September 20, 2024
অনুবাদসাহিত্যফিচার ৩

নারী প্রশ্নের সামাজিক ভিত্তি

Alexandra Kollontai এর The Social Basis of the Woman Question প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয় ১৯০৯ সালে। ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরের পাঠকদের জন্য এটি যৌথভাবে অনুবাদ করেছেন ফাতিন ইশরাক ও রাহাত আলম দ্বীপ্ত।।

এক লিঙ্গের ওপর অন্য লিঙ্গের শ্রেষ্ঠত্ব, বা মস্তিষ্কের তুলনা এবং নারী ও পুরুষের মনস্তাত্ত্বিক গঠনের তুলনার দায়িত্ব বুর্জোয়া স্কলারদের হাতে ছেড়ে দিয়ে ঐতিহাসিক বস্তুবাদের অনুসারীরা প্রত্যেক লিঙ্গের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য মেনে নিয়েছে এবং তারা, নারী হোক বা পুরুষ হোক, প্রত্যেক মানুষের পূর্ণাঙ্গ এবং স্বাধীন আত্মনির্ধারণ এবং সকল প্রাকৃতিক প্রবণতার উন্নয়ন এবং প্রয়োগের বিস্তৃত সুযোগ দাবি করে। ঐতিহাসিক বস্তুবাদের অনুসারীরা বিশেষ নারী প্রশ্নের অস্তিত্বকে আমাদের জীবনের সাধারণ সামাজিক প্রশ্নের চেয়ে ভিন্ন কিছু হিসেবে দেখে না। নারী বৈষম্যের পিছে নির্দিষ্ট অর্থনৈতিক উপাদান কাজ করে; এই প্রক্রিয়ায় প্রাকৃতিক গুণাবলী গৌণ বিষয় হয়ে থাকে। শুধুমাত্র এ সকল উপাদানের সম্পূর্ণ অপসারণ; যেসব শক্তি অতীতের কিছু ক্ষেত্রে নারীদের পরাধীনতার সূচনা করেছিল, সেগুলোর বিবর্তনই মৌলিকভাবে তাদের সামাজিক অবস্থানকে প্রভাবিত এবং পরিবর্তন করতে পারে। অন্য কথায়, নতুন সামাজিক এবং উৎপাদন ব্যবস্থায় নারীরা সত্যিকার অর্থে স্বাধীন এবং সমান হতে পারবে।

তবে, এর মানে এই নয় যে, আধুনিক সিস্টেমের কাঠামোতে নারীদের জীবনের আংশিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। শ্রমিকদের প্রশ্নে মৌলিক সমাধান কেবলমাত্র আধুনিক উৎপাদন ব্যবস্থার সম্পর্কগুলোর পূর্ণাঙ্গরূপে ঢেলে সাজানোর মধ্যে সম্ভব; কিন্তু এটি কি প্রলেতারিয়েতদের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা পূরণে সংস্কার থেকে আমাদেরকে বিরত থাকবে? এর বিপরীতে, শ্রমিক শ্রেণির প্রতিটি নতুন অর্জন মানবসমাজকে স্বাধীনতা এবং সামাজিক সাম্যের দিকে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যায়, নারীর অর্জিত প্রতিটি অধিকার তাকে তার পূর্ণাঙ্গ মুক্তির লক্ষ্যে আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যায়।

নারী পুরুষের অধিকার সমতাকরণের দাবি সোশ্যাল ডেমোক্রেসিই সর্বপ্রথম তাদের কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করে; ওই পার্টি তাদের বক্তৃতা এবং প্রকাশনায় নারীদের সীমাবদ্ধতা থেকে উত্তরণের দাবি করে, ওই পার্টির একার প্রভাবে অন্যান্য পার্টি এবং সরকার নারীদের স্বার্থে সংস্কার কাজ চালাতে বাধ্য হয়েছে। এবং রাশিয়াতে এই পার্টি শুধুমাত্র তাত্ত্বিকভাবে নারীদের অবস্থানের পক্ষে দাঁড়ায়নি, বরং সবজায়গায় ও সবক্ষেত্রে নারীর সমতার নীতি কঠোরভাবে মেনে চলেছে।

এই ক্ষেত্রে, এই শক্তিশালী এবং অভিজ্ঞ পার্টির সমর্থন গ্রহণ করতে “সমঅধিকার কর্মী”দেরকে কোন বিষয়টি বাধা দেয়? সমঅধিকার কর্মীরা যত উগ্রবাদীই হোক না কেন, তারা এখনও তাদের বুর্জোয়া শ্রেণির প্রতি অনুগত। এই মুহূর্তে, রুশ বুর্জোয়া শ্রেণির বিকাশ এবং ক্ষমতার পূর্বশর্ত হল রাজনৈতিক স্বাধীনতা। এটি ছাড়া তাদের সমস্ত অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভিত্তি দুর্বল হয়ে যাবে। নারীদের জন্য রাজনৈতিক সাম্যের দাবি হল এমন একটি প্রয়োজনীয়তা, যার সূচনা জীবন থেকেই হয়।

“সকল পেশায় প্রবেশাধিকার” স্লোগানটি যথেষ্ট হয়েছে; শুধু মাত্র দেশের সরকার ব্যবস্থায় সরাসরি অংশগ্রহণই নারীর অর্থনৈতিক উন্নতির প্রতিশ্রুতি দেয়। এজন্যই মধ্যবিত্ত বুর্জোয়া গোষ্ঠীর স্বপ্ন ভোটাধিকার পাওয়া, এবং এজন্যই তারা আধুনিক আমলাতন্ত্রের প্রতি বৈরিতা প্রদর্শন করে।

তবে, রাজনৈতিক সাম্যের দাবি তে আমাদের নারীবাদীরা তাদের বিদেশি বোনের মত; সোশ্যাল ডেমোক্রেসির মাধ্যমে যে সম্ভাবনার দরজা খুলেছে, সেটা তাদের কাছে অচেনা এবং ধারণাতীত থেকে যায়। নারীবাদীরা শ্রেণি সমাজ ব্যবস্থার কাঠামোর অভ্যন্তরে সমঅধিকার চায়, কোনভাবেই তারা শ্রেণি সমাজের ভিত্তিকে আঘাত করে না। তারা বিদ্যমান বিশেষ সুযোগ সুবিধাকে চ্যালেঞ্জ না করে নিজেদের জন্য অধিকার চায়। পরিস্থিতি বুঝতে পারার অক্ষমতার জন্য আমরা বুর্জোয়া নারীদের প্রতিনিধিদের দোষ দেই না, কেননা তাদের দৃষ্টিভঙ্গি তাদের শ্রেণি অবস্থানের ঊর্ধ্বে যেতে পারে না।

অর্থনৈতিক স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম

প্রথমত আমাদের নিজেদেরকে প্রশ্ন করতে হবে শ্রেণি সংঘাতের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা সমাজ ব্যবস্থায় একক ঐক্যবদ্ধ নারী আন্দোলন করা সম্ভব কিনা। প্রত্যেক নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকের কাছে এটা স্পষ্ট যে যেসব নারীরা নারীমুক্তির আন্দোলনে অংশ নেয়, তারা কখনই সমজাতিক গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে না।

পুরুষদের মতই নারীর পৃথিবী দুই ভাগে বিভক্ত; এক গ্রুপের ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষা গুলো বুর্জোয়া শ্রেণির কাছাকাছি, যেখানে অপর গ্রুপ প্রলেতারিয়েত শ্রেণির কাছাকাছি এবং নারী মুক্তির জন্য তাদের দাবিগুলো নারী প্রশ্নের সম্পূর্ণ সমাধান দেয়। যদিও দুই দলই “নারী মুক্তি” স্লোগান ধারণ করে, তাদের দাবিগুলো আলাদা। প্রত্যেকটি গ্রুপই অবচেতনভাবে নিজেদের শ্রেণি স্বার্থ থেকে শুরু করে, যেটা তাদের লক্ষ্য এবং উদ্যোগগুলো কে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির শোভা দেয়।

