May 15, 2024
জীবনের গল্পফিচার ৩

জুনকো’র এভারেস্ট জয় : পুরুষতন্ত্রকে তোয়াক্কা না করে পর্বতে ওঠার গল্প

শায়লা বিথী ।। জুনকো তাবেই, জাপানিজ পর্বতারোহী। যিনি প্রথম নারী হিসেবে বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বত এভারেস্ট চূড়ায় উঠে ইতিহাস গড়েন। আজ তাঁর জন্মদিন। ১৯৩৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর জাপানের ফুকুশিমা থেকে ১৪০ মাইল দূরে পাহাড়ি শহর মিহারুতে জন্ম হয় তাঁর।

জুনকোর ঝুলিতে শুধু প্রথম এভারেস্ট চূড়া আরোহনকারী নারীর খেতাব রয়েছে তা নয়। প্রথম নারী হিসেবে সাত মহাদেশের সর্বোচ্চ চূড়াগুলোতে আরোহনের ইতিহাসও রয়েছে। এছাড়া তিনি ৭০টি দেশের সর্বোচ্চ পর্বতে অভিযান করেন।

তাঁর এসব সফলতা এখন খুব সহজে লিখছি, কিন্তু তখনকার বাস্তবতা ছিল ভীষণ কঠিন। জুনকো তাবেই’র বয়স যখন ১০ তখন তিনি প্রথম মাউন্ট নাসুতে ওঠেন স্কুল শিক্ষকের হাত ধরে। তখন থেকেই পাহাড়ের প্রতি প্রবল ভালোবাসা অনুভব করেন। হাই স্কুলের গন্ডি পেরুনোর আগেই আরও কিছু পর্বতে চড়ার সুযোগ পেয়ে যান। কিন্তু পর্বতারোহণ বরাবরই ব্যয়বহুল। জুনকোর দরিদ্র পরিবারের পক্ষে মেয়ের এমন ইচ্ছাপূরণ অসম্ভব ছিল। সে সময়ে জাপানের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীদের বাইরে বের হওয়া ছিল গুরুতর অপরাধের সামিল। তবে জুনকো তাঁর একাগ্রতা ও পর্বত প্রেমের কারণে এসব প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে যান।

১৯৫৮-১৯৬২ সাল পর্যন্ত জুনকো ইংরেজি এবং আমেরিকান সাহিত্যে পড়াশোনা করেছিলেন শোওয়া উইমেনস ইউনিভার্সিটিতে। তিনি ১৯৬২ সালে স্নাতক শেষ করে বেশ কয়েকটি ক্লাইম্বিং ক্লাবে যোগ দেন। উদ্দেশ্য ছিল পর্বতারোহী সহযাত্রী খুঁজে পাওয়া। তবে এই ক্লাবগুলোর সব সদস্যই ছিল পুরুষ। অল্প কিছু পুরুষ তাকে পর্বতারোহী হিসাবে স্বাগত জানালেও অধিকাংশ পুরুষ সদস্যই তাকে অসহযোগিতা করেন ও কটুকথা শোনাতে শুরু করেন। কিছু পুরুষ পর্বতারোহী সরাসরি তাঁর সঙ্গে পর্বতারোহণ করতে অস্বীকৃতি জানান। আবার কিছু পুরুষ বলেন, জুনকো একজন ধনী স্বামী খুঁজে পাওয়ার জন্য এসব ক্লাবে যুক্ত হতে চায়।

জুনকো এসব কথায় মনোযোগ না দিয়ে নিজের মতো করে জাপানের পাহাড়গুলোতে অভিযান শুরু করেন। একই সঙ্গে একটি বৈজ্ঞানিক জার্নালের সম্পাদক হিসাবে কাজ করে যেতে থাকলেন। তিনি বাড়তি উপার্জনের জন্য পিয়ানো এবং ইংরেজি শেখানো শুরু করেন। এসব অর্থ তিনি পর্বতারোহণে ব্যয় করতেন। তিনি ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে মাউন্ট ফুজিসহ জাপানের অন্যান্য পর্বত আরোহণ করে ফেলেন।

