ধর্ষণ সংস্কৃতির শেষ কোথায়?
আফরোজ ন্যান্সি।। গতকাল জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় এক জরিপ দেখলাম গত নয় মাসে ধর্ষণের মামলা হয়েছে ৯৭৫টি। অর্থাৎ প্রতি মাসে গড়ে একশো’র বেশি ধর্ষণ মামলা নথিভুক্ত হচ্ছে। আর যেসব ধর্ষণ থানা অব্দি পৌঁছুতেই পারছেনা তার হিসাব আমরা কেউ জানি না। বেগমগঞ্জের ঘটনাটিও ঠিক তেমনই ধামাচাপা পরে যাওয়া একটি ঘটনা। ৩২ দিন ধরে ওই নারী বা তার পরিবারের কেউ আইনের সাহায্য নিতেও অপারগ ছিলেন। ভাবলেই গা ছমছম করে ওঠে। ভাগ্যগুনে ওই জঘন্য ভিডিওটি পুলিশের চোখে পরেছিলো বলেই আজ এতো আলোড়ন উঠছে। আসামীরা ধরা পরছে। কিন্তু এসব ঘটনার শেষ কোথায়? আজ বেগমগঞ্জ তো আরেকদিন সিলেট আবার আরেকদিন খাগড়াছড়ি!
এক একটা ধর্ষণের ঘটনা সামনে আসার পরে সোশ্যল মিডিয়া উত্তাল হয়, আমরা বিচার চাই, দু’একদিন মানববন্ধন করি, কোনো কোনো ঘটনায় আসামী ধরা পরে, আবার কোনোটায় ধরা ছোয়ার বাইরেই থেকে যায় আসামী। যারা ধরা পরে তারাও কিছুদিন পর জামিনে বের হয়ে সগর্বে ঘুরে বেড়ায়। হয়তো নতুন কোনো শিকার খোঁজে মনে মনে, সুযোগ পেলেই দাঁত বসাবে বলে। এই দেশে ধর্ষণের আফটার ইফেক্ট পোহাতে হয় ধর্ষিতাকেই, ধর্ষককে নয়। ধর্ষণই একমাত্র অপরাধ যেখানে অপরাধী নয় বরং ভিক্টিমকেই সামাজিকভাবে কোনঠাসা হয়ে থাকতে হয়। তাই বোধহয় ধর্ষন করা সব থেকে সহজতম অপরাধ, যা যখন-তখন যেখানে-সেখানে সংঘটিত করা যায়। ধরা পরলেও শাস্তির হার তুলনামূলক সামান্যই। আজ যখন দেশে ধর্ষণের মহড়া চলছে তখনো আমরা পরে আছি ধর্ষণের জন্য নারীর পোশাক দায়ী কি দায়ী না, হিন্দী মিডিয়া দায়ী কি দায়ী না, ধর্ষণের শাস্তি ফাঁসি হওয়া উচিৎ কি উচিৎ না ইত্যাদি নানাবিধ বাহাসে। কীভাবে ধর্ষণ সম্পূর্নভাবে নির্মূল করা যায় সেই নিয়ে রাষ্ট্র এবং প্রশাসনের কোনো পরিকল্পনা কিংবা উদ্যোগ নেই। ধর্ষণ ঘটার পরে ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা, তাকে সামাজিকভাবে বয়কট করা, ধর্ষিতার সামাজিক অবস্থান নিরাপদ রাখা এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলিতে কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছেনা।
আমরা জানি একসময় এদেশে এসিড নিক্ষেপের মতো ভয়াবহ ঘটনা অহরহ ঘটতো। কোনো ছেলের দেওয়া প্রেমের প্রস্তাবে রাজী না হলে এসিড নিক্ষেপের শিকার হতে হতো মেয়েটিকে। এসিড নিক্ষেপের শিকার হয়ে বহু সম্ভাবনাময় প্রাণ নিঃশেষ হয়ে গেছে এককালে। প্রশাসনের কড়া নজরদারি এবং আইনের সুষ্ঠ প্রয়োগের মাধ্যমে এসিড নিক্ষেপের মতো নিকৃষ্ট এই অপরাধ পুরোপুরিভাবে নির্মুল করা সম্ভব হয়েছে। তাহলে কেন আর কারা আজ অব্দি এই ধর্ষণকে টিকিয়ে রাখছে? কেন প্রশাসন আজো ততোটা কঠোর অবস্থানে যেতে পারলো না যাতে ধর্ষণ পুরোপুরিভাবে নির্মূল করা সম্ভব হয়! কেন অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার পরেও ধর্ষককে জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়! এই ধর্ষণ সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখার পেছনে কাদের স্বার্থ কাজ করছে?
