November 21, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

সৌদি আরবে নারী শ্রমিক নির্যাতন ও মৃত্যু: সংকট আসলে কোথায়?

কায়সুল খান।। বিগত কয়েক বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্য থেকে নির্যাতিত ও শ্রমশোষিত হয়ে দেশে ফেরত আসছেন অসংখ্য নারী কর্মী। তবে সবাই যে জীবন নিয়ে ফেরত আসতে পারছেন তেমনটি নয়। অনেকেই অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরছেন লাশ হয়ে। বিশেষত সৌদি আরব থেকে নির্যাতিত কিংবা মৃত অবস্থায় ফেরত আসা নারী কর্মীর সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১৬ থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্য থেকে ৩৩১ জন নারী কর্মীর লাশ বাংলাদেশে ফেরত আসে যার অধিকাংশই সৌদি আরব থেকে। মৃত এই নারী কর্মীদের বয়স ২০ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। এদের ৫৩ জন আত্মহত্যা করেছেন, ১২০ জন মারা গেছেন স্ট্রোকে, ৫৬ জন দুর্ঘটনায় মারা যান। বাকিদের মৃত্যুর কারণ অন্যান্য। এই তালিকা ও মৃত্যুর কারণ দেখেই বোঝা যায় কতটা নিদারুণ কষ্টকর পরিস্থিতিতে তারা কাজ করতে বাধ্য হন সে সব দেশে।

বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্যে যে সব নারী কর্মী যান তাদের মধ্যে একজন ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার গোকর্ণ ইউনিয়নের নূরপুর গ্রামের শহিদুল ইসলাম ও নাসিমা বেগম দম্পতির মেয়ে উম্মে কুলসুম (১৪)। এই কিশোরী কর্মী অনেক স্বপ্ন নিয়ে গিয়েছিলেন সৌদি আরবে। পরিবারকে আর্থিকভাবে একটু সহায়তা করার পাশাপাশি নিজেও একটু উন্নত জীবনের আশা নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমান তিনি। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর থেকে গৃহকর্তা ও তার ছেলে কুলসুমকে ধর্ষণ করে। কুলসুমের দুই হাটু, কোমর ও পা ভেঙে দেয়। এর কিছুদিন পরে একটি চোখ নষ্ট করে তাকে রাস্তায় ফেলে দেয়। সৌদি পুলিশ রাস্তা থেকে কুলসুমকে উদ্ধার করে সেখানকার কিং ফয়সাল হসপিটালে ভর্তি করলে গত ৯ আগস্ট সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। গত ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২০ তারিখে কুলসুমের বাবা-মায়ের বহু চেষ্টা তদবিরের পর তার লাশ বাংলাদেশের মাটিতে ফেরত আসে। কিন্তু এই ধর্ষণ ও মৃত্যুর ঘটনা বিদেশের মাটিতে সংঘটিত হওয়ায় এই ঘটনার বিচার পাওয়ার ব্যাপারে সংশয় দেখা দিয়েছে।

বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্যে নারী কর্মী প্রেরণ শুরু হয় নব্বইয়ের দশকের শুরুতে। তখন পরিবারকে একটু আর্থিক সঙ্গতি প্রদান তথা স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে যেতেন বাংলাদেশের নারীরা। শুরুর দিকে স্বল্প সংখ্যক নারী কর্মী সেখানে গেলেও নির্যাতনের সংবাদ খুব একটা পাওয়া যেত না। বাংলাদেশের তুলনায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে উপার্জন ভালো হওয়ায় সে সময় অনেকেই মধ্যপ্রাচ্যের এই শ্রমবাজারে অংশগ্রহন করেন। তৎকালিন সময়ে নারী কর্মী পাঠানোর আইনি বৈধতা না থাকায় তারা শ্রমশোষণের শিকার হচ্ছিলেন। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষেও বিদেশে তাদের আইনি সাহায্য সহযোগিতা প্রদান করা সম্ভব হয়ে উঠছিল না। পরবর্তীতে ১৯৯৭-৯৮ সালের দিকে বিদেশে নারী কর্মী পাঠানোর নামে ব্যাপকভাবে নারী পাচার শুরু হয়। এই অবস্থায় বাংলাদেশের সচেতন নাগরিক সমাজ বিদেশ গমনিচ্ছুক নারী কর্মীদের অধিকারের পক্ষে সোচ্চার হয়। ফলে সরকার এক রকম বাধ্য হয়ে ২০০৩ সালে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নারী কর্মী অর্থাৎ গৃহকর্মী পাঠানোর একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে। এই নীতিমালা অনুযায়ী, নারী কর্মীর বয়স অবশ্যই ২৫ হতে হবে। তাদের ছোট বাচ্চা থাকতে পারবে না। বিদেশে যাওয়ার প্রশ্নে বাবা কিংবা বিবাহিত হলে পার্টনারের অনুমতি লাগবে।

২০০৩ সালে তৎকালিন সরকারের আমলে বিদেশে নারী শ্রমিক প্রেরণের জন্য এইসব বিধান রেখে নীতিমালা প্রণীত হলে বাংলাদেশ থেকে ব্যাপক সংখ্যক নারী মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াসহ পৃথিবীর বিভিন্ন  স্থানে গৃহকর্মী হিসেবে যেতে শুরু করে। বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্যে গৃহকর্মী হিসেবে যাওয়া নারী শ্রমিকের সংখ্যা ১০ লাখেরও বেশি। এদের অধিকাংশ গেছেন সৌদি আরবে। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর এক পরিসংখ্যান মতে, ১৯৯১ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সৌদি আরবে যাওয়া বাংলাদেশি নারী কর্মীর সংখ্যা ৩ লাখ ৩২ হাজার ২০৪ জন। এর মধ্যে ২০১৭ সালেই গেছেন ৮৩ হাজার ৩৫৪ জন নারী কর্মী। সৌদি আরব ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের জর্দান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, লেবানন প্রতিটি দেশেই ১ লাখের অধিক নারী কর্মী পাঠিয়েছে বাংলাদেশ। এছাড়া কাতার, কুয়েত, ওমান, বাহরাইন, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশেও আমাদের দেশ থেকে নারী কর্মী পাঠানো হয়।

