November 2, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

একজন ঝর্ণা আক্তার ও আমাদের সামাজিক বাস্তবতা

কায়সুল খান।। সম্প্রতি জাতীয় ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারের প্রথম পাতায় এক বাংলাদেশি মা ও তার ছেলের ক্রিকেট খেলার ছবি প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় ছবিটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কিশোর ইয়ামিন তার মায়ের সাথে পল্টন ময়দানের এক কোনায় ক্রিকেট খেলছে এই ছবিটি প্রকাশিত হলে দ্রুতই তা ভাইরাল হয়ে যায়। দ্য ডেইলি স্টারের ফটো সাংবাদিক ফিরোজ আহমেদের তোলা ছবিটি নিয়ে সামাজিক মাধ্যম ও মূলধারার গণমাধ্যমে নানান আলোচনা-সমালোচনা চলছে। ইয়ামিনের সাথে তার মা ঝর্ণা আক্তারের বোরকা পরিহিত অবস্থায় ক্রিকেট খেলা থেকেই এই আলোচনার সূত্রপাত।

১১ বছর বয়সী ইয়ামিন একজন মাদ্রাসা শিক্ষার্থী। আরামবাগের একটি মাদ্রাসায় সে লেখাপড়া করে। করোনাকালিন সময়ে লেখাপড়ার পাশাপাশি ক্রিকেট শিখতে সে একটি কোচিং স্কুলে যায়। তার মায়ের স্বপ্ন একদিন ইয়ামিন বড় ক্রিকেটার হবে, জাতীয় পর্যায়ে ক্রিকেট খেলবে। অন্যান্য দিনের মত সেদিনও সে কোচিং স্কুলে গিয়েছিল কিন্তু সেখানে তার খেলার সঙ্গীরা তখনও উপস্থিত না হওয়ায় তার মা ঝর্ণা আক্তারের সাথে ক্রিকেট খেলতে শুরু করে। ছবিতে দেখা যায় তিনি বোরকা পরিহিত অবস্থায় ছেলের বিপক্ষে ব্যাট করছেন। একজন মা তার সন্তানকে ক্রিকেট খেলতে উৎসাহ দিতে নিজেই ক্রিকেট পিচে ব্যাট করতে নেমে গিয়েছেন। এটি অত্যন্ত ইতিবাচক ঘটনা। এ ধরণের ঘটনা অবশ্যই সমাজে নারীদের সাহসী ভূমিকাকে স্পষ্ট করে তোলে। সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই ঝর্ণা আক্তারের ক্রিকেট মাঠে নামার ঘটনাটিকে একটি বৈপ্লবিক ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একজন মা তার ছেলের সাথে উন্মুক্ত প্রান্তরে ক্রিকেট খেলছেন এটা বিশেষ ঘটনা। কিন্তু এটিকে বৈপ্লবিক ঘটনা না বলার পক্ষে কিছু যুক্তি দাঁড় করানো যায়।

ছবিটির ক্যাপশন না পড়লে বোঝার উপায় নেই ঘটনাটি সেক্যুলার বাংলাদেশে নাকি ধর্মীয়ভাবে অবরুদ্ধ কোন সমাজে ধারণকৃত। বাংলাদেশ একটি ধর্ম নিরপেক্ষ দেশ। এখানে নানা ধর্ম বিশ্বাস ও মতবাদের মানুষের বসবাস। পৃথিবীর অন্যান্য জাতির ন্যায় আমাদেরও রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি ও কৃষ্টি। কিন্তু একটি ব্যাপারে আমরা অনন্য। আমাদের সংস্কৃতি ও পোশাক অবরুদ্ধ নয়। আমরা জানি পোশাকের উদ্দেশ্য লজ্জা নিবারণ, শরীরকে সুরক্ষা দেওয়া এবং একই সাথে সৌন্দর্য বৃদ্ধিকরণ। আমাদের পোশাক আমাদের আবহাওয়ার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ও শারীরিক সৌন্দর্য বৃদ্ধিকারক। অন্যদিকে বোরকা-হিজাবের মত পোশাক মানুষকে অবরুদ্ধ করে তোলে। যুগে যুগে নারীর উপর পুরুষের কর্তৃত্ব স্থাপনের চেষ্টার একটি নিদর্শন এই পোশাক।

