মায়ের সংকোচ ও কুসংস্কার যখন মেয়ের ক্ষতির কারণ হয়
ফায়জুন নাহার সিতু।। তখন মাত্র মাধ্যমিক স্কুলে পা রেখেছি, নতুন স্কুল, নতুন সহপাঠী, আর বয়ঃসন্ধিকাল। শরীর মনের পরিবর্তন কিশোরীমনে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে তখন। আষাঢ়ের আকাশের মতো মনের অবস্থা যেন এই রোদ এই বৃষ্টি। স্কুল বাড়ির খুব কাছে থাকায় ক্লাসের বিরতিতে দুপুরের খাবার খেতে চটপট চলে আসতাম বাড়িতে। একদিন টিফিন শেষে স্কুলে গিয়ে দেখি আমার কিছু সহপাঠী খুব হাসছে, হাসির ধরনটা এমন অবমাননাকর, যেন খুব লজ্জার কিছু ঘটেছে যা ভাল মেয়েরা মুখে আনতেই পারেনা। একজন ফিসফিস করে বললো, ওই যে দেখছো মেয়েটি, তার কাপড়ে রক্তের দাগ লেগে আছে, বেঞ্চেও।
দেখলাম, লাস্ট বেঞ্চে জড়সড়ো হয়ে বসে আছে মেয়েটি। তখনও আমি নারীর জীবনের অন্যতম স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াটির কথা জানতাম না। শুধু অবাক আর শঙ্কিত হয়েছিলাম, তাই বাসায় এসে কাউকে বলিনি। কিশোরী মনের কাছে কেমন যেন একটা নিষিদ্ধ ঘোরটোপে মোড়ানো বিষয় হিসেবে ধরা দিয়েছিল ঘটনাটি।
যাই হোক, সময়ের সাথে সাথে ঘটনাটি ভুলে গেলাম। নিজের পিরিয়ডের অভিজ্ঞতা যখন হলো তখন প্রথম ভেবেছিলাম বড় কোন অসুখ বুঝি, অতি দুঃখে চোখের জলে নাকের জলে একাকার! অথচ আমার পরিবারে মা ছাড়াও বড় দুটি বোন আছে। আমি এতোদিন তাদের সাথে থেকেও ঘুনাক্ষরে জানতে পারিনি এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়াটির কথা।
আমার মায়ের সাথে কোন সময় এই অতি প্রয়োজনীয় বিষয়ে কোনরকম কথা হতো না। মা এইসব বিষয়ে কথা বলতে লজ্জা পান। অথচ বয়ঃসন্ধিকালে মানুষের জীবনে অনেক ঝড় বয়ে যায়। শারিরীক ও মানসিক পরিবর্তনের এই সময়ে নিজের সম্পর্কে অজ্ঞানতায় কিশোর কিশোরীর মেজাজ খিটখিটে হয়ে থাকে। অস্বস্তি বোধ ও বিষন্নতায় ডুবতে থাকে ওরা। তাই এই সময় হতবিহ্বল কিশোর-কিশোরীদের দরকার হয় কাছের মানুষদের সাপোর্ট। এই সময় একজন কিশোরীর সবচাইতে বেশি প্রয়োজন হয় তার মাকে।
কারণ মায়ের প্রতি নির্ভরতা দিয়েই শুরু হয় একটি মেয়ের শিশুকাল। কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় মা সামাজিক বিধিনিষেধ, নিয়মনীতি, কুসংস্কার ও প্রথা পদ্ধতিকে বিশ্বাস করেন। মায়ের যেন নিজস্ব কোন সত্তা নেই। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অদৃশ্য শিকল চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করে নিজের মেয়ের পায়ে যত্ন করে পরিয়ে দেন মা। মীনার কার্টুনে রাজু আর মীনার খাবারের থালায়, রাজুর পাতে মীনার চাইতে পরিমাণে বেশি ও ভাল খাবারটি তুলে দেয়ার যে বৈষম্য দেখানো হয়েছিল তা এমনি এমনিই উঠে আসেনি, এটি আমাদের সমাজের অসংখ্য পরিবারের নিয়মিত চিত্র। মায়েরা বিশ্বাস