নারীবাদীদের দাবিগুলো যত উগ্রবাদী হোক না কেন, আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে নারীবাদীরা তাদের শ্রেণি অবস্থান বজায় রেখে অর্থনৈতিক এবং সামাজিক কাঠামোর মৌলিক পরিবর্তনের জন্য লড়াই করতে পারবে না, যেটা ছাড়া নারী মুক্তি সম্পূর্ণ হবে না।

যদিও কিছু নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে সকল শ্রেণির নারীর স্বল্পকালীন উদ্যোগ মিলে যায়, দুই দলের চূড়ান্ত লক্ষ্য এবং কৌশল সূক্ষ্মভাবে আলাদা হয়, যেটা দীর্ঘ পরিসরে আন্দোলনের দিক নির্ধারণ করে। যেখানে সমসাময়িক পুঁজিবাদী বিশ্বের কাঠামোর অভ্যন্তরে নারীবাদীদের সম অধিকারের সংগ্রামের অর্জনগুলো পরিষ্কারভাবেই শেষ হয়ে যায়, সেখানে এটি শ্রমিক শ্রেণির অর্থনৈতিক দাসত্ব বৃদ্ধির একটি পথ হয়ে দাঁড়ায়। যেহেতু পুরুষেরা নারীদের জন্য কেবল শিকল আর দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে অনৈতিকভাবে সকল অধিকার সুযোগ সুবিধা এবং বিশেষ সুবিধা দখল করে নিয়েছে, নারীবাদীরা পুরুষকে শত্রু হিসেবে দেখে। তাদের জন্য বিজয় তখনই অর্জিত হয় যখন পুরুষদের দ্বারা অধিকৃত অবৈধ সুযোগ সুবিধাগুলো “নৈতিক লিঙ্গ” এর হাতে আসে। প্রলেতারিয়েত নারীর আচরণ এক্ষেত্রে আলাদা। তারা পুরুষদের শত্রু এবং শোষক হিসেবে দেখে না; এর বিপরীতে, তারা পুরুষদেরকে তাদের কমরেড হিসেবে দেখে, যারা তাদের নিত্যদিনের সংগ্রামের সঙ্গী এবং যারা তাদের সাথে উন্নত ভবিষ্যতের জন্য লড়াই করে। নারী এবং তার পুরুষ কমরেড একই সামাজিক পরিস্থিতির কাছে দাস; একই পুঁজিবাদের শৃঙ্খল তাদের অধিকার কেড়ে নেয় এবং তাদেরকে জীবনের সুখ থেকে বঞ্চিত করে। এটা সত্য যে সমসাময়িক সিস্টেমের কতিপয় নির্দিষ্ট দিক নারীর ওপর দ্বিগুণ বোঝা হয়ে দাঁড়ায়, এর পাশাপাশি এটাও সত্য যে শ্রমের বিভিন্ন পরিস্থিতি কখনও নারীদেরকে পুরুষের প্রতিযোগী এবং শত্রু বানায়। কিন্তু এ সকল পরিস্থিতিতে শ্রমিক শ্রেণি জানে দোষী কারা…

যে নারী শ্রমিক তার ভাইয়ের চেয়ে দুর্ভাগ্যের দিক থেকে কোন অংশে কম না, সেই সর্বগ্রাসী রাক্ষসকে ঘৃণা করে, যে কেবলই তার শিকারের রক্ত চুষতে ব্যস্ত এবং যে লক্ষ লক্ষ মানব জীবনের বিনিময়ে বড় হয়, যে নারী, পুরুষ এবং শিশুর প্রতি সমান লোভ অনুভব করে। হাজারো সূত্র শ্রমিক পুরুষকে একত্রিত করে। অপরদিকে, বুর্জোয়া নারীর লক্ষ্য অদ্ভুত। তারা প্রলেতারিয়েত হৃদয়ের প্রতি উদাসীন; তারা প্রলেতারিয়েত নারীকে ঐ উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ এর প্রতিজ্ঞা করে না, যার দিকে সকল নিপীড়িত মানবতা তাকিয়ে আছে।

প্রলেতারিয়েত নারীর চূড়ান্ত লক্ষ্য অবশ্যই তাদেরকে বর্তমান বুর্জোয়া সিস্টেমের অধীনে নিজেদের অবস্থান উন্নত করার ইচ্ছা থেকে বিরত রাখে না। কিন্তু এ সকল ইচ্ছার উপলব্ধি প্রতিনিয়ত পুঁজিবাদের প্রকৃতির দ্বারা বাধাগ্রস্থ হয়। কেবলমাত্র শান্তি এবং ন্যায় বিচারের, শ্রম সমাজতান্ত্রিক করা হয়েছে, এমন পৃথিবীতে নারীরা সমান অধিকার পেতে পারে এবং সত্যিকারভাবেই স্বাধীন হতে পারে। নারীবাদীরা এই বিষয়টি বুঝতে অক্ষম; তাদের কাছে মনে হয় যে, যখন আইন নারীর সমঅধিকার এর স্বীকৃতি দিয়ে দেবে, তখন তারা শোষণ এবং দাসত্বের দুনিয়ায় সুখি হতে পারবে। এবং এটি একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্র পর্যন্ত সত্য। প্রলেতারিয়েত নারীদের মধ্যে সংখ্যাগুরুর জন্য, পুরুষের সাথে সমঅধিকারের অর্থ হচ্ছে বৈষম্যে সমান ভাগ পাওয়া। কিন্তু বুর্জোয়া নারীর জন্য এটি অধিকার এবং সুযোগ সুবিধার দরজা খুলে দেয়, যা এতদিন কেবল বুর্জোয়া পুরুষ ভোগ করে আসছিল। কিন্তু বুর্জোয়া নারীর অধিকারের প্রতিটি নতুন অর্জন তাকে তার ছোট বোনকে শোষণ করার নতুন হাতিয়ার দেবে এবং দুই শ্রেণির নারীর মধ্যকার বিভাজন বাড়াবে। তাদের চাহিদা এবং আকাঙ্ক্ষা সংঘর্ষে লিপ্ত হবে।

তাহলে কোথায় সাধারণ “নারী প্রশ্ন”? সেই একতা কোথায়, যার ব্যাপারে নারীবাদীদের এত কিছু বলার আছে? বাস্তবতার দিকে সজাগ দৃষ্টি দিলেই বোঝা যাবে এমন একতা সম্ভব নয়। “নারী প্রশ্ন”র সাথে রাজনৈতিক দলের কোন সম্পর্ক নেই এবং “এর সমাধান কেবল সকল দল ও সকল নারীর অংশগ্রহনের মাধ্যমে সম্ভব”- এই জাতীয় বৃথা আশ্বাস নারীবাদীরা নিজেদেরকে দিয়ে থাকে; যেমনটা একজন উগ্রবাদী নারীবাদী বলেছেন, বাস্তবতার যুক্তি আমাদেরকে নারীবাদীদের সান্ত্বনামূলক ভ্রম প্রত্যাখ্যান করতে বাধ্য করে।

মানব ইতিহাসে উৎপাদনের ব্যবস্থা এবং মাধ্যম নারীদেরকে পরাধীন করে রেখেছে ধীরে ধীরে তাদেরকে শোষণ এবং পরাধীনতায় নির্বাসিত করেছে, যার মাঝে এখন তাদের অস্তিত্ব।

নারীর হারানো স্বাধীনতা এবং তাৎপর্য ফিরে পেতে সমগ্র সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অভ্যুত্থান প্রয়োজনীয় ছিল। চিন্তকদের জন্য সেই সমস্যা খুবই কঠিন ছিল, সেটা এখন জড় কিন্তু শক্তিশালী উৎপাদন ব্যবস্থার মাধ্যমে সমাধান হয়ে গিয়েছে। যেই শক্তি হাজারো বছর ধরে নারীদেরকে দাসী বানিয়ে রেখেছে, সেই একই শক্তি এখন তাদেরকে মুক্তি এবং স্বাধীনতার পথে নিয়ে যাচ্ছে…

উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ের দিকে নারীপ্রশ্নের গুরুত্ব বুর্জোয়া নারীরা উপলব্ধি করা শুরু করে। প্রলিতারিয়েত নারীদের শ্রমবাজারে প্রবেশের পর বেশ কিছু সময় কেটে যাবার পর। পুজিবাদের সাফল্যের দানবীয় থাবার ফলাফল স্বরুপ, মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকেরা অভাবের ধাক্কা খায়। এই অর্থনৈতিক পরিবর্তন নগন্য এবং মধ্যবিত্ত বুর্জোয়াদের আর্থিক অবস্থা অস্থিতিশীল করে ফেলে এবং বুর্জোয়া নারীরা এক ভয়ংকর রকমের দ্বিধায় পড়ে যায়। হয় দারিদ্র বরণ করে নাও, নয়তো কাজ করার অধিকার অর্জন করো। সমাজের এই শ্রেণির স্ত্রী এবং কন্যা সন্তানেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের, শিল্পকর্মের প্রতিষ্ঠান, প্রকাশনীগুলোর, অফিস এবং অন্যান্য যেসব যেসব পেশায় যোগ দেওয়ার সুযোগ খোলা ছিল নারীদের সামনে সবগুলোয় বিপুল সংখ্যায় কড়া নাড়তে শুরু করে। বুর্জোয়া নারীদের বিজ্ঞানচর্চার সুযোগ এবং সংস্কৃতির উচ্চতর সুবিধাগুলা ভোগ করার ইচ্ছা হুট করে জাগেনি। দৈনন্দিন রুটি রোজগারের প্রশ্ন থেকে এই ইচ্ছার জন্ম।

বুর্জোয়া নারীরা প্রথম থেকেই পুরুষদের কড়া প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। ‘আরামদায়ক চাকরি’রত পেশাজীবী পুরুষ এবং দৈনন্দিন রুটি রোজগারের জন্য কর্মস্থলে প্রথম সুযোগ পাওয়া নারীদের মধ্যে মজুরি শ্রম নিয়ে কঠিন লড়াই চলে। এই লড়াই জন্ম দেয় ‘নারীবাদ’ এর – বুর্জোয়া নারীদের সমষ্টিগত শক্তি দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলে তাদের সাধারণ শত্রু পুরুষদের বিরুদ্ধে। যখন এই নারীরা শ্রম বাজারে প্রবেশ করে, তারা ‘নারী আন্দোলনের অগ্রদূত’ হিসেবে গর্বভরে নিজেদের পরিচয় দেওয়া শুরু করে। তারা ভুলে গিয়েছিল, অর্থনৈতিক মুক্তিলাভের ক্ষেত্রে, তারা তাদের ছোটবোনদের পথই অনুসরণ করছিলো এবং নিজেদের নোংরা হাত দিয়ে ছোটবোনদের ফলানো ফসল ভোগ করছিলো।

নারীবাদীরা নারীদের কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের সুযোগ তৈরিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে এটা বলা কি তাহলে আদৌ সম্ভব, যেখানে বুর্জোয়া নারীদের আন্দোলন শুরুর পূর্বেই সব দেশেই শত হাজার প্রলিতারিয়েত নারীর সমুদ্রের জোয়ার এসেছিলো কারখানা, শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে। কেবলমাত্র নারী শ্রমিকদের শ্রম বিশ্ব বাজারে যে পরিচিতি লাভ করেছিল, তার জন্যই বুর্জোয়া নারীরা সমাজে স্বাধীন অবস্থান লাভ করে, যা নিয়ে নারীবাদীরা এত গর্ব বোধ করে।

আমরা এমন একটিও বিষয় খুঁজে পাই না যেখানে সাধারণ নারীবাদী আন্দোলন প্রলিতারিয়েত নারীদের বাস্তব পরিস্থিতির উন্নয়নে ঐতিহাসিকভাবে চালিয়ে যাওয়া লড়াইয়ে বিশেষ কোনো অবদান রেখেছে। প্রলিতারিয়ান নারীরা নিজেদের জীবনের মানোন্নয়নের ক্ষেত্রে যা কিছু অর্জন করেছে তা সাধারণ শ্রমিকশ্রেণির, সম্পূর্ণ নিজেদের প্রয়াসের ফলাফল। শ্রমিকশ্রেণির নারীদের কাজের উন্নত পরিবেশ এবং উন্নত জীবনের জন্য করা লড়াইয়ের ইতিহাস, প্রলিতারিয়েতের মুক্তির লড়াইয়ের ইতিহাস।

যদি এটা প্রলিতারিয়ান অসন্তোষের ভয়াবহ বিস্ফোরণের ভয় না হয়, তাহলে কোন শক্তি শিল্পপতিদের শ্রমের মজুরি বৃদ্ধিতে, কাজের ঘন্টা কমাতে এবং উন্নত কর্মপরিবেশ প্রদানে বাধ্য করে থাকে? যদি এটা শ্রমিক বিক্ষোভের ভয় না হয়ে থাকে, তবে পুঁজির দ্বারা শ্রমের শোষণের সীমারেখা টানতে সরকারকে দিয়ে আইন প্রণয়ন করায়?

সোশ্যাল ডেমোক্রেসি নারীদের রক্ষার্থে যা করেছে তার ছিটেফোঁটাও গোটা পৃথিবীতে কোনো দল করে নি। শ্রমিক নারীরাই শ্রমিক শ্রেণির সর্বপ্রথম এবং প্রধান সদস্য। প্রলিতারিয়েত পরিবারের সদস্যরা যত বেশি সন্তোষজনক অবস্থান আর সাধারণ সমৃদ্ধি লাভ করবে, গোটা শ্রমিকশ্রেণিই ভবিষ্যতে তত বেশি উন্নতি লাভ করবে।

চলমান সামাজিক কঠিন পরিবেশে, লক্ষ্য অর্জনে সচেতন যোদ্ধাকে এই দুঃখজনক বিশৃঙ্খলা থামাতে হবে। তাকে বুঝতে হবে সাধারণ নারীমুক্তি আন্দোলন প্রলিতারিয়ান নারীদের জন্য কিছুই করে নি, তাকে দেখতে হবে এই আন্দোলন শ্রমিকশ্রেণির মানুষের জীবনযাত্রার মান এবং কর্মক্ষেত্র উন্নত করতে কতটা অক্ষম। তাই সমাধিকারের পক্ষে লড়াই করা নারীদের চোখে মানবসভ্যতার ভবিষ্যত অবশ্যই ধূসর দেখায়। কারণ তারা প্রলিতারিয়ান পৃথিবীর দৃষ্টিভঙ্গি মানিয়ে নেয়নি অথবা অধিক উপযুক্ত সামাজিক কাঠামোর আগমনে দৃঢ় বিশ্বাস করে নি। দৃঢ় এবং সংযতভাবে এই সিস্টেম তার লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এটি শ্রমিক নারীদের নিজেদের প্রাপ্য অবস্থানে নিয়ে আসে। প্রলিতারিয়ান নারী সাহসিকতার সাথে শ্রমের এই কাটাভর্তি পথ দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। তার পা আর ভার বহন করতে পারছে না, তার শরীর যেন বিচ্চিন্ন হয়ে যাচ্ছে। সামনের রাস্তা আরো কঠিন, হিংস্র প্রাণি শিকার করতে তার জন্য কাছাকাছি অপেক্ষা করছে এই পথেই।

কিন্তু এই পথ ধরে এগোলেই নারীর দূরবর্তী কিন্তু লোভনীয় লক্ষ্য পূরণ সম্ভব, শ্রমের এই নতুন পৃথিবীতেই তার মুক্তি। উজ্জ্বল সেই ভবিষ্যতের দিকে দীর্ঘ এবং খুবই কঠিন পথ চলায়, প্রলিতারিয়ান নারী, তাকে জড়িয়ে ধরা দাসত্বের মনোভাবকে ছুড়ে ফেলে। কিছুদিন আগেই যারা অপদস্থ, পদদলিত দাস ছিল, কোন অধিকার যাদের ছিল না, তারাই ছোট ছোট পদক্ষেপে নিজেকে একজন স্বাধীন শ্রমিক, একজন স্বাধীন ব্যক্তিত্বে, স্বাধীন ভালোবাসায় নিজেদের খুঁজে পাওয়া একজন মানুষে রূপান্তরিত হবে। এটা বিভিন্ন পর্যায়ে লড়াই চালানো সেই প্রলিতারিয়ান নারী, যে নারীদের কর্মক্ষেত্রের স্বাধীনতা অর্জন করে, এটা সেই ‘ছোটবোন’ যে ভবিষ্যতের ‘স্বাধীন’ এবং ‘সমঅধিকারপ্রাপ্ত’ নারীর ভিত্তি স্থাপন করে।