বাংলাদেশের ইদানিং অনেক নারী বোরকা পরেন। ঝর্ণা আক্তার তেমনই একজন। এই পোশাকটি বাংলার প্রাচীন পোশাক নয়। বোরকা মূলত গরম লু-হাওয়া বয়ে যাওয়া মধ্যপ্রাচ্যের পোশাক। উক্ত দেশগুলোতে ইসলাম ধর্মের উৎপত্তি ও বিকাশের কারণে ইসলামি সংস্কৃতির সাথে এই পোশাক একীভূত হয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশে আরব পরিব্রাজকদের মাধ্যমে ইসলামের প্রসারের সাথে সাথে সেখানকার পোশাক বোরকা-হিজাবও চলে আসে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে বোরকা ও হিজাবের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। মাত্র ২০-৩০ বছর আগেও যেটি দেখা যেত না। এখনকার নারীরা ধর্মীয় কারণেই মূলত বোরকা ও হিজাব পরে থাকেন। তবে অনেকেই এই পোশাককে ফ্যাশনের অনুষঙ্গ হিসেবে দেখতে শুরু করেছেন। বাংলাদেশে এই পোশাকের জনপ্রিয়তার উৎস নিশ্চিতভাবে একটি গবেষণার অংশ হতে পারে।

‘হিজাব’ একটি আরবি শব্দ। যার অর্থ ‘ঢেকে রাখা’ বা ‘বন্ধ করে রাখা’। আরব ভাষাতত্ত্ববিদ রাখিব এর মতে, ‘আল-হিজাব’ হলো এক ধরণের বাধা, যার প্রধান উদ্দেশ্য হলো কোন একটি বিষয় বা বস্তুর নাগালে বাধা প্রদান করা। বর্তমানে মেয়েরা যে হিজাব পরে তা এক ধরণের মস্তক-আবরণী। এর সঙ্গে দেখাবরণীর সংযোগ থাকতেও পারে আবার নাও পারে। লক্ষ্যণীয় বিষয় হল মুসলমানদের ধর্মীয় গ্রন্থ কোরানে পোশাক পরিচ্ছদ হিসেবে হিজাব শব্দটির উল্লেখ পাওয়া যায় না। বরং কোরান পুরুষ ও নারী উভয়কেই তাদের দৃষ্টি, হাঁটাচলা, পোশাক ও গোপনাঙ্গের ব্যাপারে সতর্ক ও সংযত থাকার উপদেশ দিয়েছে। ৭ম শতকে নারীদের বুকের উপর ‘খিম’ বা শাল ব্যবহারের নির্দেশ আসে। বিশেষ করে তখন বিশেষ করে যখন তারা বাইরে বের হত তখন। তাদের উদ্দেশ্যে আরও বলা হয় তারা যেন ‘জিনাত’ বা সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে।

ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক ও নবী হযরত মোহাম্মদ (সঃ) এর সময়েও হিজাবের প্রচলন ছিল তেমন প্রমাণ পাওয়া যায় না। তবে তখন তাঁর স্ত্রীদের মাথা বিশেষ পোশাকে আচ্ছ্বাদিত করার প্রমাণ মেলে। মূলত তারা সমাজের সম্ভ্রান্ত অংশের প্রতিনিধিত্ব করছেন এটা বোঝাতেই এই পোশাক পরিধানের নির্দেশনা ছিল। হিজাবের বাধ্যবাধকতা ধর্মের সাথে বস্তুত সম্পর্কযুক্ত নয়। তবে ইতিহাস থেকে জানা যায় গ্রিক, রোমান, জরাথুস্ত, ইহুদী এবং সনাতনধর্মী আরবীয় উচ্চ বংশীয় এবং ধর্মযাজকগণ তাদের মেয়েদের সম্মান ও মর্যাদার প্রমাণস্বরূপ শরীরের উপর আচ্ছ্বাদন ও পর্দার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে।

ভারতবর্ষে হিন্দু সম্প্রদায়ের মাঝে একধরণের হিজাবের প্রচলন ছিল। এর নাম ছিল ‘ঘুঙ্ঘট’। একইভাবে ইহুদী ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের মাঝে প্রচলিত আছে, ‘যে নারীর চুল প্রকাশিত হবে সে হবে অভিশপ্ত এবং আবরণহীন মস্তক অবমাননাকর’। তবে পাশ্চাত্য সমাজে এখনো কিছু খ্রিস্টানদের মাঝে, মেরু অঞ্চলের কিছু দেশে, আফ্রিকাতে এবং বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যে এর ব্যবহার লক্ষ্যণীয়।