করেন, মেয়েদের নিচু বলায় কথা বলতে হবে, মেয়ে পড়ায় ভাল হলে কী হবে রান্নাটা তার বাধ্যতামূলক, তারা তাদের মেয়েকে ভাল করে রান্নার শিক্ষাটা দিয়ে রাখেন, তারা বিশ্বাস করেন শ্বশুড়বাড়িতে গেলে, এমনকি শ্বশুর বাড়ি না হলেও, শুধু স্বামী, স্ত্রী একসাথে থাকলেও, চাকরির পাশাপাশি রান্নাটা মেয়েরই করা উচিত, কারণ এটাই তো নিয়ম। ছেলেদের চাইতে মেয়েটাকে কম খাবার দেয়া মায়ের কাছে কোন অন্যায় মনে হয় না কারণ তিনিও তার বাপের বাড়িতে এমনটাই দেখে এসেছেন।
মা সবকিছুতেই প্রায়োরিটি দেন তার ছেলে সন্তানটিকে। ফলে মেয়ে সন্তানটির মনে তৈরি হয় বঞ্চনার বোধ। তার কাছে মনে হয় অন্য সবকিছুর তুলনায় মায়ের কাছে সে যেন কোনো গুরুত্বই পাচ্ছে না! মা-মেয়ের সম্পর্কের ভুল বোঝাবুঝিতে অনেক সময় পারস্পরিক ঘৃণাও চলে আসতে পারে এবং সম্পর্কের দূরত্ব ও বাড়তে থাকে। ফলে দুপক্ষেই ক্ষোভ জমতে থাকে। এই বিষয়টিই হচ্ছে মা-মেয়ের সম্পর্কের সবচেয়ে বড় টানাপোড়েনের জায়গা। অথচ যিনি মা, তিনি যদি তার মায়ের কাছে এই ব্যাপারগুলোয় যথাযথ আচরণ ও শিক্ষা পেয়ে থাকতেন, তার কন্যাশিশুটিকে এমন কঠিন শৈশবের সম্মুখীন হতে হতো না।
আমাদের গৃহবন্দী মায়েদের লজ্জা ও সংকোচ অনেক। তারা যদি তাদের সন্তানের সাথে, বয়সের সাথে হওয়া শারীরিক পরিবর্তন ও স্বাভাবিক প্রক্রিয়াগুলোর কথা নিয়ে আলোচনা না করেন, তাহলেই আমার অতীত স্মৃতিতে থাকা সেই সদ্য মাধ্যমিক স্কুলে ওঠা কিশোরীর বিব্রতকর ও দুঃখজনক অবস্থায় পড়তে হয়। আমাদের অনেক নারীই তাদের শরীরে বেড়ে উঠা ব্রেস্ট টিউমার বা প্রজনন অঙ্গের বিভিন্ন জটিল অসুখ লজ্জায়, সংকোচে গোপন করে থাকেন, অসুখ যখন একদম লাস্ট স্টেজে গিয়ে পৌঁছোয়, আর সহ্য করতে না পেরে প্রকাশ করেন, অথচ তখন দেখা যায় অনেক দেরি হয়ে গেছে, যা পরবর্তীতে তাদের ভয়নাক ক্ষতি, এমনকি মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়।
এই ঘটনাগুলো অনেকটা দুষ্টচক্রের মতো ঘটেই চলছে। কারণ এই অতিপ্রয়োজনীয় বিষয়গুলো শেয়ার করার মতো যথাযথ পরিবেশ আমরা মা বোনদের দিতে পারিনা। তাই মা তার মেয়েকে এই বিষয়ে শিক্ষা দিতে সক্ষম হন না, কারণ আমাদের মায়েরা নিজেরাই এই বিষয়ে সংকোচ ও ভয়ের এক ভয়ঙ্কর দৈত্যের সাথে বসবাস করেন।
পরিবারের সবাই মিলে কি পারিনা সম্পর্কগুলোয় আরো যত্ন, পরিচর্যা ও পারস্পরিক বোঝাপড়া তৈরির মাধ্যমে কন্যাসন্তানটির জীবন আরো সুন্দর ও নিরাপদ করে তুলতে?
বিশেষ দ্রষ্টব্য: হয়তো এমন অনেক মা-ই আছেন আমার লেখায় যে মায়েদের কথা বলছি তাদের সাথে যাদের একেবারেই মিল নেই। তবে অধিকাংশ মেয়েদের তাদের মায়ের সাথে অভিজ্ঞতা সেই মায়েদেরই মতন আমার লেখায় যাদের কথা ফুটে উঠেছে। লেখাটি তাদেরই জন্য।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]