May 16, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

হাতছাড়া করলেই মেয়েমানুষ বিগড়ায়ে যায়!

সুমাইয়া আলম ।। বিশ্বকাপ এর সময় ফ্রেন্ড সার্কেলের সবাই সবাইকে জিজ্ঞেস করে কে কোন দল সাপোর্ট করে। সবাই-ই কোনো না কোনো দল হয়তো সাপোর্ট করে ঠিকই কিন্তু যখন একটা মেয়েকে তার প্রিয় দলের খেলোয়াড়ের নাম জিজ্ঞেস করা হয়, অধিকাংশ সময়ই দেখা যায় সে নাম জানে না। এটা নিয়ে আবার ছেলে বন্ধুরা হাসাহাসি করে এটা বলে “অ্যাহ! নাম জানেনা আবার দল সাপোর্ট করে”।

এটা কিন্তু আসলেই সত্যি। বাংলাদেশের খুব কম মেয়ে খেলা দেখে এবং বোঝে। তাইতো খেলা না বুঝলেও সবার সাথে তাল মিলিয়ে ঠিকই বলে ফেলে “ওমুক দল সাপোর্ট করি”। কিন্তু সে খেলার নিয়ম কানুন বা খেলা সম্পর্কে আদৌ কোনো ধারণা রাখেনা। দলের নাম তার মুখস্ত থাকে কারণ সে ছোট থেকেই দেখে আসছে ভাইয়ের গায়ে ওমুক খেলোয়াড়ের টি-শার্ট। বাপ-কাকা ওমুক দল সাপোর্ট করে। কাজিনরা গাছের ওপর নীল-হলুদ পতাকা টাঙিয়ে মারামারি করে। এবং সেখান থেকেই মূলত সে নাম মুখস্ত করে। কারণ তার না আছে এসব খেলা খেলবার অনুমতি, না আছে বাপ ভাইয়ের টি-শার্ট পরার সুযোগ। অবশ্য কেউ কেউ মাতব্বরি করে তার মেয়ে অথবা বোনকে দলে ভিড়তে দেয়, তখন তার নাম হয় “মেয়েলি স্বভাবের ছেলে মানুষ” অথবা দুনিয়া ধ্বংসকারী। অথবা নিজের মেয়ে/বোনকে নিজেই ধ্বংস করছে এমন কুলাঙ্গার।

একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে পরিবারে ছেলে সন্তান থাকলে তাকে আগেই ব্যাট-বল বা হাতে ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কারণ নাকি ছেলেরা পুতুল খেলায় ছোট বেলা থেকেই আগ্রহ পায়না, ওটা মেয়েদের খেলা। মেয়েরা রান্নাবান্নার প্রক্রিয়া নাকি ছোট থেকেই উপভোগ করে। আচ্ছা, একটা বাচ্চাকে যদি আমরা প্রশ্ন করি তুমি ছেলে, এটা কী দেখে বুঝলে? বা মেয়ে কী দেখে বুঝলে? সে দেখবেন কনফিউজড হয়ে যায়। তো যে বাচ্চাটা এটুকু বুঝতে পারেনা ছেলে-মেয়ের পার্থক্য কোথায় সে কীভাবে ছোট থেকে বুঝতে পারে এটা ছেলেদের খেলা আর এটা মেয়েদের খেলা?

এই সহজ ব্যাপারটা একবারও আমরা হয়তো ভেবে দেখতে চাইনি! আমরা আসলে একটা মানব শিশু জন্মের পর থেকে তার মাথার মধ্যে লিঙ্গ বৈষম্যের যত রকম প্রকারভেদ আছে আস্তে আস্তে সেগুলো ভর্তি করে রাখি। ভাইয়ের ব্যাট-বল এ যদি বোনটা হাত দেয় আমরা তাকে বলি – পুতুল খেলো। বোনটা যদি সাইকেল চালানো শিখতে চায় আমরা তাকে বলি – ছিঃ ছিঃ, তুমি মেয়েমানুষ, পুরুষ মানুষের জিনিসে তোমার এত আগ্রহ কিসের? এরপরে যদি মেয়েটা কোথাও একা যায়, তাহলে তাকে বলি – ভাই আছেনা তোমার? সেই তোমাকে পৌঁছে দেবে। অথবা বলি – বাবা থাকতে কেউ তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। বা – ভাই তো তোমার বাবার মতো। একটা আঁচড়ও তোমার গায়ে লাগবে না।