২৭ বছর বয়সে জুনকো বিয়ে করেন মাসানুবু তাবেই নামের একজন পর্বতারোহীকে। মাসানুবুর সঙ্গে জুনকোর পরিচয় হয় মাউন্ট টানিগাওয়া আরোহণের সময়। যদিও জুনকোর মা তার মেয়ের এই সিদ্ধান্ত স্বাগত জানান নি। কেননা মাসানুবুর পড়াশোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেড়োয় নি। তবে একজন পর্বতারোহী সঙ্গী খুঁজে পেয়ে জুনকো খুশি ছিলেন। কারণ পর্বতারোহী সঙ্গী জুনকোর পাহাড়প্রেম পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারবেন এবং সমর্থন করবেন।
জুনকো বিয়ের বছরখানেক পর সকল কাজ ছেড়ে দিয়ে শুধু পর্বত আরোহণের দিকে মনোনিবেশ করেন। পুরুষ পর্বতারোহণ ক্লাবগুলোর অসহযোগিতাপূর্ণ আচরনের জন্য ১৯৬৯ সালে জুনকো তাবেই নিজেই একটি পর্বতারোহণ ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন। জোশী-তোহান নামে সেই ক্লাবের স্লোগান ছিল ‘এসো আমরা নিজেরাই বিদেশে অভিযানে যাই’। তখনকার পুরুষতান্ত্রিক জাপানিজ সমাজ এই ক্লাবকে সাদরে গ্রহণ করেনি। বিভিন্ন মহল থেকে জোশি-তোহান ক্লাবটির সমালোচনা শুরু হয়। এমন পরিস্থিতিতে কোনো প্রতিষ্ঠানই এই ক্লাবের কোনো পর্বত অভিযানে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে রাজি হয়নি।

১৯৭০ সালে জোশি-তোহান ক্লাব নেপালের অন্নপূর্ণা-৩ (৭,৫৫৫মি) পর্বতে অভিযান করে। তারা এই পর্বতের দক্ষিণ দিক দিয়ে সম্পুর্ণ নতুন একটা রুটে এই অভিযান করেন। জাপানের নারী পর্বতারোহীদের এটাই ছিল প্রথম কোনো অভিযান। জুনকো ও ক্লাবের অপর এক নারী সদস্য হিরোকো হিরাকাওয়া অন্নপূর্ণা-৩ এর চূড়ায় আরোহণ করতে সক্ষম হন। এর মধ্যে দিয়ে নারীদের পর্বতারোহণের এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হয়। তবে সেই ইতিহাস ক্যামেরাবন্দি করা যায়নি। আবহাওয়া এতোই ঠান্ডা ছিল যে জুনকোদের ক্যামেরা কাজ করছিল না।

অন্নপূর্ণা-৩ এর সফলতার পর জসি-তোহান ক্লাব এভারেস্ট অভিযানের পরিকল্পনা করে। এইকো হিসানোর নেতৃত্বে ‘জাপানিজ উইমেন’স এভারেস্ট এক্সপিডিশন’ নামে একটা দল গঠিত হয়। এই দলের সদস্য ছিল ১৫ জন। ১৯৭১ সালে এভারেস্ট অভিযানের জন্য এই দলটি নেপাল সরকারের কাছে অনুমতির জন্য আবেদন করেন। নারী পর্বতারোহী দলটিকে পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বত অভিযানের অনুমতি পেতে চার বছর অপেক্ষা করতে হয়। অভিযাত্রী দলের সবাই নারী হওয়ায় অনুমতি পেতে এতো দীর্ঘ সময় লাগে। এই সময়ে জুনকো অভিযানের জন্য স্পন্সর খুঁজছিলেন। কোনো প্রতিষ্ঠান থেকেই তেমন সাড়া মিললো না। একদম শেষ মুহুর্তে সাড়া দিয়েছিল নিপ্পন টেলিভিশন ও ইয়োমিউরি শিমবান নামে একটি পত্রিকা। টাকা বাঁচাতে জুনকোরা ছোট ছোট ওয়াটারপ্রুফ ব্যাগ বানাতে রিসাইকেল গাড়ির সিট ব্যবহার করতেন। তাঁরা চায়না থেকে রাজহাঁসের পালক কিনে সেটা দিয়ে স্লিপিং ব্যাগ বানান।

