বিয়ের প্রতিশ্রুতিতে যৌনমিলন: ধর্ষণ না প্রতারণা নাকি মিথ্যে অভিযোগ?
মেহেরুন নূর রহমান।। সংজ্ঞা অনুযায়ী ধর্ষণ হলো এক ধরণের যৌন নিপীড়ন যা সাধারণত কোন ব্যক্তির সম্মতি ব্যতীত তার সাথে যৌনমিলন বা অন্যরকম যৌন অনুপ্রবেশের সাথে জড়িত। মনে রাখা জরুরি “সম্মতির অভাব” ধর্ষণের মূল কারণ এবং এখানে সম্মতি বলতে বলা হচ্ছে যৌন ক্রিয়াকলাপের জন্য নির্দ্বিধায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রদত্ত অনুমোদন।
কিন্তু আমরা সকলেই জানি অনেক ক্ষেত্রে ভিক্টিম সম্মতি দেবার পরও সেটাকে আমরা ধর্ষণ বলতে পারি। নানাভাবে একজন ধর্ষক, ভিকটিমের কাছ থেকে সম্মতি আদায় করে তাকে যৌনমিলনে বাধ্য করতে পারে যেমন জোর করে, ভয় দেখিয়ে, ব্ল্যাকমেইল করে ইত্যদি। এছাড়া স্বতঃস্ফূর্ত সম্মতি দানে অক্ষম অবস্থায় (ঘুমন্ত, মাতাল) বা মানসিকভাবে অপরিপক্ক কারো সাথে (বুদ্ধি প্রতিবন্ধি) বা নাবালক কারো সাথে যৌনমিলনও ধর্ষণের আওতায় পরে।
আর একটি কারণে ভিক্টিম শারীরিক মিলনে সম্মতি দেবার পরও নিজেকে ধর্ষিত ভাবতে পারে সেটি হলো- মানসিক আপোসের কারণে সে যদি যৌনমিলনে সম্মতি জ্ঞাপন করে। কেউ যদি তার ক্ষমতা অপব্যবহার করে বা ভিক্টিমের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে বা ফাঁদে ফেলে মানসিক আপোষে বাধ্য করে সম্মতি আদায় করে এবং যৌনসম্পর্ক স্থাপন করে তবে পরবর্তীতে ভিক্টিম সেটাকে ধর্ষণ বলে ক্লেইম করতে পারে।
এখন বিবাহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রাপ্তবয়স্ক কাউকে যৌনমিলনে রাজি করানোকে আমরা মানসিক আপোষের ভেতরে ফেলে ধর্ষণ বলবো কিনা সেটা হলো প্রশ্ন।
আমাদের উপমহাদেশসহ আরো কিছু দেশে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে যৌনমিলনকে ধর্ষণের সংজ্ঞায় যুক্ত করেছে কারণ এসব দেশগুলো যৌনতা ও যৌনতা সম্পর্কীয় বিষয়গুলির ব্যাপারে এখনও অনেকাংশেই রক্ষণশীল। ভার্জিনিটি বা কুমারীত্ব একটি মেয়ের জন্য মূল্যবান এবং কোনো মেয়ের বিবাহপূর্ব যৌন সম্পর্কের কথা জানাজানি হলে পরবর্তীতে তার বিয়ে করা কঠিন হয়ে যায়। এছাড়া মেয়েটি পরিবারে এবং পরিবারের বাইরে নানা অপমান এবং সহিংসতার শিকার হতে পারে। ভুলে গেলে চলবে না আমাদের জনসখ্যার একটি বড় অংশ অশিক্ষা, দারিদ্র এবং ধর্মীয় সংস্কারে আবদ্ধ।
পার্শ্ববতী দেশ ভারতে নারী কর্তৃক এই ধরণের অসংখ্য মামলা রয়েছে। সে সব মামলায় একটি প্রশ্ন বার বার উঠে এসেছে যে, যদি বিবাহের প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘিত হয় তবে সম্মতিক্রমে পূর্ববর্তী যৌনমিলন ধর্ষণ না প্রতারণা?
