পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে লিপস্টিকওয়ালীর স্বপ্ন
শাকিল মাহমুদ।।
১
এই কিছুদিন আগেই গোটা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সরগরম ছিলো বোরখা নিয়ে। কে কী পরবে আর কে কী পরবে না এ হিসেব কষতেও বসে গিয়েছিলেন অনেকে। এই অনেকের আবার দুটি অংশ। এক অংশ বরাবরই নারী কী পরবে কী পরবে না তা খোদ নিজেই ঠিক করবে বলে এসেছে। আরেক দল, যারা রোজ নারীকে ধর্মের দোহাই দিয়ে পর্দার আড়ালে থাকার জন্য বাধ্য করেছে। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, বোরখা নিয়ে আলাপ উঠার পর পরই দ্বিতীয় পক্ষ সুর পাল্টে বলতে শুরু করলেন, পোশাক তো পোশাকই। কে কী পরবে সেটা তার ইচ্ছে! বলুন তো আশ্চর্য না হয়ে পারা যায়? এতকাল যে দল নারী কেন জিন্স পরলো, শার্ট, টি-শার্ট পরলো, এসব পরলে দেশটা তো রসাতলেই যাবে ইত্যাদি বলে বলে হাঁপানিতে ভুগতে শুরু করে দিয়েছিল- তারা যখন বোরখা নিয়ে কথা বলার পর ‘পোশাক পরা যার যার ইচ্ছার ব্যাপার’ বলে, তখন সত্যিই বিষয়টা চরমমাত্রায় হিপোক্রেসি নয় কি!
এই যেমন, হেফাজত ইসলাম বাংলাদেশের রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম রাখার জন্য লম্ফঝম্ফ করে ভারতকে ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র করার দাবি জানানোর মত আর কি!
তবে এই যে বোরকা নারী নিজের ইচ্ছাতে পরে- এ নিয়ে আমার প্রচুর সন্দেহ আছে। এ নিয়ে অবশ্য আমি বোরকা সমর্থকদের সঙ্গে একটা চ্যালেঞ্জেও যেতে চাই। মানে, বোরখা পরিহিতা নারীদের উপর জরিপ চালানো যেতে পারে। যেমন, তারা বোরখা কি নিজের ইচ্ছেতে পরে? এমন প্রশ্ন নিয়ে দেশের প্রতিটা বোরখা পরা নারীর উপর এ জরিপ চলবে। ফলাফল কী আসে সেটা দেখা হবে। এরপর ঠিক হতে পারে নারী আসলেই নিজ ইচ্ছেতে বোরকা পরে কিনা! এবং নিজ ইচ্ছেতে না পরলে কার হস্তক্ষেপ রয়েছে?
সে যা হোক, উপরের কথাগুলো পরের অংশের জন্য বেশ প্রাসঙ্গিক মনে হলো বলেই লিখলাম৷
এবার আসি মূল আলোচনায়। তার আগে বলে নিই, সিনেমা নিয়ে আমি কোনো রিভিউ লিখি না। এসব লেখা সিনেমা দেখে গল্পের, নির্মাতার দর্শন নিয়ে আমার বিশ্লেষনাত্মক মূল্যায়ন ছাড়া ভিন্ন কিছু নয়৷ সেক্ষেত্রে লেখা ওই সিনেমার গল্পের চেয়ে বড় না ছোট তা নিয়ে আপনাদের মাথা ব্যথা না হলেই বরং আমার শান্তি লাগবে।
২
চোখ তুলে তাকিও না, লোকে কী বলবে?
জোরে শ্বাস নিও না, বুকের দিকে তাকাবে।
জোরে হেসো না, লোকে কী ভাববে?
লোকে কী বলবে, ভাববে, তাকাবে! নারীর জীবনটা যেন লোকের জন্য, নিজের জন্য তার কিছু নেই!