অবশেষে ১৯৭৫ সালের মে মাসে ১৫ নারী সদস্য ও ছয় শেরপাসহ এভারেস্ট অভিযান শুরু হয়। হিলারি-তেনজিং যে পথে এভারেস্ট আরোহন করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন তারাও সেই পথেই অভিযানে যান। ৪ মে দলটি ৬৩০০ মিটার উচ্চতায় তুষারধ্বসের কবলে পড়েন। জুনকো ও তার দলের আরও চার সদস্য বরফের নিচে চাপা পড়েন। তবে তাঁরা শেরপাদের সহযোগিতায় বেঁচে যান। তখন সিদ্ধান্ত হয় শুধু দুইজন সদস্য দুইজন শেরপা নিয়ে উপরে যাবে। এরমধ্যে একজন শেরপা উচ্চতাজনিত কারণে অসুস্থ হয়ে পড়েন। ফলে অভিযাত্রীদের একজন উপরে যাবার সুযোগ অবশিষ্ট থাকে। অনেক আলাপ-আলোচনা করে জুনকোকে নির্বাচন করেন দলনেত্রী হুসানো। অবশেষে ১৬-ই মে জুনকো তাবেই ইতিহাস গড়েন। ৩৫ বছরের একজন নারী বাড়িতে যার দুই বছরের কন্যা সন্তান আছে তিনি পা রাখেন পৃথিবীর সর্বোচ্চ স্থানে।

এই অর্জনের পর জুনকো প্রশংসায় ভেসে যান। নেপালের রাজা এবং জাপানিজ সরকারের কাছ থেকে শুভেচ্ছা বার্তা পান। সর্বোপরি সারা পৃথিবীর মানুষ তখন উচ্ছ্বসিত হয়েছিল। তাদের ওই অভিযান নিয়ে একটা টিভি মিনি সিরিজও বানানো হয়। যদিও জুনকো এই জনপ্রিয়তা নিয়ে কিছুটা অস্বস্তি বোধ করতেন। তিনি বরাবরই একটু আড়ালপ্রিয় মানুষ। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “আমি চাই সবাই আমাকে মনে রাখুক এভারেস্ট চূড়ায় আরোহনকারী ৩৬তম ব্যক্তি হিসেবে, প্রথম নারী হিসেবে নয়।”
এভারেস্ট জয়ের পরেও তাবেই আরো অনেক অভিযানে গেছেন। ১৯৯০-৯১ সালে তিনি অ্যান্টার্কটিকার সর্বোচ্চ চূড়া মাউন্ট ভিনসনে ওঠেন। ১৯৯২-এর ২৮ জুন পুনাক জায়া জয় করে পৃথিবীর প্রথম নারী হিসেবে সাত চূড়া জয়ের স্বীকৃতি অর্জন করেন। জুনকোর ব্যক্তিগত ইচ্ছা ছিল সকল দেশের সর্বোচ্চ পর্বত অভিযান করা। তিনি ৭০টি দেশের সর্বোচ্চ পর্বতে আরোহণ করতে পেরেছিলেন। বাংলাদেশের কেওক্রাডং অভিযানে এসেছিলেন ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে।
জুনকো এভারেস্ট অভিযানের পর আর কোনো কর্পোরেট পৃষ্ঠপোকতা নেননি। তাঁর পরবর্তী অভিযানের খরচ যোগার করেছিলেন পেইড পাবলিক অ্যাওয়ারনেস, পর্বতারোহণের গাইড হিসেবে অভিযান পরিচালনা করে, স্থানীয় বাচ্চাদের মিউজিক ও ইংরেজি শিখিয়ে। এছাড়া জুনকোর আত্মীয় স্বজন ও বন্ধুরা মাঝেমধ্যে খাবার ও পর্বতারোহণের সরঞ্জাম দিয়ে সহযোগিতা করতেন।

২০০০ সালে কিওশু ইউনিভার্সিটি থেকে ‘ক্লাইম্বিং গ্রুপগুলির ফেলে যাওয়া আবর্জনার কারণে এভারেস্টের পরিবেশের যে ক্ষতি হচ্ছে’ এই বিষয়ের উপর পোস্ট গ্রাজুয়েট শেষ করেন। এছাড়া তিনি হিমালায়া অ্যাডভেঞ্চার ট্রাস্ট অব জাপানেরও পরিচালক ছিলেন। এই প্রতিষ্ঠানটি আন্তজার্তিকভাবে পাহাড়-পর্বতের পরিবেশ ঠিক রাখতে কাজ করে।
২০১২ সালে জুনকোর ক্যান্সার ধরা পড়ে। তবু হাল না ছেড়ে তিনি তার পর্বতারোহণের কাজকর্ম চালিয়ে যান। ২০১৬ সালের ২০ অক্টোবর কাওয়াগো’র একটা হাসপাতালে মারা যান তিনি।

জুনকো তাবেই ইতিহাসে এক শক্তিশালী নারীর নাম। দারিদ্র ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। তবুও স্বপ্নপূরণে পিছনে হাঁটেননি কখনো। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চোখে আঙুল দিয়ে তিনি দেখিয়ে দিয়েছিলেন নিজের শক্তি ও ক্ষমতাকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *