আমেরিকান ব্যবসায়ীর মালিকানাধীন এক ফলের কোম্পানির সাথে বেশিরভাগ ব্যবসা করতেন। আর তার মা লিনা রোজ গনজালেস ফিদেলের জন্মের সময় ছিলেন তার বাবার প্রথম স্ত্রী মারিয়া রুইসা আরগতা’র পরিচারিকা। ফিদেলের যখন বয়স ১৫, তখন তার বাবা প্রথম স্ত্রী মারিয়া’র সাথে বিচ্ছেদ করেন এবং ফিদেলের মা লিনা রোজ’কে বিয়ে করেন। ১৭ বছর বয়সে ফিদেল পারিবারিকভাবে তার নাম রোজ থেকে ক্যাস্ত্রো’তে পরিবর্তন করেন।
ফিদেল কাস্ত্রো স্কুল জীবন শেষ করে হাভানা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে পড়া শুরু করেন এবং সেই সময়েই তিনি অনুধাবন করেন কিউবার মুক্তির জন্য একটি বিপ্লব দরকার। কিউবান জাতীয়তাবাদ, সাম্রাজ্যবাদের বিপক্ষে এবং সমাজতন্ত্র তাকে গভীরভাবে রাজনীতিতে আসতে অনুপ্রাণিত করেন।
১৯৪৭ সালে তিনি ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের ডোমিনিকান রিপাবলিকে যান এবং সেখানের একটি বিপ্লবী দলের সাথে যুক্ত হয়ে একনায়ক শাসক রাফায়েল ট্রুজিলোর বিপক্ষে বিপ্লব করেন। যা শুরু হওয়ার আগেই ব্যর্থ হয়ে যায়। তারপর সেখান থেকে কলোম্বিয়ার বগোটা’তে যান সেখানের সরকারবিরোধী আন্দোলনেও যোগ দেন বিপ্লবী কাস্ত্রো।
১৯৪৭ সালে কাস্ত্রো, ‘পারটিডো অরথোডোক্সো’ নামক এক রাজনৈতিক দলে যোগ দেন। এই দলটি কিউবার সরকার সংস্কারের জন্য দলের প্রতিষ্ঠাতা এডওয়ার্ডও সিবাস’কে নিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করে এবং ১৯৪৮ সালের নির্বাচনে বড় ব্যবধানে হারে। কিন্তু এই হার থেকে কাস্ত্রো’রও শেখার ছিলো অনেক কিছু। সুশৃঙ্খলতা এবং রাজনৈতিক কৌশলের শিক্ষা তিনি ওই ঘটনা থেকেই অর্জন করেন। এই শিক্ষাই তার পরবর্তী জীবনে সবচেয়ে বেশি কাজে লাগে।
১৯৪৯ সালে কার্ল মার্কসের দর্শনের প্রতি তার আগ্রহ জন্মে। যদিও আগে থেকেই তিনি বিপ্লবী ও সমাজ পরিবর্তনের ব্রত নিয়ে সংগ্রামে লিপ্ত তবে কার্ল মার্কসের দর্শন তাকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করে। সেই অনুপ্রেরণায় ১৯৫২ সালে কিউবার জাতীয় নির্বাচনে তিনি এক আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। কিন্তু সেই নির্বাচন বাতিস্তার কুকৌশলে আর অনুষ্ঠিত হয়নি।
কিউবার তৎকালীন এই প্রেসিডেন্ট বাতিস্তা নিজে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যুক্তরাষ্ট্র এবং ধনিক শ্রেণির সহযোগিতায় একজন ঘোর একনায়ক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে কিউবার মানুষের ভাগ্যে এক দুর্ভাগ্যের দানবরূপে ঝেঁকে বসেছিলেন।
সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তাবেদার বাতিস্তাকে কিউবার ক্ষমতা থেকে সরানোকেই তখন কাস্ত্রো তার প্রধান ব্রত হিসেবে বিবেচনা করলেন। তিনি তার সেই পারটিডো অরথোডোক্সো দলের ১৫০ জন সদস্যকে নিয়ে ১৯৫৩ সালের ২৬ জুলাই কিউবার মনকাডো আর্মি ব্যারাকে আক্রমণ করেন। বাতিস্তাকে উৎখাতের উদ্দেশ্যে করা এই সংগ্রামের একটি নামও দেন তিনি। ‘দ্যা মুভমেন্ট’ নামের ওই সংগ্রামটিও কিন্তু বিফল হয়। কাস্ত্রো গ্রেফতার হোন এবং বিচারে তার ১৫ বছরের কারাদণ্ড হয়। তার ছোট ভাই বর্তমান কিউবার প্রেসিডেন্ট রাহুল কাস্ত্রোও সেই সময়ে তার সাথেই জেলে ছিলেন।