একইভাবে বোরকার ইতিহাস জানতে গেলেও দেখা যায় গ্রিক নারীরা প্রথম এ ধরণের পোশাক পরে। প্রাচীন গ্রিক, পার্সিয়ানদের পাশাপাশি খ্রিস্টপূর্ব ১৪০০ সালের দিকে মেসোপটেমিয় সভ্যতায়ও নারীদের শরীরের উপরে অতিরিক্ত কাপড় দ্বারা আচ্ছ্বাদিত করার নির্দেশ পাওয়া যায়। মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকান সমাজে নারীদের শরীরে ঢিলেঢালা বোরকার অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায় মূলত আবহাওয়াগত কারণে। পৃথিবীর উষ্ণ অঞ্চলের মানুষ গরম থেকে বাঁচতে এ ধরণের পোশাককে বেছে নেয়। ভারতীয় উপমহাদেশে বোরকার আগমণ মূলত মুঘল শাসকদের হাত ধরে। মুঘল আমলে ভারতের সম্ভ্রান্ত মুসলিম নারীগণ এ ধরণের পোশাক পরিধান করা শুরু করেন। অন্য দিকে খ্রিস্টান, ইহুদী কিংবা শীত প্রধান দেশের বিশেষ কিছু সম্প্রদায়ের মাঝেও বোরকা জাতীয় পোশাক পরিধানের নিদর্শন লক্ষ্য করা যায়।

আমাদের সমাজে অনেকের ধারণা বোরকা জাতীয় পোশাক নারীকে সম্মান এনে দেয়। নিরাপত্তা প্রদান করে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। অবরুদ্ধ পোশাক কখনো নারীকে নিরাপত্তা প্রদান করতে পারে না। নারীকে নির্যাতন ও ধর্ষণের হাত থেকে বোরকা জাতীয় পোশাক নিরাপত্তা প্রদান করে এটা অলীক ধারণা মাত্র। বলা হয়ে থাকে বোরকা-হিজাব পরিধান করলে নারীর শরীর লুকায়িত থাকে। বাস্তবতা হল মানব শরীর কেমন তা আমরা সকলে জানি। একজন শিশু কিংবা বোরকা পরিহিতা নারী যখন ধর্ষণের শিকার হন তখন এই তত্ত্ব মিথ্যা প্রমাণিত হয়। তাই এই পোশাকের যৌক্তিকতা আমাদের উপলব্ধ নয়।

একজন মানুষ নিশ্চিতভাবেই যে কোন পোশাক পছন্দের অধিকার রাখেন। মানুষ তার রুচি, পছন্দ ও পরিবেশ বুঝে পোশাক পছন্দ করবে সেটিই স্বাভাবিক। আধুনিক মানুষ সমাজে নারী ও পুরুষের সমান অধিকারের পক্ষে কথা বলে। সেখানে নারীকে পোশাক দ্বারা অবরুদ্ধ করে রাখার সুযোগ নেই। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলেও পুরুষকে যে চোঁখের পর্দার নির্দেশ দেওয়া আছে তা তারা মানে না। বরং ঐতিহাসিকভাবেই নারীর উপরে অতিরিক্ত পোশাকের চাপ এসেছে যুগ যুগ ধরে। নারীর পোশাক কি হবে তা নির্ধারণ করে দিয়েছে পুরুষ। আজকের ঝর্ণা আক্তার কি পরবেন তা নিয়ে মন্তব্য করার অধিকার আমাদের নেই সত্য কিন্তু প্রশ্ন হল তিনি যা পরছেন তা নিজে বুঝে পরছেন নাকি পুরুষের দাসত্ব করতে পরছেন। এই প্রশ্নটিই গুরুত্বপূর্ণ! বিষয়টি সত্যিই বুঝলে কিংবা উপলব্ধি করলে বাংলাদেশের মানুষ হয়তো এই অবরুদ্ধ পোশাকটি বেছে নিত না।

আমাদের অনেকেই ক্রিকেট খেলারত ঝর্ণা আক্তারের ছবিটিতে বাংলাদেশের অগ্রগতি ও সামাজিক প্রগতির চিহ্ন খুঁজে পান। কিন্তু বাস্তবতা হল তিনি আমাদের পশ্চাৎপদতার একজন নিদর্শন। তিনি মূলত অবরুদ্ধ সমাজের প্রতিনিধিত্ব করছেন। একজন ঝর্ণা আক্তার নন বরং বাংলাদেশের সামাজিক গ্রগতির নিদর্শন হলেন জাতীয় ক্রিকেটার সালমা খাতুন কিংবা জাহানার আলম। আমাদের প্রগতির নিদর্শন এভারেস্ট বিজয়ী ওয়াজফিয়া কিংবা নিশাত। যারা পুরুষের ন্যায় প্রতিযোগিতা করেন। তাই আমাদের সচেতন থাকা জরুরি যে আমরা যেন বিভ্রান্তির মাঝে বসবাস না করি। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না অবরুদ্ধ অবস্থায় বসবাস করে কেউ আলোর প্রদর্শক হতে পারে না।

 

(ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য)