তাহলে কোন কারণে নারীকর্মী বুর্জোয়া নারীবাদীদের সাথে ইউনিয়নে অংশ নেবে? তবে কে এই ধরণের জোট গঠন করবে? অবশ্য কোনো নারীকর্মী নয়। সে নিজেই নিজের ত্রাণকর্তা। তার ভবিষ্যত তার নিজের হাতে। নারী শ্রমিক তার শ্রেণিস্বার্থ রক্ষা করে এবং “সকল নারীর পৃথিবী” বিষয়ক বক্তব্য এদের ধোঁকা দিতে পারে না। নারী শ্রমিকের ভুলে গেলে চলবে না যে, যেখানে বুর্জোয়া নারীর লক্ষ্য হচ্ছে নিজেদের উন্নয়ন নিশ্চিত করা এমন একটি সমাজ কাঠামোর ভেতরে, যা আমাদের প্রতি বৈরিতাপূর্ণ; সেখানে আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে সার্বজনীন শ্রমের এমন একটি মন্দির বিনির্মাণ, যেখানে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সংহতি এবং আনন্দদায়ক স্বাধীনতা থাকবে।

বিয়ে এবং পরিবারের সমস্যা

নারীপ্রশ্নের আরেকটি বিশেষ দিক, পরিবার, এর দিকে নজর দেয়া যাক, পরিবার সংক্রান্ত জটিল বিষয়। নারীর প্রকৃত মুক্তির জন্য এই জরুরি এবং জটিল সমস্যার সমাধানের প্রয়োজনীয়তা সবাই উপলব্ধি করতে পারে। রাজনৈতিক অধিকার, ডক্টরেট এবং অন্যান্য শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জন করার সুযোগের অধিকার এবং সমান কাজের জন্য সমান মজুরির জন্য লড়াই, সম অধিকারের জন্য লড়াইয়ের গোটা বিষয় নয়। প্রকৃত স্বাধীন নারী হতে পরিবারের বর্তমান কর্তৃত্বমূলক এবং সেকেলে কাঠামোর শেকল থেকে মুক্ত হতে হবে। নারীদের জন্য পরিবারপ্রশ্নের সমাধানের গুরুত্ব রাজনৈতিক সাম্য এবং অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়।

বর্তমান পরিবারে, যার কাঠামো গঠিত হয় প্রথা এবং আইনের দ্বারা, নারীরা কেবল ব্যক্তি হিসেবেই নয় বরং স্ত্রী এবং মা হিসেবেও শোষিত হয়। এই সভ্য দুনিয়ার অধিকাংশ দেশের সিভিল কোডই নারীদের কমবেশি তার পুরুষ সঙ্গীর উপর নির্ভরশীল হিসেবে স্থান করে দেয় এবং পুরুষদের শুধু তাদের সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করা নয় বরং তাদের উপর নৈতিক এবং শারীরিকভাবে আধিপত্যের অধিকার দিয়ে পুরষ্কৃত করে।

যেখানে নারীর দাপ্তরিক এবং আইনগত দাসত্ব দূর হয়, সেখানেই ‘জনমত’ ক্ষমতা শুরু হয়। এই জনমত ‘সম্পত্তি নামক পবিত্র প্রতিষ্ঠান’ সংরক্ষণের লক্ষ্যে বুর্জোয়া কর্তৃক গঠিত এবং সমর্থিত হয়। ‘দ্বৈত নৈতিকতা’র পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ এটার আরেকটি হাতিয়ার। বুর্জোয়া সমাজ নারীদের শ্রমের জন্য খুবই কম মজুরি দিয়ে নিজেদের বর্বর অর্থনৈতিক সংঘাত দিয়ে আঘাত করে। নারী তার স্বার্থরক্ষার্থে আওয়াজ তোলার নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত, অন্যদিকে সে বিয়ের বন্ধন অথবা পতিতাবৃত্তি- এক প্রকার লেনদেন যা জনসম্মুখে অবজ্ঞা এবং দমন করা হয় কিন্তু গোপনে সমর্থন করে যায়, এমন এক কল্যাণকর বিকল্প লাভ করে। তাহলে কি সমসাময়িক বৈবাহিক জীবন এবং পারিবারিক গঠন কাঠামোতে নারীরা নিজেদের অবস্থানের জন্য যে পীড়া অনুভব করে যায়, তাতে জোর দেওয়ার প্রয়োজন আছে? এরই মধ্যে অনেক কিছু বলা আর লেখা হয়েছে এই বিষয়ে। বৈবাহিক এবং পারিবারিক জীবনের হতাশাজনক চিত্রে সাহিত্য পূর্ণ হয়েছে। কত মনস্তাত্ত্বিক নাটক প্রথা হয়ে আসছে! কতশত জীবন পঙ্গুত্ব বরণ করেছে! এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, আধুনিক পরিবার কাঠামো, কম বা বেশি পরিসরে সকল শ্রেণি এবং পর্যায়ের নারীদের শোষণ করে। ঐতিহ্য এবং প্রথা সামাজিক স্তরের সকল যুবতী মা’কেই শোষণ করে। আইন বুর্জোয়া, প্রলেতারিয়েত এবং কৃষিজীবী সকল নারীকেই তার পুরুষ সঙ্গীর অভিভাবকত্বের অধীনে স্থান দেয়।

এখনো কি আমরা নারীপ্রশ্নের পরিসর, যেখানে সকল শ্রেণির নাগরিক একতাবদ্ধ হতে পারে, তা আবিষ্কার করতে পারিনি? তারা কি সেসব শোষণমূলক ক্ষেত্রগুলোর বিরুদ্ধে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করতে পারেনা? নারী যেসব দুর্ভোগ এবং দুর্দশার মধ্য দিয়ে যায় তা কি তাদের মধ্যকার শ্রেণি বিরোধের তীব্রতা কমানো এবং ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণির নারীর সাধারণ লক্ষ্য এবং তা অর্জনে কাজ করার প্ল্যাটফর্ম দিতে পারেনা? তাদের উদ্দেশ্য এবং চাহিদা ভিন্ন হলেও বুর্জোয়া এবং প্রলিতারিয়েত নারীদের সমষ্টিগত লড়াই কি সম্ভব নয়? নারীবাদীরা বিয়ের অপেক্ষাকৃত স্বাধীন কাঠামো এবং ‘মাতৃত্বের অধিকার’ এর জন্য লড়াই করছে। তারা যৌনকর্মীদের অধিকারের পক্ষে আওয়াজ তুলছে, যারা সকলের দ্বারা নিপীড়িত, নিগৃহীত হয়। সম্পর্কের কাঠামোর খোঁজ এবং লিঙ্গের মধ্যকার ‘নৈতিক সমতা’র শক্ত দাবিতে নারীবাদী সাহিত্য কতটা সমৃদ্ধ তা দেখা যায়। ‘নতুন নারী’র খোঁজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করা লক্ষ লক্ষ প্রলেতারিয়েত নারীর সৈন্যদল থেকে অর্থনৈতিক মুক্তির লড়াইয়ে পিছিয়ে থাকা বুর্জোয়া নারীরা পরিবারপ্রশ্নের সমাধান খোঁজার লড়াইয়ে বিজয়ী নারীবাদীর আসন গ্রহণ করবে।