দুই বছর পর ১৯৫৫ সালে আন্তর্জাতিক চাপে এবং কাস্ত্রোর আন্দোলনের শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে মনে করে বাতিস্তা তাকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে মুক্তি দেয়। তবে কাস্ত্রোর মনে অন্য ভাবনা। একবার যে পৃথিবী পরিবর্তনের নেশায় মেতেছে তাকে কি আর দমিয়ে রাখা সম্ভব? তখন কাস্ত্রো তার ভাই রাহুলকে সঙ্গে নিয়ে ফের বিপ্লবের পথেই হাটেন এবং আরও সুসংগঠিত হওয়ার জন্য রওয়ানা দেন মেক্সিকোর উদ্দেশ্যে। মেক্সিকোতে এমন একজনের সঙ্গে তার দেখা হয় যিনি পরবর্তীতে বিপ্লবের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম নায়কের আসনে স্থান পেয়েছে। সেই মহানায়ক আরনেস্তো চে গুয়েভারা। তিনিও তখন তরুণ ও সাধারণ। বিশ্বাস করতেন লাতিন আমেরিকার সম্রাজ্যবাদের পতন এবং মানুষকে দুর্দশা থেকে কেবল মাত্র সশস্ত্র আন্দোলনই মুক্তি দিতে পারে।
১৯৫৬ সালের ২ ডিসেম্বর কাস্ত্রো কিউবাতে আবার ফিরে আসেন। সেই সময়ে তার সাথে ছিলেন মাত্র ৮০ জন বিপ্লবী কমরেড। এই যাত্রা ছিলো কাস্ত্রোর অন্যতম কঠিন এক যাত্রা। ৬০ ফুটের এক ডিজেল ইঞ্জিনের মাঝারি নৌকায় সুদূর মেক্সিকো থেকে কাস্ত্রো ও তার সাথীরা কিউবাতে পৌঁছান। কিউবাতে ফিরে দুই বছরের মধ্যে কাস্ত্রো এবং চে গুয়েভারা মিলে ধীরে ধীরে গড়ে তোলেন বিশাল গেরিলা বাহিনী। ১৯৫৮ সালে কাস্ত্রো এবং তার বাহিনী একের পর এক পাহাড়ের আর্মি ব্যারাক দখল করতে থাকেন। তাদের বিজয় রথ এতই দ্রুত গতিতে ছোটে যে কোন কোন সপ্তায় একাধিক শহরও দখল করে নেন বিপ্লবীরা।
এই যে সুসংগঠিত এক সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে ল’ড়ে এমন সাফল্য এটি কীভাবে সম্ভব হলো কাস্ত্রো ও চে’র পক্ষে? এ নিয়ে চে গুয়েভারা পরে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘‘যখন জনগণ আপনার সাথে থাকবে তখন সপ্তাহে একাধিক শহর দখল করা বড় কোনো বিষয়ই নয়”।
বিপ্লবীদের প্রতি জন-মানুষের সমর্থন বাতিস্তার প্রতিরোধ ব্যবস্থা তাসের ঘরের মতো ভেঙে দিতে থাকে। বাতিস্তা দেশত্যাগ করতে বাধ্য হোন। ৩২ বছর বয়সে কাস্ত্রো তার বিপ্লবী কমরেডদের নিয়ে গোটা কিউবার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন।
বিজয়ের সাথে সাথেই দ্রুত একটি প্রভিশনাল সরকার গঠন করে প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেওয়া হয়। কাস্ত্রো নিজে আর্মির প্রধান হিসেবে হাভানা শহরে প্রবেশ করেন। ১৯৫৯ সালে তাৎক্ষনিক নিয়োগপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী হোসে মিরো কার্ডোনা পদত্যাগ করে ফিদেল কাস্ত্রোকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করেন।
কাস্ত্রো ক্ষমতা গ্রহণের সাথে সাথেই কিউবাতে ব্যাপক সংস্কার শুরু করেন। আসলে সাম্রাজ্যবাদী সিস্টেমের পুরোটাই ভেঙে দেন তিনি। মার্কসবাদের দীক্ষিত কাস্ত্রো দেশের সকল কলকারখানা সরকারিকরণ করেন। উল্লেখ করা উচিত যে, এসব বিশাল কারখানার অনেকগুলোই ছিলো যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন। প্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্ব হারিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মাথায় বাজ পড়ে। সেই থেকে আমেরিকার সাথে কাস্ত্রোর দ্বন্দ্ব নতুন মোড় নেয়।