বাংলাদেশ থেকে যাওয়া নারী কর্মীদের অধিকাংশই বিদেশে নানা ধরণের শোষণ ও নির্যাতনের শিকার হন। বাংলাদেশে বিদেশে পাঠানো কর্মীদের অধিকার রক্ষা, নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য বিশেষ আইন নেই। বর্তমান আইনি কাঠামোর মধ্যে ‘বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইন-২০২০’ এর মাধ্যমে বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্টদের বিচার এবং ক্ষতিপূরণ আদায় করা সম্ভব। অন্যদিকে ‘মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন বিধিমালা-২০১৭’ নামে আরেকটি আইন রয়েছে যার মাধ্যমে নারী কর্মীদের পাচার সংশ্লিষ্ট কেইসের বিচার করা সম্ভব। তবে এসব আইনি প্রক্রিয়া জটিল ও সময়সাপেক্ষ হওয়ায় নির্যাতিত অধিকাংশ নারী কর্মীই তার সুফল ভোগ করতে পারেন না। পাশাপাশি এগুলোর অনেক বিধান অস্পষ্ট। যা নির্যাতিত কিংবা শ্রম শোষণের শিকার হওয়া নারীদের অধিকার রক্ষার পথে অন্যতম প্রধান অন্তরায়। আবার মধ্যপ্রাচ্যের বেশির ভাগ দেশের আইনে মালিকপক্ষকে অবাধ সুবিধা দেয়া ও পুরুষবান্ধব আইন থাকা এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাংলাদেশি গৃহকর্মীরা নির্যাতনের শিকার হলেও তা পুলিশের কাছে অভিযোগ করার সুযোগ না থাকায় সেসব দেশের আইনেও বিচার পাচ্ছেন না। ফলে তারা পড়েছেন উভয় সংকটে।

যে সকল নারী কর্মী বৈধ উপায়ে ও সরকারি সমঝোতা স্মারকের আওতায় সৌদি আরব, কাতার, কুয়েতহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে যাচ্ছেন তাদের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা দিতে এই আইনের বিশেষ ভূমিকা নেই। বাংলাদেশ যদি প্রবাসী নারী শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত, শ্রম অধিকার নিশ্চিত ও নির্যাতন প্রতিরোধ করতে চায় সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সাথে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্থাপন করা জরুরি। উক্ত চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ ও বিদেশের রিক্রুটিং এজেন্সি এবং শ্রমিকেরা যাদের জন্য কাজ করে সেই পক্ষ এর বিচারের নিশ্চিতে উভয় দেশের আইনের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার ব্যবস্থা থাকা উচিত।

মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করা অধিকাংশ দেশই নারী কর্মীদের ন্যূনতম পারিশ্রমিক নির্ধারণ করেনি। একমাত্র ব্যতিক্রম হিসেবে কুয়েত ৬০ কুয়েতি দিনার (২০০ মার্কিন ডলার) নির্ধারণ করেছে। বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোও মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করা কর্মীদের জন্য যে ন্যূনতম পারিশ্রমিক বাস্তবায়নের চেষ্টা চালাচ্ছে তা এই অংকের সাথে সাযুজ্যপূর্ণ। তবে অধিকাংশ দেশগুলো থেকে বাংলাদেশের সরকার সেভাবে সাড়া না পাওয়া যাওয়ায় অধিকাংশ বাংলাদেশি নারী কর্মী ন্যায্য পারিশ্রমিক থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

বাংলাদেশ থেকে যে সকল নারী কর্মী বিদেশে কাজের উদ্দেশ্যে যান তাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা জরুরি। আমাদের দেশে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকলেও তা সীমিত এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ততটা আধুনিক ও সময়োপযোগী নয়। সরকারের এই ব্যাপারে সুদৃষ্টি দেওয়া উচিত। পাশাপাশি নারী কর্মীদের শ্রম অধিকার নিশ্চিত, নির্যাতন প্রতিরোধ, ন্যূনতম বেতন বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন দেশের সাথে দ্বিপাক্ষিত চুক্তি থাকা জরুরি। একই সাথে আন্তর্জাতিক শ্রম আইন বাস্তবায়নে উভয় দেশের সচেষ্ট থেকে কাজ করা সময়ের দাবি।

ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের দেওয়া তথ্য মতে, ২০২০ সালেও মধ্যপ্রাচ্য থেকে অসংখ্য নারী কর্মী দেশে ফেরত এসেছেন। অনেকে ফিরেছেন লাশ হয়ে। প্রতি বছরই এই নির্যাতিত ও নিহত কর্মীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই অবস্থার দ্রুত অবসান হওয়া জরুরি। সে জন্য রিক্রুটমেন্ট এজেন্সিগুলোর উপর সরকারের কঠোর নজরদারি স্থাপন ও কর্মী গ্রহণকারী দেশগুলোর সাথে কূটনৈটিক সাফল্য অর্জন করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]