কেউ কেউ মনে করেন এই ধরনের ঘটনাগুলোকে পুরুষের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে নারীর প্রতি প্রতারণা বলা উচিত। কার্যত এই কর্মকাণ্ডে নারী পুরুষ দুজনেরই পূর্ন সম্মতি ছিল সুতরাং ধর্ষণের সংজ্ঞা অনুযায়ী এটি ধর্ষণের আওতায় পরে না। মিথ্যা প্রতিশ্রুতি বা প্রলোভন দেখিয়ে কারো সাথে যৌনসম্পর্ক করা এবং পরবর্তীতে সেটা ভঙ্গ করা অপরাধ যার জন্য সেই ব্যক্তি প্রতারণার মামলায় শাস্তি পেতে পারে ধর্ষণের মামলায় নয়। এছাড়া এটাকে ধর্ষণ বললে ধর্ষণ আইনের অপব্যবহারের সুযোগ রয়ে যায়। প্রতিরোধস্পৃহা থেকে কোন নারী সম্পর্ক ভেঙে যাবার পর স্বতঃস্ফূর্ত সম্মতিক্রমে স্বপ্রনোদিত যৌনমিলনকে ধর্ষণ বলে পুরুষটিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করতে পারে।
কারো কারো কাছে এ জাতীয় মামলা ধর্ষণের আওতায়ই আসে, প্রতারণার নয়। কারণ এখানে ভিক্টিমের শরীর যুক্ত, টাকা পয়সা বা সম্পত্তি নয়, এবং এখানে চালাকি করে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করা হচ্ছে। অর্থনৈতিক বা অন্যান্য প্রতারণার চাইতে শারীরিকভাবে প্রতারিত হবার ইম্প্যাক্ট ভিন্ন। এসব ক্ষেত্রে ভিকটিম পূর্বকার যৌনমিলনের কথা চিন্তা করে ধর্ষিত হবার অনুভবে আক্রান্ত হয়। এছাড়া এখানে কোনো শারীরিক বলপ্রয়োগ না হলেও এবং আপাত নারীটির কাছ থেকে সম্মতির ব্যাপার থাকলেও আমাদের প্যাসিভ সাবমিশন এবং ভুল ধারণার ভিত্তিতে যৌনমিলনে সম্মতি এই ব্যাপারগুলো বুঝতে হবে।
একজন পুরুষ যখন বিয়ের প্রতিশ্রুতি দেয়, তখন সে এই প্রতিশ্রুতির মূল্য নারীটির কাছে কতটুকু তা বুঝেশুনেই দেয় এবং সে স্পষ্টতই জানে এই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা হলে নারীটির উপর কি প্রভাব পড়বে। এক্ষেত্রে গুরুতর সামাজিক কলঙ্ক, সহিংসতা, অর্থনৈতিক অসুবিধা- এগুলোকে বিবেচনায় আনতে হবে। অনেক সময় নারীটি গর্ভবতীও হয়ে যেতে পরে।
সুতরাং একটা বিষয় সহজেই অনুমেয় “বিয়ের পরিশ্রুতি দিয়ে প্রাপ্ত বয়স্ক কারো সম্মতি আদায়” একটা গ্রে এরিয়া। এটা প্রমাণ করা সত্যি কঠিন যে প্রাপ্তবয়স্ক দুজনের মাঝে সম্মতিক্রমে যৌনমিলনে এক পক্ষ আপোষের কারণে রাজি হয়েছে কি না। একমাত্র যে এটা অনুভব করে সেই বলতে পারবে। আবার এক্ষেত্রে নারী কর্তৃক মিথ্যা বলার অনেক সুযোগ রয়েছে এবং এটাও আলোচনার বিষয় যে এটিকে ধর্ষণ বলা হবে না কি প্রতারণা।
আমি মনে করি একমাত্র ঘটনা এবং পরিস্থিতি পর্যালোচনা/বিবেচনার মাধ্যমেই এসব ক্ষেত্রে কোন সিদ্ধান্তে আসা যেতে পারে। ভারতীয় আদালত অনেক বছর ধরে ঘটনার এবং পরিস্থিতির ভিন্নতার কারণে ভিন্ন ভিন্ন ঘটনায় ভিন্ন ভিন্ন রায় দিয়েছে যদিও সবগুলোই বিবাহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ধর্ষণের মামলা ছিলো। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৩ সালের নভেম্বরে মুজফফরনগরের এক ব্যক্তিকে সুপ্রীম কোর্ট এক নারীর সাথে দু’বছর যৌন সম্পর্কের জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিল কারণ এ ক্ষেত্রে এটি প্রমাণিত হয়েছিল স্পষ্টভাবে যে নারীটিকে ভোগ করার উদ্দেশ্যেই লোকটি তাকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়েছিল, যা নারীটি বিশ্বাস করেছিল এবং পরবর্তীতে গর্ভবতী হয়ে পড়েছিল। আবার অনেক ক্ষেত্রে আদালত পুরুষটিকে ধর্ষণের অভিযোগ থেকে খালাস দিয়ে তাকে প্রতারণার মামলায় নথিবদ্ধ করেছে।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই ধরনের ঘটনাকে অতি সহজেই ধর্ষণের ক্যাটাগরিতে ফেলে দেয়া যায়, যেসব ক্ষেত্রে নারী এবং পুরুষটির সামাজিক, শিক্ষা এবং অর্থনৈতিক অবস্থান ভিন্ন মেরুতে। এসব ক্ষেত্রে পরুষ কর্তৃক নারীটিকে দেয়া বিয়ের প্রতিশ্রুতি যে কেবলি একটি বাহানা নারীটিকে শারীরিকভাবে শোষণ করার তা সহজেই অনুমেয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় বিয়ের কথা বলে গৃহকর্মীর সাথে বা দুস্থ/অর্থনৈতিকভাবে দরিদ্র কারো সাথে বা অধস্তন কর্মচারীর সাথে বা সাবালক কিন্তু অল্পবয়স্ক অনভিজ্ঞ কারো সাথে যৌনমিলন করা। ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করেও অনেক পুরুষ তার প্রেমিকার প্যাসিভ সম্মতি আদায় করে শারীরিক মিলনের জন্য বাধ্য করে যা ধর্ষণ হিসেবে ক্যাটাগোরাইজড হতে পারে যদি নারীটি এই ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলের ব্যাপারটি প্রমান করতে পারে (চ্যাট, ইমেইল, রেকর্ডেড কনভার্সেশন)।
আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় বেশিরভাগ মেয়েই এই ধারণা নিয়ে বড় হয় যে তারা কেবল বিয়ের মধ্যেই যৌনমিলন করতে পারে এবং অনেক ক্ষেত্রে প্রেমিকের সাথেও বিয়ের ব্যাপারটি নিশ্চিত না হলে তারা শারীরিক মিলনে সম্মতি দেয় না। এছাড়া আমাদের সমাজে নারী এবং পুরুষের অবস্থান ভিন্ন। বিয়ের আগে বা বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে যৌন সম্পর্কের প্রভাবও সর্বদা নারী-পুরুষ ভেদে আলাদা এবং প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের পরবর্তী প্রতিক্রিয়াও নারী-পুরুষ ভেদে ভিন্ন। সুতরাং কোন প্রেমের সম্পর্ক যেখানে শারীরিক মিলনের উপস্থিতি ছিলো তা ভেঙে গেলে অনেক মেয়েই ভাবে পুরুষটি তাকে ঠকিয়েছে এবং প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে সে ধর্ষণের মামলা দিয়ে পুরুষটিকে আটকাতে চায়, শাস্তি দিতে চায়।
এক্ষেত্রে ভারতীয় একটি মামলার ফলাফল উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি। ২০১২ সালের এপ্রিলে দক্ষিণ কর্ণাটকের একটি আদালত একজন পুরুষকে জামিনে মুক্তি দিয়েছিল এই বলে যে বিবাহ-পূর্ব যৌনমিলনের জন্য শিক্ষিত ইন্ডিপেন্ডেন্ট নারীরা সম্পর্ক শেষ হওয়ার পরে তাকে ধর্ষণ দাবি করতে পারে না, কারণ একজন শিক্ষিত এনং স্বনির্ভর নারী নিজের নেয়া সিদ্ধান্তের দায়ভার অন্যের উপর চাপাতে পারেনা। ওই কেসে নারী এবং পুরুষ দুজনেই শিক্ষিত এবং চাকুরীজীবী ছিলো। দুজনের মধ্যে স্বাভাবিক প্রেমের সম্পর্ক ছিল। পুরুষটি সেই সম্পর্কটি ভেঙে দিলে রাগান্বিত নারীটি পূর্ব প্রেমিকের বিরুদ্ধে বিয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ধর্ষনের অভিযোগে মামলা করেছিল।