এখানে একটি ব্যাপার উল্লেখ্য, সে সময় কাস্ত্রো বার বার সোশ্যালিস্ট হিসেবে নিজেকে অস্বীকার করেন এবং একটি স্বনামধন্য মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে আমেরিকাতেও যান। কিন্তু তৎকালীন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোয়াইট ডি. আইজেনহাওয়ার কাস্ত্রোর সাথে দেখা করতে অস্বীকৃতি জানান।
সেই বছর মে মাসে ফিদেল কাস্ত্রো ভূমি সংস্কারের এক নতুন আইন জারি করেন। ওই আইন অনুযায়ী একজন নাগরিকের কতটুক জমি থাকবে তা ঠিক করে দেয় রাষ্ট্র। এছাড়া কিউবায় বিদেশিদের মালিকায় কোনো জমি থাকবে না বলেও নিশ্চিত হয় ঐ আইনে। এতেই আমেরিকার সাথে কাস্ত্রোর দ্বন্দ্ব দ্বিগুণ প্রকট হয়। নিজেকে সোশ্যালিস্ট দাবি না করলেও কাস্ত্রো তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্য নিয়ে কিউবার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা উন্নতি করেন।
৩ জানুয়ারি ১৯৬১ সালে যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা দিয়ে কিউবার সাথে সকল কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। কিউবায় কাস্ত্রো সরকারে যুক্তরাষ্ট্র এতই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে যে, বে অফ পিগস’ নামে একটি হামলা চালিয়ে বসে। যার উদ্দেশ্যে ছিলো কাস্ত্রোকে উৎখাত। এর পরে আরও বহুবার যুক্তরাষ্ট্র কিউবায় হামলা চালায়।
কাস্ত্রোই যেন যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিশালী একটি রাষ্ট্রের মাথাব্যথার মূল কারণ হয়ে উঠলেন। কেননা কাস্ত্রো সফল হলে যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী নীতির বিরুদ্ধে পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলেও বিপ্লবের আশঙ্কা থাকে। তাই শত শত বার কাস্ত্রোকে হত্যার উদ্দেশ্যে সিআইএ অপারেশন চালায়। তার খাবারের সাথে বিষ মেশানো থেকে শুরু করে হেন কোনো উদ্যোগ বাকি রাখেনি যুক্তরাষ্ট্র তবে সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়। কিউবার গোয়েন্দা তথ্য মতে, কাস্ত্রোকে হত্যার উদ্দেশ্যে ৬৩৮ বার চেষ্টা চালায় বিপ্লববিরোধী শক্তি।
কাস্ত্রোর সরকারের বিরুদ্ধে কুৎসার শেষ নেই। সেই শুরু থেকেই পুঁজিবাদী বিশ্বের মিডিয়া তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ এনেছে। কাস্ত্রোর শাসন ব্যবস্থাকে ব্যর্থ হিসেবে প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে বিনিয়োগ হয়েছে বিলিয়ন ডলার। এর কারণ ওই একই, এ পদ্ধতি সফল হলে অন্য জায়গায় বিপ্লবের আশঙ্কা।
কাস্ত্রোর ৫ দশকের শাসনামলের পূর্বেকার সরকারগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে তিনি এক নতুন কিউবার জন্ম দিয়েছেন। এক জনের অধীনে অতিরিক্ত ভূমি, শ্রমিক শ্রেণিকে ধনিক শ্রেণির শোষণ, বিদেশি শক্তির আগ্রাসনের মত যেসব বিষয় গরীবকে গরীব করে রাখে সবই তিনি বন্ধ করেছিলেন। মার্কসবাদের আলোকে ব্যাপক সংস্কার এনে তার দেশকে এখন বিশ্বের অন্যতম এক সাম্যের দেশে পরিণত করেছেন কাস্ত্রো। তাই সফল বিপ্লবের প্রতীক হিসেবে তার নাম ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
২৫ নভেম্বর ২০১৬ সালে ৯০ বছর বয়সে ফিদেল কাস্ত্রোর মৃত্যু হয়। তার আগে ২০০৮ সালে অসুস্থতাজনিত কারণে তাঁর ভাই রাহুল কাস্ত্রোর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।