নারী স্বপ্ন দেখবে, লুকিয়ে লুকিয়ে। হাঁটবে, পা টিপে টিপে, কাঁদবে কিন্তু চোখের জল ফেলা যাবে না-সহ ইত্যাকার বিধি-নিষেধ দিয়ে দেবে সমাজ; পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। তবুও মন পাখির মত। লোহার খাঁচা ভেঙে বেড়িয়ে এসে আকাশে ডানা মেলতে চাওয়া কিংবা মেলে উড়ে বেড়ানোই তার জন্মগত স্বভাব। হাজারও বাঁধা, সহস্র রক্তচক্ষুর পরোয়া না করেই নারী হাত বাড়ায় স্বপ্ন ছুঁতে। নারী চায় নিজের মত বাঁচতে।
লিপস্টিক আন্ডার মাই বোরখা- অলংকৃতা শ্রীবাস্তবের নির্মিত সিনেমা৷ সিনেমাটি নিয়ে সে সময় বেশ বিতর্ক তৈরি হয়। অবশ্য ট্যাবু নিয়ে কথা বললে এ সমাজে বিতর্ক হবে না এটা মেনে নেয়া যায় না। নারীর ডানা কেটে ওড়া বন্ধ করে পায়ে বেঁড়ি পরিয়ে দেয়া পুরুষতান্ত্রিক সমাজের জিনগত অভ্যাস। ক্ষমতা হাত ছাড়া হয়ে যাওয়ার ভয় না অন্য কিছু তা ঠিক বোঝার উপায় না থাকলেও যুগ যুগ ধরে নারীর উপর তার কর্তৃত্ব হঠাৎ করেই বিলীন হয়ে যাচ্ছে- এটা মেনে নেয়া খুবই কঠিন। সুতরাং বিদ্যমান ট্যাবুর সঙ্গে নানা বিষয় যেমন, নারীর চরিত্রে কালিমা লেপন করে হলেও এ ট্যাবুর বিরুদ্ধে চলমান প্রয়াস রুখে দিতে হবে; এটা তাদের পুরুষতান্ত্রিক দায়িত্ব!
নারীর পোশাক নারীই ঠিক করবে। ধর্ম নয়, সমাজ নয়, পরিবার নয়। স্বামীর যৌন সুখ মেটানো এবং বছর বছর বাচ্চা জন্ম দেয়াই স্ত্রীর কাজ নয়। এর বাইরেও নারীর নিজস্ব একটা পৃথিবী থাকতে পারে। জোর করে ইচ্ছের বিরুদ্ধে অন্যত্র বিয়ে দিয়ে দেয়ার বন্দোবস্ত করা এবং হবু বরের কাছে মেয়েটার ইচ্ছের দামের চাইতে যৌন সুখ পুরুষটি কতটা পাবে, তা কতটা আকর্ষণীয় হয়ে ধরা দেবে- তা ভেবে সেক্সকে বাসর রাতের জন্য তুলে রাখছে। অথচ এটা যে নির্দিষ্ট দিনের জন্য নয়, শরীরের ইচ্ছেনুসারে চাহিদামত যেকোনো সময়। মাঝ বয়সী নারীর মন বলে একটা কিছু যে আছে, তা তো আমরা ভুলেই যাই। প্রেম, যৌনতা তাদেরও স্বাভাবিক চাহিদা।
সিনেমাটিতে নির্মাতা চারজন নারীর চার স্তরের মনস্তত্ত্ব ও চার রঙা স্বপ্নকে আলাদা আলাদাভাবে দেখিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু রসুনের গোঁড়া সব এক জায়গায়; পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীর স্বপ্নকে দুমড়ে মুচড়ে দেবে- সে বিষয়টি স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন।
তবে সব বাঁধা ডিঙ্গিয়ে নারী আবার স্বপ্ন ছুঁতে মরিয়া হয়ে যায়।