আমাদের দেশেও বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে নানাভাবে নারীদের শারীরিকভাবে শোষণ করা হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে সেগুলোকে ধর্ষণ বলা যাবে তা আমি উপরে বর্ণনা করেছি। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে প্রেমের সম্পর্ক ভেঙে গেলেও মেয়েরা বিয়ে প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ করে মামলা করে।
মেয়েদের বলছি, আপনি প্রেম করেছেন, দুজনে একসাথে সংসার করার স্বপ্ন হয়তো দেখেছেন, ভালোবেসে সম্মতিক্রমে শারীরিকভাবে মিলিত হয়েছেন, তারপর কোনো কারণে সম্পর্কে ভেঙে গেলে আপনি আপনার পূর্ব প্রেমিকের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা করতে পারেন না এই বলে যে সে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আপনাকে ব্যবহার করেছে। এটা অন্যায়। কোন মেয়ে এরকম ইন্টিমেট সম্পর্ক ভেঙে দিলে কোন পুরুষকে তো দেখিনা তার প্রেমিকার বিরুদ্ধে মামলা করতে যে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে মেয়েটি তাকে ধর্ষণ করেছে? এছাড়া এ ধনের মামলায় পুরুষটি যদি প্রমাণ করতে পারে যে তার নারীটিকে বিয়ের ইচ্ছা ছিল কিন্তু পরবর্তীতে নানা কারণে তার মন পরিবর্তন হয়েছে তবে এটিকে আর ধর্ষণ বলা যাবে না। একমাত্র শুরু থেকে পুরুষটির সন্দেহজন উদ্দেশ্য ছিল এটা প্রমান করতে পারলে ধর্ষণের মামলা করা যেতে পারে।
প্রেম, শারীরিক সম্পর্ক এবং পরবর্তীতে সম্পর্কচ্ছেদ কোন অস্বাভাবিক বিষয় না। সম্পর্কচ্ছেদ নারী বা পুরুষ যে কেউ করতে প্রায়। বিচ্ছেদ হলে এক পক্ষ বেশি কষ্ট পায় এটাই স্বভাবিক। কিন্তু তাই বলে সেই কষ্ট থেকে মুক্তি পাবার জন্য আপনি ভিন্ডিক্টিভ আচরণ করবেন এটা ঠিক নয়। তবে হ্যা, আপনার সম্পর্ক চলাকালীন যদি কোনো টাকাপয়সার লেনদেন হয় বা অন্য কোনোভাবে আপনি আপনার পূর্ব প্রেমিকের দ্বারা প্রতারিত হন (যেমন জাল পরিচয়, বৈবাহিক অবস্থা লুকানো ইত্যাদি) তবে সে জন্য তার বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা অবশ্যই করতে পারেন।
আত্মবিশ্বাসী হন, শিক্ষিত হোন, নিজের আত্মসম্মান বাড়ান। সচেতন হন। শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের আগে বুঝে নিন কোনো কারণে আপনাদের সম্পর্ক ভেঙে গেলে আপনি নিজেকে সামলাতে পারবেন কিনা। মনে রাখবেন কোনো কিছুরই সম্পূর্ণ গ্যারান্টি কেউ আপনাকে দিতে পারবেনা। বিয়েই ভেঙে যায় আর এটা তো প্রেম। নিজের সিদ্ধান্তের দায়ভার নিতে শিখুন।
সবশেষে বলি, কোনো নারী যদি কোনো পুরুষের বিরুদ্ধে বিয়ের প্রতিশ্রুতি বা প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ করেছে বলে মামলা করে তবে শুরুতেই এটিকে মিথ্যা মামলা বা প্রতারণার মামলা বলে খারিজ করতে পারেন না, আবার ধর্ষণের মামলা বলেও ১০০% নিশ্চিত হতে পারেন না। ঘটনা, পরিস্থিতি, পাত্র-পাত্রীর সামাজিক অর্থনৈতিক অবস্থান, পারিপার্শ্বিকতা এ রকম অনেক কিছু বিবেচনা করে বিচারব্যবস্থা সিদ্ধান্ত নিবে কোনটি মিথ্যা মামলা, কোনটি প্রতারণা এবং কোনটি সত্যিকারের ধর্ষণ।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]