এখানে, রাশিয়ায়, মধ্য শ্রেণির বুর্জোয়া নারীরা, স্বাধীন উপার্জনকারীরা শ্রমবাজারে ১৮৬০ সালের পরবর্তী সময়কালে দ্রুতই প্রবেশ করে। তারা প্রচলিত প্রথার বাইরে গিয়ে বিয়ের প্রশ্নে স্থায়ী হওয়া শুরু করে। তারা সামাজিক প্রেক্ষাপটের চাহিদা মেটাতে নির্ভয়ে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান চার্চ কর্তৃক স্বীকৃত প্রথা ‘একান্নবর্তী’ পরিবারকে কর্তৃত্ব খাটানোর দিক থেকে আরো নমনীয় সম্পর্ক দিয়ে প্রতিস্থাপিত করে। কিন্তু নারীদের ব্যক্তিপর্যায়ের এই সমাধান কর্তৃত্ববাদী প্রেক্ষাপটের পরিবর্তন আনতে এবং সামগ্রিকভাবে পরিবার জীবনের অসহায়ত্ব থেকে মুক্ত করতে পারেনি। যদি কোন শক্তি এই আধুনিক পরিবার কাঠামোকে ভেঙে ফেলতে থাকে, সেটা বিচ্ছিন্ন এবং শক্ত মানসিকতার ব্যক্তিপর্যায়ের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নয় বরং জড় এবং অত্যন্ত শক্তিশালী উৎপাদন ব্যবস্থা। যে ব্যবস্থা আপোসহীনভাবে জীবনের অঙ্কুরোদগোম ঘটায় নতুন ভিত্তির উপর।

বুর্জোয়া পৃথিবীতে এই যুবতী নারীরা, যারা তাদের উপর আসা বিদ্বেষপূর্ণ চ্যালেঞ্জকে ছুড়ে ফেলে দেয় এবং কর্তৃত্বমুক্ত, দাসত্ব থেকে মুক্ত ‘ভালোবাসা’র অধিকার দাবি করে সমাজের কাছ থেকে, এই নারীদের বীরত্বগাঁথা লড়াই পরিবারের দাসত্ব করা নারীদের মুক্তির জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। এটিই আমাদের প্রগতিশীল সমঅধিকার কর্মী এবং দেশের বাইরের অধিক স্বাধীন নারীবাদীরা প্রচার করে। অন্যকথায়, তাদের দৃষ্টিতে বিবাহের প্রশ্নের সমাধান বাহ্যিক পরিবেশ নয়, সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তনের মাধ্যমে স্বাধীনভাবে পাওয়া যায়। এই বিচ্ছিন্নভাবে কিছু ব্যক্তির বীরত্বগাঁথা লড়াই পর্যাপ্ত। সাধারণভাবে একজন নারীকে সাহস করতে দাও এবং নারীপ্রশ্নের সমাধান হয়ে গেল।

কিন্তু অপেক্ষাকৃত কম বীরসুলভ আচরণ করা নারীরা তা অস্বীকার করে। বীজ্ঞ লেখকদের উপন্যাসের বীরঙ্গনারা অসাধারণভাবে স্বাধীনতা, নিঃস্বার্থ বন্ধু এবং অনন্য কিছু গুণাবলী লাভ করেছে তাদের উপর আসা চ্যালেঞ্জ সাহসের সাথে মোকাবেলা করতে। কিন্তু যাদের পুঁজি নেই, পর্যাপ্ত মজুরি পায় না নিজেদের শ্রমের জন্য, নেই শক্তিশালী বন্ধু আর অনন্যসাধারণ গুণাবলী তাদের জন্য সমাধান কোথায়? আর মুক্তির জন্য লড়াই করা নারীদের মনে বশ করে মাতৃত্বের প্রশ্ন। ‘স্বাধীন ভালোবাসা’ কি আদৌ সম্ভব কিছু? এটা বর্তমান সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামোর মধ্যে কি সাধারণ ঘটনা হিসেবে উপলব্ধি করা, ব্যতিক্রম কোনো ঘটনা নয় বরং সাধারণ সামাজিক প্রথা হিসেবে গ্রহণ করা সম্ভব? সমকালীন বিয়ের প্রথায় ব্যক্তিগত সম্পদের উপাদানগুলো কি উপেক্ষা করা সম্ভব? ব্যক্তিকেন্দ্রিক এই পৃথিবীতে নারীদের স্বার্থকে আঘাত না করে কি প্রথাগত বিবাহ কে উপেক্ষা করা সম্ভব? মাতৃত্বের সকল সমস্যা যেন কেবল নারীকেই সামলাতে না হয় সেটার একমাত্র নিশ্চয়তা এই বৈবাহিক চুক্তি। পুরুষ শ্রমিকদের উপর পূর্বে যা হয়ে ছিল, নারী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে কি ঠিক একই ঘটনা ঘটবেনা? মালিকদের আচরণ নিয়ন্ত্রণের নিয়ম প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া ইউনিয়নের ব্যবস্থাপনার অপসারণ, পুঁজিকে শ্রমিকদের ওপর চূড়ান্ত ক্ষমতা দিয়েছিল। ‘শ্রম এবং পুঁজির চুক্তির স্বাধীনতা’ এই প্রলুব্ধ জাগানো স্লোগান পুঁজির দ্বারা শ্রমকে শোষণ করার একটা ন্যাক্কারজনক পদ্ধতি হয়ে দাড়িয়েছিল। ‘স্বাধীন ভালোবাসা’কে সমসাময়িক শ্রেণি বৈষম্যের সমাজের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া নারীকে পারিবারিক জীবনের অসহায়ত্ব থেকে মুক্ত না করে, নিশ্চিতভাবে তার সন্তানদের একা, কারো সাহায্য ছাড়াই দেখভাল করার দায়িত্ব পালন করার নতুন বোঝা চাপিয়ে দিবে।

শুধুমাত্র সামাজিক সম্পর্কগুলোয় নির্দিষ্ট কিছু মৌলিক পরিবর্তন- পরিবার থেকে সমাজ এবং রাষ্ট্রের ঘাড়ে দায়িত্ব অর্পণের সংস্কারই এমন সমাজব্যবস্থা গঠন করতে সক্ষম যেখানে ‘স্বাধীন ভালোবাসা’র নীতি কিছুটা চর্চা করা যাবে। কিন্তু রাষ্ট্র যতই গণতান্ত্রিক হোক না কেন, বর্তমানে আধুনিক পরিবারের উপর মা এবং সন্তানের যে দায়িত্ব অর্পিত হয়, সে দায়িত্ব আধুনিক শ্রেণিভিত্তিক রাষ্ট্র নিজের ঘাড়ে তুলে নেবে এমন আশা আসলেই কি করা সম্ভব? ‘স্বাধীন ভালোবাসা’ ফর্মুলার নেতিবাচক দিকগুলি থেকে নারীদের রক্ষা করার সামাজিক পূর্বশর্ত কেবল উৎপাদনভিত্তিক সম্পর্কগুলোর মৌলিক পরিবর্তনই তৈরি করতে পারে। আমরা কি বর্তমান কালের সেসব অপ্রাপ্তি এবং অস্বাভাবিকতা সম্পর্কে অবগত নই, যা সুবিধাজনক ল্যাবেল এর অধীনে ঘটে থাকে? শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিক এবং প্রশাসক ভদ্রলোকদের কথা চিন্তা করা যাক, যারা নিযুক্ত শ্রমিক গোষ্ঠীর মধ্যকার নারীদেরকে নিজেদের অবাধ যৌন চাহিদা পূরণ করতে বাধ্য করে, প্রতিনিয়ত এই নারীদের তার প্রয়োজনীয় লক্ষ্য অর্জনের পথ থেকে অপসারণ করে ফেলার হুমকির মধ্যে রেখে। এই মালিক কিংবা প্রশাসকরা কি তাদের নিজেদের মত করে ‘স্বাধীন ভালোবাসা’ চর্চা করছে না? সেসব ‘পরিবারের কর্তা’ যারা তাদের গৃহকর্মীদের ধর্ষণ করে এবং অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দেয়, তারা কি তাদের ‘স্বাধীন ভালোবাসা’ ফর্মুলার চর্চা করছে না?

তবে আমরা সেই স্বাধীনতার কথা বলছি না যা উন্মুক্ত বিয়ের প্রসার ঘটাতে চায়। এর বিপরীতে, আমরা উভয়লিঙ্গের জন্য সমানভাবে বাধ্যতামূলক ‘একক নৈতিকতা’র গ্রহণযোগ্যতা দাবি করি। আমরা বিদ্যমান যৌনতার লাইসেন্সের বিরোধিতা করি এবং সত্যিকার ভালোবাসার উপর ভিত্তি করে ওঠা স্বাধীন ইউনিয়নকেই শুধু নৈতিক হিসেবে বিবেচনা করি। কিন্তু প্রিয় বন্ধুরা, আপনার কি মনে হয় না, আপনার ‘স্বাধীন বিবাহ’র আদর্শ, যা বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে চর্চা করা হয়, তার ফলাফল হিসেবে ‘যৌনতার স্বাধীনতা’র বিকৃত মস্তিষ্কের চর্চা শুরু হতে পারবে। বর্তমানে নারীদের উপর যেসব বস্তুবাদী বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয় যা যৌথভাবে তাদের পুরুষ সঙ্গী এবং পুঁজির উপর নির্ভরশীলতা তৈরি করে, সেসব থেকে মুক্তি মিললেই নারীদের জন্য নতুন কোনো দুর্দশা ডেকে না এনে ‘স্বাধীন ভালোবাসা’র নীতি বাস্তবায়ন করা সম্ভব। নারীরা যত ঘরের বাইরে বের হওয়া শুরু করবে, কাজ করে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করবে, ‘স্বাধীন ভালোবাসা’র সুযোগ তার সামনে ততই আসবে, বিশেষত সেসব বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের অপেক্ষাকৃত ভালো অংকের মজুরি পাওয়া নারীদের জন্য। কিন্তু প্রলিতারিয়েত নারীরা তাদের শ্রমশক্তিকে যত বিক্রি করতে থাকবে, পুঁজির উপর নির্ভরশীলতা থেকে যায় এমনকি বাড়তেই থাকে। ‘স্বাধীন ভালোবাসা’র স্লোগান কি বেচে থাকার জন্য কোনোমতে উপার্জন করা নারীদের দুরবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে সক্ষম? তাছাড়া, এই ‘স্বাধীন ভালোবাসা’র চর্চা কি এরই মধ্যে শ্রমজীবী শ্রেণির মাঝে বিস্তৃত পরিচয়ে চর্চা হয়ে আসছে না? বুর্জোয়ারা একাধিক ঘটনায় প্রলিতারিয়েতদের এই ‘অনৈতিক’ এবং ‘বিকৃতরুচি’ চর্চার বিরোধিতা করেনি? এদিকে দৃষ্টিপাত করা উচিত যে যখন নারীবাদীরা বিয়ের বাইরে স্বাধীন বুর্জোয়া নারীর মধ্যে বিভিন্ন রকম সম্পর্কের কথা বলে, তখন তারা উন্মুক্ত ভালোবাসার কথা বলে। কিন্তু যখন নারী শ্রমিকের কথা আসে, তখন এই সম্পর্কগুলো ‘অস্বাভাবিক যৌন আচরণ’ হয়ে যায়।

কিন্তু প্রলিতারিয়েত নারীদের জন্য বর্তমান সময়ের সম্পর্কগুলো চার্চ দ্বারা স্বীকৃত হোক আর না হোক, তাদের জন্য সমানভাবে অসম্ভব রকমের অপ্রীতিকর। প্রলেতারিয়েত স্ত্রী এবং নারীর জন্য পরিবার এবং বিয়ের সমস্যার জটিলতা পবিত্র বা অসাম্প্রদায়িক রূপে সীমাবদ্ধ না। বরং এটি সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অন্তর্নিহিত, যা শ্রমিক শ্রেণির নারীদের জটিল বাধ্যবাধকতাগুলো নির্ধারণ করে। যাই হোক, এটা পরিবারে নারীদের অবস্থান নির্ধারণ করে দেওয়া সিভিল কোডের চিত্র না, পরিবারের সমস্যার জটিলতা এবং বিশৃঙ্খলার চিত্রও না। যদি নারীদেরকে বর্তমান সমাজের অনিবার্য অথচ গৃহস্থের নগন্য দায়িত্বের বোঝা থেকে মুক্ত করে সমাজ নতুন প্রজন্মের, নিরাপদ মার্তৃত্বের দায়িত্ব নেয় এবং মায়ের কাছে তার সন্তানকে জন্মের পরের অন্তত প্রথম মাস গুলোয় দেয় তবেই সম্পর্কের প্রশ্নে যে হৃদয়বিদারক চিত্র ফুটে ওঠে তা থামানো সম্ভব।

চার্চ স্বীকৃত পবিত্র এবং বৈধ বিবাহ প্রথার বিরোধিতায় নারীবাদীরা বলপ্রয়োগের সাথে লড়াই করছে। অন্যদিকে আধুনিক বিয়ে এবং পরিবারের কাঠামোর পেছনে কাজ করা বাস্তব উপাদানগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লড়ছে প্রলিতারিয়েত নারীরা। জীবনের ক্ষেত্রকে মৌলিকভাবে পরিবর্তন করার সংগ্রামে তারা জানে, তারা লিঙ্গের মধ্যকার সম্পর্কের সংস্কারেও সহায়তা করছে। এখানেই পরিবারের কঠিন সমস্যার সমাধানে দিকে অগ্রসর হওয়ার দিক থেকে বুর্জোয়া এবং প্রলিতারিয়েতদের আসল পার্থক্য।

বুর্জোয়া গোষ্ঠীর নারীবাদী এবং সমাজ সংস্কারকরা বোকার মত সমসাময়িক শ্রেণিভিত্তিক সমাজের অধীনে পরিবারের নতুন কাঠামো এবং নতুন ধরণের বৈবাহিক সম্পর্ক তৈরির সম্ভাবনায় বিশ্বাস করে। নিজেদের সেই নতুন কাঠামো খোঁজাখুজিতে বন্দী করে ফেলে। তাদের ধারণা যদি জীবন স্বাভাবিকভাবে এসব কাঠামো গঠন না করে, তবে যেকোনো মূল্যে তা ভেবে বের করা জরুরি। তারা বিশ্বাস করে এমন আধুনিক যৌন সম্পর্কের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে, যা বর্তমান সমাজের সিস্টেমের অধীন পরিবারের জটিল সমস্যার সমাধান দিতে সক্ষম। এবং বুর্জোয়া বিশ্বের তাত্ত্বিকরা, তথা সাংবাদিক, লেখক এবং নারীমুক্তির বিখ্যাত যোদ্ধারা একের পর এক তাদের পরিবার ফর্মুলাগুলো সবার সামনে নিয়ে আসে।

এই বিয়েগুলো কতটা কাল্পনিক শোনায়! আমাদের আধুনিক পরিবার কাঠামোর বিষণ্ণ আলোয় এই সমাধানগুলো কতটা ভঙ্গুর শোনায়! ‘উন্মুক্ত সম্পর্ক’ এবং ‘উন্মুক্ত ভালোবাসা’ বাস্তবে রূপ দেয়ার আগে মানুষের মধ্যকার সকল সামাজিক সম্পর্কের মৌলিক সংস্কার দরকার। নৈতিক ও যৌন রীতিনীতি এবং মানব সভ্যতার মনস্তত্ত্বকে বিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। সমসাময়িক ব্যক্তি কি ‘উন্মুক্ত ভালোবাসা’র সাথে মনস্তাত্ত্বিকভাবে খাপ খাওয়াতে সক্ষম? সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষটির হৃদয়ও খুবলে খাওয়া ঈর্ষার বিষয়ে কি হবে? এবং শেকড় গভীরে চলে যাওয়া সম্পত্তির সেই ধারণা, যা কেবল শরীরই নয়, বরং অপরের আত্মার ওপরেও অধিকার দাবি করে? এবং একজনের ব্যক্তিত্বের প্রতি শ্রদ্ধা আসার অক্ষমতা? ভালোবাসার মানুষের কাছে অধীনস্থ হওয়ার বা ভালোবাসার মানুষকে নিজের অধীনস্থ করার যে অভ্যাস? এবং বিচ্ছেদ, সীমাহীন একাকীত্বের তিক্ত এবং উন্মাদ অভিজ্ঞতা, যা ভালোবাসার মানুষের ভালোবাসা শেষ হয়ে গেলে এবং চলে গেলে অনুভূত হয়? সেই ব্যক্তিবাদী মানুষটি কোথায় শান্তি পাবে? সমষ্টিগতভাবে আনন্দ, হতাশা এবং আশার অনুভূতিই হল ব্যক্তি পর্যায়ের মানসিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিগত শক্তির উৎস। কিন্তু আধুনিক মানুষ কি পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ামূলক প্রভাবের মত সমষ্টিগতভাবে কাজ করতে সক্ষম? সমষ্টিগত জীবন কি আসলেই বর্তমানে ব্যক্তি পর্যায়ের ছোট ছোট সুখ সঞ্চার করতে সক্ষম? ‘অনন্য’, ‘একমাত্র’, সহজাত আত্মা ছাড়া এমনকি সমাজতন্ত্রী, সমষ্টিগত ব্যক্তিও এই বৈরি পৃথিবীতে অনেকটাই একা; কেবলমাত্র শ্রমিক শ্রেণির আমরাই ভবিষ্যতের ক্ষীণ আশা দেখতে পাই, মানুষের মাঝে আরও শান্তিপূর্ণ সামাজিক সম্পর্ক দেখতে পাই। পরিবারের সমস্যা জীবনের মতই জটিল এবং বহুমুখী। আমাদের সমাজ ব্যবস্থা এটা সমাধানে অক্ষম।

অন্যান্য বৈবাহিক রীতি প্রস্তাবিত হয়েছে। অনেক প্রগতিশীল এবং নারী এবং সামাজিক চিন্তক বৈবাহিক সম্পর্ককে কেবল উত্তরাধিকারী উৎপাদনের প্রক্রিয়া হিসেবে দেখে। নারীর জন্য বিয়ের কোন বিশেষ মর্যাদা নেই- মাতৃত্ব তার জীবনের পবিত্র লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এবং দায়িত্ব। Ruth Bray এবং Ellen Key এর কাজের জন্য ধন্যবাদ, যেই বুর্জোয়া আদর্শ নারীকে ব্যক্তির পরিবর্তে নারী হিসেবে দেখে, সেটি প্রগতিশীলতা অর্জন করেছে। এ সকল অগ্রসর নারীর স্লোগানই ফরাসি সাহিত্য নিয়েছে। এবং এখানে রাশিয়াতেও ১৯০৫ এর রাজনৈতিক ঝড় ঝাপটার আগে, সামাজিক মূল্যবোধ সংস্কারের আগে, মাতৃত্বের প্রশ্ন দৈনিক প্রচার মাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। নারী জনসংখ্যার সংখ্যাগুরুদের মাঝে ‘মাতৃত্বের অধিকার’ স্লোগানটি বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এভাবে যদিও এক্ষেত্রে নারীবাদীদের পরামর্শ কাল্পনিক ছিল, সমস্যাটি নারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার মত গুরুত্বপূর্ণ ছিল না।

‘মাতৃত্বের অধিকার’ এর প্রশ্ন কেবল বুর্জোয়া নারীর মাঝেই না, প্রলেতারিয়েত নারীকেও ছুঁয়ে যায়। মা হওয়ার অধিকার- এই শ্রুতিমধুর শব্দগুলো ‘যেকোনো নারীর হৃদয়’ স্পর্শ করে এবং হৃদয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে। নিজের সন্তানকে নিজের দুধ খাওয়ানোর অধিকার, এবং সন্তান জন্ম নেওয়ার প্রথম লক্ষণগুলোর সময় বুঝতে পারা, সন্তানের শরীরের যত্ন নেওয়া এবং জীবনের দুঃখ কষ্ট থেকে সন্তানের আত্মাকে রক্ষা করা- কোন মা এই দাবিগুলো সমর্থন করবে না?

এটা মনে হতে পারে যে আমরা এমন একটি বিষয় খুঁজে পেয়েছি যা সকল সামাজিক স্তরের নারীকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারবে: এটা মনে হতে পারে যে আমরা এমন একটি সেতু খুঁজে পেয়েছি যা পরস্পর বৈরি দুই দুনিয়ার নারীর মধ্যে ঐক্য তৈরি করতে পারে। আমাদের অনুসন্ধান করা দরকার প্রগতিশীল বুর্জোয়া নারীরা মাতৃত্বের অধিকার বলতে কী বোঝে। এরপর আমরা দেখতে পাবো প্রলেতারিয়েত নারী, বুর্জোয়া যোদ্ধাদের সমঅধিকারের লড়াইয়ে মাতৃত্বের সমস্যার সমাধানের সাথে একমত হতে পারে কিনা। এর সমর্থকদের চোখে মাতৃত্ব পবিত্র গুণ বহন করে। সন্তান উৎপাদনের মত নারীর প্রাকৃতিক কাজে অংশগ্রহণের পিছের মিথ্যা কুসংস্কারগুলো ধ্বংস করার জন্য- কেননা এই কাজ আইনের দ্বারা স্বীকৃত নয়, মাতৃত্বের অধিকারের যোদ্ধারা ছড়ি অন্যদিকে ঘুরিয়েছে: তাদের জন্য মাতৃত্ব নারী জীবনের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মাতৃত্বের এবং পরিবারের প্রতি দায়বদ্ধতা Ellen Keyকে এই নিশ্চয়তা দিতে বাধ্য করে যে আধুনিক একক পরিবার পরিবর্তিত সমাজতান্ত্রিক সমাজেও বিদ্যমান থাকবে। একমাত্র যে পরিবর্তন তিনি দেখতে পান সেটা হল, বৈবাহিক সম্পর্কে বস্তুগত অর্জন এবং সুযোগ সুবিধা লাভের কোন সুযোগ থাকবে না। এটি পারস্পরিক অনুরাগের ভিত্তিতে হবে, কোন প্রকার আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া। প্রেম এবং বিয়ে তখন সত্যিকার অর্থে এক হবে। কিন্তু আধুনিক একক পরিবার আধুনিক ব্যক্তিকেন্দ্রিক পৃথিবীর উৎপাদ, যেখানে অসুস্থ প্রতিযোগিতা, চাপ এবং একাকীত্ব থাকে। পরিবার দানবীয় পুঁজিবাদী ব্যবস্থার উৎপাদ। অথচ Ellen Key সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায়ও পরিবারের অস্তিত্ব আশা করে। রক্তের সম্পর্কের বন্ধন বর্তমানে জীবনের একমাত্র অবলম্বন হিসেবে, দুঃসময় এবং দুর্ভাগ্যে একমাত্র আশ্রয় হিসেবে কাজ করে এটা সত্য। কিন্তু এটি কি ভবিষ্যতে নৈতিক বা সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় থাকবে? তিনি এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন না। তার ‘আদর্শ পরিবার’ এর প্রতি একটা টান আছে। এই পরিবার হল মধ্যবিত্ত বুর্জোয়াদের অহংকারের জায়গা, যা বুর্জোয়া সমাজ ব্যবস্থার ভক্তরা পূজা করে।

কিন্তু বুদ্ধিমান হলেও লক্ষ্যভ্রষ্ট Ellen Key একা যে কেবল সামাজিক সংঘাতে পথ হারায়, এমন না। বিয়ে এবং পরিবারের প্রশ্নে কোন সমাজতন্ত্রীরা এই বিষয়ে একমত সেটা সম্ভবত বলার দাবি রাখে না। যদি আমরা সমাজতন্ত্রীদের মধ্যে পরিসংখ্যান করি, তাহলে ফলাফল কী আসবে তা অনেকটাই নিশ্চিত। পরিবার ব্যবস্থা কি ধুলোয় মিশে যাবে? নাকি এখনও বিশ্বাসের জায়গা আছে যে পরিবারের সমস্যা কেবল একটি সমসাময়িক সংকট? পরিবারের বর্তমান কাঠামো কি ভবিষ্যৎ সমাজ ব্যবস্থায় অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারবে? না আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজের সাথে দাফন হয়ে যাবে? এসব প্রশ্নের অনেক রকম উত্তর পাওয়া যায়।

পরিবার থেকে সমাজে শিক্ষার ভিত্তি স্থানান্তরের সাথে আধুনিক একক পরিবারকে আঁকড়ে ধরে রাখা শেষ বন্ধন ছিন্ন হয়ে যাবে। বিলুপ্তিকরণের প্রক্রিয়া আরও দ্রুততর হবে, ভবিষ্যৎ বৈবাহিক সম্পর্কের ধূসর সীমান্তরেখা দৃশ্যমান হতে শুরু করবে। বর্তমান সময়ের প্রভাবে অদৃশ্য হয়ে থাকা এই ধূসর সীমান্তরেখা সম্পর্কে আমরা কি বলতে পারি?