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, পুরুষশাষিত সমাজই নারীদের চলার পথকে কন্টকিত করে রাখার উদ্দেশ্যে যৌন হয়রানি, ধর্ষণ ইত্যাদি জুজুর ভয় জিইয়ে রাখছে। নারীরা যেন নির্ভয়ে স্বাধীনতা উপভোগ করতে না পারে, যেন মাথা উঁচু করে বাঁচার কথা না ভাবতে পারে, যেন পুরুষের কাজে প্রতিদ্বন্ধী হতে না আসে, যেন সারাক্ষন তাদের মাথায় ধর্ষিতা হবার ভয় নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হয় তাই এই জুজুকে টিকিয়ে রেখেছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। নারী তাদের সাথে কাঁধে কাধ মিলিয়ে চলতে আসলেই তাকে বলা হয় মেয়ে মানুষের অতো বাড় ভালো না। পুরুষের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বীতায় নামলেই নারীকে দেখিয়ে দেওয়া হবে, বুঝিয়ে দেওয়া হবে। শিক্ষায় কর্মক্ষেত্রে নারী আজ যখন সার্বিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে তখন তার পথ আটকে দাঁড়ানোর একমাত্র অস্ত্র হচ্ছে ধর্ষণ এবং যৌন হয়রানি। তাই দেশ সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রীকে ধর্ষণ করতে পারে নেশাখোর বখাটে ফেরিওয়ালা। ফেরিওয়ালা তখন আর সমাজের প্রান্তিক মানুষ থাকছে না বরং ‘নারীকে দেখিয়ে দিতে হবে’ মানসিকতা লালনকারী একজন পুরুষ। এই যে নারীকে দেখিয়ে দেওয়ার মানসিকতা, নারীর স্বাধীন সত্তাকে চূর্ণ করে দেওয়ার, গুড়িয়ে দেওয়ার মানসিকতা, এই মানসিকতা থেকেই বেগমগঞ্জের ঘটনার মতো ঘটনাগুলির সূত্রপাত ঘটছে। এ ঘটনায় আমি অবাক হইনি মোটেও। আজ যা বেগমগঞ্জে ঘটছে তার গোড়াপত্তনের লক্ষণ তো চারপাশে রোজই দেখছি। অসংখ্য পোটেনশিয়াল রেপিস্টদের মধ্যে নারীকে নিজের চলার রাস্তা তৈরি করে নিতে হচ্ছে রোজ, গা বাঁচিয়ে চলতে হচ্ছে রোজ।
শেষ করার আগে একটা অভিজ্ঞতা শেয়ার করি, সকালে অফিসের জন্য বেড়িয়েছি। বাসা থেকে মেইন রোড অব্দি রাস্তাটুকু হেঁটেই যাই। এক রিকশাওয়ালা পিছন পিছন আসতেছে আর বারবার বলতেছে “আপা কই যাবেন, আপা নামায়ে দেই যেখানে যাবেন।” আমি উত্তর না দেওয়াতে গালাগালি শুরু করলো সে। আমি ঘুরে দাঁড়ালাম। চিল্লাচিল্লি করলাম। রিকশাওয়ালা তখনো গালি দিয়ে যাচ্ছে। মিনিটখানেক পর এক মুরুব্বি মতো লোক এসে উল্টো আমাকেই বললো, থাক বাদ দ্যান। যান আপা যান। আর সেই রিকশাওয়ালা তার সামনেই আমাকে উদ্দ্যেশ্য করে বললো “এক্কেবারে তুইলা নিয়া গিয়া চুইদা দিলে বুঝবে মজা” বলে রিকশা টেনে চলে গেলো। সেই মুরুব্বীকে আমার আর কিছু বলার রুচি হলো না। এইসব লোকেদের দৃষ্টির সামনে থেকেই তো প্রতিদিন অফিস যাচ্ছি, বাসায় ফিরছি। কারো মন চাইলো গালি দিয়ে গেল, কারো মন চাইলো তুলে নিয়ে রেইপ করলো, কারো মন চাইলো দলবেঁধে কাপড় খুলে নিয়ে পেটালো আর ভিডিও করে ভাইরাল করে দিলো তাতে সমাজের কী আসে যায়। দিনশেষে লড়াইটা তো একা নারীকেই লড়তে হচ্ছে। ধর্ষিতা হবার পরে প্রশ্নের তীর তো নারীর দিকেই উঠছে। সামাজিকভাবে বয়কট তো হচ্ছে ধর্ষিতাই! মুখ লুকিয়ে ঘরের কোনায় পরে থাকতে হচ্ছে তাকে। আর ধর্ষক ঘুরে বেড়াচ্ছে বীরদর্পে বুক ফুলিয়ে। এই কালচার যতদিন না পাল্টাচ্ছে ততদিন ধর্ষণ হতেই থাকবে। যতদিন অব্দি ধর্ষক জানবে ধর্ষণ করলে বিচার হয়না, ধরা পরলেও নামমাত্র শাস্তি, সামাজিকভাবে তাকে হেয় হতে হয়না, পারিবারিকভাবে অপমানিত হতে হয়না ততদিন অব্দি ধর্ষণ চলতেই থাকবে। আর এভাবে চলতে থাকলে একদিন হয়তো এমন দিন আসবে যেদিন প্রতি ঘরে এক বা একাধিক ধর্ষিতা নারী খুঁজে পাওয়া যাবে।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]