অলংকৃতা শ্রীবাস্তবের সামাজিক প্রেক্ষাপট নিয়ে আদর্শিক ভাবনা, দর্শন সমাজে বিদ্যমান ট্যাবু নিয়ে কথা বলার যে রুদ্ধ পথ, তা মসৃণ করার চেষ্টায় এ সিনেমাটি নিঃসন্দেহে অনন্য নিদর্শন। সমাজে হরহামেশা ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোকে একসুতোয় গেঁথেছেন নির্মাতা।
নারী নিজে তার পোশাক ঠিক করতে চায় বলে রাষ্ট্রের বাহিনী হেনস্থা করছে। বাচ্চা জন্মানোই নয়, নারীর সুখের জন্যে যৌনতা প্রয়োজন এবং নিজের একটা জীবন রয়েছে- তাই সেক্স করার সময় কনডম ব্যবহার করাকে লজ্জার বলে ফেলে দেয়া, নারীর শরীর কেবল বাসর রাতে স্বামীর মনোরঞ্জনের জন্য, এমন একটি পুরুষতান্ত্রিক বিকারগ্রস্থ ভাবনা এবং মাঝবয়সী নারী কামসূত্র পড়বে কেনো? প্রেমের জন্য হা-হুতাশ করবে কেন? সমাজই যেন ঠিক করে দেবে নারীর জন্য কোনটা ঠিক আর কোনটা বেঠিক! ঠিক এসব ট্যাবুর বিরুদ্ধে অলংকৃতার বক্তব্য পুরুষতান্ত্রিক সমাজের টনক নড়িয়ে দিতে বাধ্য।
৩
সিনেমায় শিরিন নামের এক সেলসগার্ল চরিত্রে অভিনয় করেন কঙ্কনা সেন। স্বামীর কাছে চাকরীর বিষয়টি গোপন রাখেন তিনি। পরিবারে শিরিন স্রেফ বাচ্চা জন্মানোর মেশিন। তার ইচ্ছে-অনিচ্ছের কোনো তোয়াক্কা না করে স্বামী রোজ সেক্স করে চলে। পারতপক্ষে এ ধরণের সেক্সুয়াল ক্রিয়াকে ধর্ষণ বলে। অর্থাৎ শিরিন রোজ তার স্বামীর দ্বারা ধর্ষিত হচ্ছে। স্বামীর অন্য মহিলার সঙ্গে প্রেম জেনেও সে সবে মাথা ঘামান নি। বরং মন দিয়েছেন নিজের পায়ে দাঁড়ানোর উপায়- চাকরির দিকে৷
একজন মধ্যবিত্ত নারী অথচ আত্মনির্ভরশীল হওয়ার স্বপ্ন চোখে নিয়ে কঙ্কনা সেন শিরিন চরিত্রে মিশে গেছেন। অবশ্য এ ধরণের চরিত্রের সঙ্গে নারীরা বাস্তবিক ক্ষেত্রে পরিচিত বলে চরিত্রগুলো গ্রহণ করতে বেগ পেতে হয় না, যা কঙ্কনার অভিনয়ে ফুটে উঠেছে৷
লীলা চরিত্রের এক বিউটিশিয়ান হিসেবে দেখা যায় আহানা কুমারকে। স্বপ্নাতুর চোখ আর প্রেমিকের সঙ্গে যৌন জীবন তাকে আকাশে ভাসিয়ে নিয়ে গেলেও বিপত্তি আছে তার জীবনেও। অভিনয়ের ক্ষেত্রে নিজের চরিত্রের মনস্তত্ব তিনিও ফুটিয়ে তুলেছেন নিজ গুনের মহিমায়।
রিহানা নামের এক শিক্ষার্থীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন প্লাবিতা বরঠাকুর। নিজের ছটফটে উড়তে চাওয়া পাখিসুলভ মনটাকে বোরখার নিচে চেপে ঘর থেকে বের হন। কিন্তু কতক্ষণ আর বেঁধে রাখা যায়? জিন্স পরা তার অধিকার স্লোগান নিয়ে বুঝিয়ে দেন, বোরখা সে চায় না। নিজের মন মতই সে পোশাক পরবে। প্লাবিতাকেও এখানে নিজেকে উৎরে যেতে দেখা যায় নি। উপরন্তু চরিত্রের মাঝে বেশ কিছু জোরালো সংলাপ তার জন্যেই সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে হবে৷
সর্বশেষ অর্থাৎ আমি এই চরিত্রকে তুরুপের তাস হিসেবে আখ্যায়িত করবো। ঊষা চরিত্রের এক বৃদ্ধা মহিলা হিসেবে আবির্ভূত হন রত্না পাঠক শাহ।
শরীরের বয়স বেড়েছে কিন্তু শরীরের চাহিদা কি তাই বলে কমে যাবে? তারও তো ইচ্ছে হয় প্রেমে পড়তে, প্রেমিককে চুমু খেতে, তার সঙ্গে সেক্সুয়াল সম্পর্ক গড়তে! কিন্তু সমাজ? তার এসব বিষয় তো দূর, সুইমিং কস্টিউমের ব্যাপারটাই মেনে নিতে পারলো না! রত্না পাঠক এ চরিত্রের জন্য ঠিকঠাক নির্বাচিত হলেও অভিনয়ে অন্যান্যদের ছাড়িয়ে গেছেন। বিশেষ করে শেষ দৃশ্যে তার অভিনয় এবং পুরো সিনেমায় একজন বৃদ্ধ শরীরে তরুণী মন নিয়ে ঘুরে বেড়ানো- এক কথায় রত্না পাঠক ব্রিলিয়ান্ট অভিনেতা৷
এছাড়াও অন্যান্য চরিত্রগুলো নিজেদের মত ঠিকঠাক ছিলেন। সিনেমায় অভিনয়ের পর দ্বিতীয় মাত্রা যোগ করেছে মিউজিক। বিশেষ করে জেবুন্নিসা বাঙ্গাস ও অনভিতা দত্তের কন্ঠে লে লি জান গানটি ভিন্ন অনুভূতি তৈরি করে।
আর লিপস্টিক নিয়ে আলাপটা কি? ওটা নারীর প্রতি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রতি প্রতীকী খোঁচা। যেমন পিঙ্ক রঙ মানেই নারীদের জন্মসূত্রে পাওয়া রঙ। নারীরা এর বাইরে রঙ পছন্দ করবে না। আর ছেলেরা পিঙ্ক রঙ ব্যবহার করবে না, করলেও সমাজে তাদেরকে ‘মেয়েলীপনা’ সম্ভাবের বলে তীরটা নারীকেই ছোড়া হবে।
৪
শেষ বেলায় এসে সিনেমা নিয়ে নয়, নিজের কথা বলবো। সিনেমা স্রেফ বিনোদনের জন্য নয়। যদি বিনোদন পাওয়ার জন্য এ সিনেমা দেখতে চান তবে আপনি ভুল করবেন। সিনেমা, শিল্পের পরতে পরতে থাকে দর্শন, ভাবনার খোরাক। ফলে এ সিনেমার দর্শককে চিন্তার জগতে হতে হবে বিশাল, অতি সহনশীল এবং সেই সাথে সময়ের সঙ্গে চলার মানসিকতা নিয়ে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মত মেরুদণ্ড থাকা চাই। নচেৎ এ সিনেমা আপনাদের বদহজমের কারণ হবে৷ আর লিপস্টিক আন্ডার মাই বোরখার গল্পের মত সমাজে রোজ নিপীড়িত হওয়া, স্বপ্নভঙ্গ হওয়া নারীর কথা বলা সিনেমাগুলো পুরুষতন্ত্রের কাছে বিষের মতই হবে। তাই এ সিনেমাকে অনেকে সফট-পর্ণও বলে অভিহিত করেছে। অথচ এরাই গোপন পর্ণ সাইটে গিয়ে পর্ণ ভিডিও দেখে অতৃপ্ত যৌন সুখ লাভ করে তুষ্ট হন। ট্যাবু নিয়ে কথা বললেই সব খারাপ, চরিত্রহীন।
বাংলাদেশের মত সুশিক্ষায় মূর্খ অথচ ধর্মীয় জ্ঞানে অন্ধ দেশে প্রায় ২০ কোটি মানুষ হয়েছে সেক্স না করে! কনডম নিয়ে কথা বলা শরমের, যৌনতা নিয়ে সিনেমা বানানোকে নষ্টামি বলা অতিশিক্ষিত ধার্মিক ও জ্ঞানপাপী পুরুষতন্ত্রের ধ্বজাধরাদের নিয়ে আর কিছু বলার নেই। তবে নারীকে নিজের মত বাঁচতে দেন। তারা কারো দাসী নয়, ভোগের বস্তু নয়।
শাকিল মাহমুদ: সাংস্কৃতিক কর্মী ও সাংবাদিক