বর্তমানের বাধ্যবাধকতামূলক বিবাহ যে ভবিষ্যতে উন্মুক্ত সম্পর্কের ইউনিয়নে রূপ নেবে সেটা আর বলার অবকাশ রাখে না। মুক্তির জন্য লড়াই করতে থাকা নারীদের ক্ষুধার্ত চাহিদা থেকে উৎপন্ন হওয়া উন্মুক্ত ভালোবাসা সমাজে প্রতিষ্ঠা হওয়া লৈঙ্গিক সম্পর্কের কিছু রূপ ব্যাখ্যা করতে সক্ষম। যাই হোক, সামাজিক প্রভাব এবং মিথস্ক্রিয়া এত বৈচিত্র্যময় যে যখন সম্পূর্ণ সিস্টেম মৌলিকভাবে পরিবর্তিত হয়ে যাবে, তখন সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কী হবে তা নিয়ে ভবিষ্যৎবাণী করা অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। কিন্তু প্রথাগত বিয়ে এবং বাধ্যবাধকতামূলক একক পরিবার যে বিলোপ হবে তার প্রমাণ হল বিভিন্ন লিঙ্গের মধ্যকার সম্পর্কের ধীর এবং ঊর্ধ্বমুখী বিবর্তন।

রাজনৈতিক অধিকারের জন্য সংগ্রাম

নারীবাদীরা আমাদের সমালোচনার উত্তর এভাবে দেয়: যদিও নারীদের রাজনৈতিক অধিকারের পিছে আমাদের যুক্তিগুলো আপনাদের কাছে ভুল মনে হয়, এই দাবির গুরুত্ব কি কমে যায়, যা নারীবাদী এবং শ্রমিক শ্রেণির প্রতিনিধিদের জন্য সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ? দুই সামাজিক শ্রেণির নারীরা কি তাদের সাধারণ রাজনৈতিক লক্ষ্যের জন্য তাদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টিকারী শ্রেণি সংঘাতের বাধা অতিক্রম করতে পারে না? তাদেরকে ঘিরে থাকা বিরোধীশক্তির বিরুদ্ধে সাধারণ সংগ্রাম শুরু করতে তারা অবশ্যই সক্ষম। বুর্জোয়া এবং প্রলেতারিয়েত শ্রেণির বিভাজন অনিবার্য, কিন্তু এই নির্দিষ্ট প্রশ্নের বেলায় নারীবাদীরা মনে করে বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণির নারীদের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।

নারীদের রাজনৈতিক অধিকারের সংগ্রামে শ্রমিক শ্রেণির প্রতিনিধিদের দলীয় আনুগত্যের কারণে নারীবাদীদের সাথে যোগদান না করার কারণে নারীবাদীরা বারবার এই যুক্তিগুলোয় হিংস্রতার সাথে ফিরে আসে। আসল ঘটনা কি এটিই?

রাজনৈতিক লক্ষ্যের কি একটি সম্পূর্ণ পরিচিতি আছে, নাকি অবিভক্ত, শ্রেণির- ঊর্ধ্বে থাকা নারী সৈন্য গঠনে পরস্পরবিরোধিতা অন্য সব ক্ষেত্রের মত বাধা হয়ে দাঁড়ায়? নিজেদের লিঙ্গের রাজনৈতিক অধিকার অর্জনে প্রলেতারিয়েত নারীর কৌশল নির্ধারণের আগে আমাদেরকে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে।

নারীবাদীরা নিজেদেরকে সকল প্রকার সামাজিক পুনর্গঠনের পক্ষের শক্তি হিসেবে দাবি করে এবং তাদের মধ্যে অনেকে বলে তারা সমাজতন্ত্রের পক্ষে। সুদূর ভবিষ্যতে তারা এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য শ্রমিক শ্রেণির পক্ষে লড়াই করতে চায় না। তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠরা বিশ্বাস করে, রাজনৈতিক ক্ষমতা পাওয়া মাত্রই সকল সামাজিক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। এটি তাদের একটি মতাদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কারণ পুরুষেরা তাদের সহজাত স্বার্থ চিন্তার দ্বারা পরিস্থিতির মালিক হয়ে আছে। প্রলেতারিয়েতদের জন্য নারীবাদীদের আকাঙ্ক্ষা যত ভালই হোক না কেন, যখনই শ্রেণি সংগ্রামের প্রশ্ন উঠেছে, তারা লড়াইয়ের ময়দান ছেড়ে চলে গেছে। তারা মনে করে তারা বহিরাগত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে চায় না, এবং তারা তাদের বুর্জোয়া উদারবাদে ফিরে যেতে চায়, যা আরামদায়ক ও পরিচিত।

না, বুর্জোয়া নারীবাদীরা তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য যতই চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করুক না কেন, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অংশগ্রহণের মাধ্যমে শ্রমিক শ্রেণির নারীদের অনেক সুবিধা হবে- এটি তারা যতই তাদের ছোটবোনদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করুক না কেন, তাদের বুর্জোয়া আত্মা পুরুষের সমান রাজনৈতিক অধিকারের নারীবাদী আন্দোলন জুড়ে একটি শ্রেণি আচ্ছাদন দেয়, যা সাধারণ নারীর দাবি বলে মনে হতে পারে। রাজনৈতিক অধিকার ব্যবহারের ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্য এবং বোঝাপড়া বুর্জোয়া এবং প্রলেতারিয়েত নারীর মধ্যে অপূরণযোগ্য খাদ সৃষ্টি করে। তবে দুই শ্রেণির নারীর নেয়া কিছু উদ্যোগ যে একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত একই থাকে, এই বিষয়টির সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় না। প্রত্যেক শ্রেণির যেসব প্রতিনিধিরা রাজনৈতিক ক্ষমতা পেয়েছে, তারা সিভিল কোড পর্যালোচনার সুযোগও পেয়েছে, যা প্রায় সব দেশেই নারীর প্রতি কম-বেশি বৈষম্য সৃষ্টি করে। নারীরা শ্রমের পরিবেশ উন্নয়নের জন্য আইনী পরিবর্তন আনার চেষ্টা করে; পতিতাবৃত্তির বৈধতার আইনের বিরুদ্ধে তারা অবস্থান নেয়। শ্রেণিস্বার্থের বেলায় স্পষ্ট হয় যে সংস্কারের প্রতি নারীর দুই শ্রেণির আচরণ সাংঘর্ষিক…

নারীবাদীরা যাই বলুক না কেন, শ্রেণি প্রবণতা সর্বদাই ‘শ্রেণি- ঊর্ধ্ব’ রাজনীতির শুভ ইচ্ছার চেয়ে শক্তিশালী হয়ে দাঁড়ায়। যতক্ষণ পর্যন্ত বুর্জোয়া নারী এবং তাদের ছোটবোনরা তাদের অসমতায় সমান, সমসাময়িকরা সবসময়ই নারীর সাধারণ স্বার্থের প্রশ্নে কঠোর শ্রম দিতে পারে। যেই মাত্র দুই শ্রেণির মধ্যবর্তী বাধা ভেঙে যায় এবং বুর্জোয়া নারীরা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রবেশাধিকার পেয়ে যায়, ‘সকল নারীর অধিকার’ এর রক্ষকরা তাদের ছোটবোনদের কোনো অধিকার না দিয়ে নিজ শ্রেণির সুযোগ সুবিধার রক্ষক হয়ে যায়। এজন্য নারীবাদীরা যখন নারী শ্রমিকদের সাথে ‘সাধারণ নারীর’ নীতি বুঝাতে একটি সাধারণ সংগ্রামের কথা বলে, নারী শ্রমিকরা স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বাস করতে পারে না।