ভাই বা বাবা বোনের যত্ন নেবে এইটা আপত্তি না। আপত্তি হচ্ছে সেই ছোট্ট বাচ্চাকে চাইলে আমরা সুন্দরভাবে বেড়ে উঠতে দিতে পারতাম, সেই তাকে আমরা ছেলে-মেয়ের দলে আগে ভাগ করে দেই। এবং তাকে মেরুদণ্ড সোজা করেই দাঁড়াতে দেই না। কখনো বিপদে পড়লে নিজেকে নিজের রক্ষা করতে হবে- এতটুকু বুঝও বুঝতে দেইনা। তাই তো প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া সত্বেও একটা মেয়েকে বলি – একা চলবা কিভাবে? ভাইয়ের সাথে যাও বা বাবার সাথে যাও। রাস্তায় একা মেয়েমানুষ কত বিপদ আপদ ঘটবে। কিন্তু ওই একই বয়সী একটা ছেলেকে কিন্তু আটকে রাখি না। বরং বাবা-মা বেশ বুক ফুলিয়ে গর্বের সাথে বলে “ভাবী, ছেলে একা গেছে তো কী হইছে, ছেলের বুদ্ধি আক্কেল অনেক বেশি। আল্লাহ দিলে ওর কিছুই হইবো না”। এই যে সৃষ্টিকর্তার নাম নিয়ে একটা ছেলেকে নিজের ব্যালান্স রাখতে শেখানো হয় সেখানে একটা মেয়েকে আটকে রাখা হয়।

যাই হোক, এই যে ছোটবেলা থেকেই সেই জন্মের পর থেকেই যে ছেলে বাচ্চা মেয়ে বাচ্চা বলে লাফালাফি করি এটা তখন থেকেই শিশুদের মনে আস্তে আস্তে প্রভাব ফেলে। একটা মানুষের যেহেতু মস্তিষ্কের গঠন, ভাবনা শক্তি, চিন্তার ধরণ সে জন্মের পর থেকেই শুরু হতে থাকে, তাই তো ছেলে মেয়ে প্রকারভেদটাও সেই বাচ্চা বয়স থেকেই জেনে যায়। এজন্য রান্নাবাটি খেলাতেও বাজার করার দায়িত্ব পড়ে ছেলেদের উপর আর বউ সেজে ভাত বাড়ার দায়িত্ব পড়ে মেয়েদের উপর। হয়তো অনেকেই বড় হয়ে বুঝতে শেখে বৈষম্য। আওয়াজ তোলে, কথা বলে বা সমান অধিকার পেতে চায়। এখানেও শত বিপত্তি। সমাজের চিত্রও ভিন্ন নয়। যদি কোনো মেয়ে তার প্রাপ্যটুকু বুঝে নিতে চায়, গলার শব্দটা একটু বাড়িয়ে বলে – এটা ভুল, তাহলে ছেলেদের বাদ দিলে দেখা যাবে মেয়েরাই তাকে বলছে, আরেহ! মাগী একটা। এই খানকি নটি কেমন মদ্দা মাইনষের উপরে কথা বলে দেখছিস? মেয়ে যদি বাপ ভাই দাদা স্বামী বা যে কোনো পুরুষ মানুষের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে চায়, সর্বপ্রথম বাধ সাধে তার পরিবারেরই মা বোন দাদী। একটা মেয়ে একটা মেয়ের বিরুদ্ধে, আসলেই কি তাই? নাহ। সে শুধুমাত্র মেয়ে রূপে বড় হয়েছে। সে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রিত তার পরিবার, সমাজ এবং আশেপাশের তথাকথিত বৈষম্যমূলক চিন্তাভাবনা দ্বারা। ওই ছোটবেলা থেকেই একটা শিশুকে ধাপে ধাপে বড় করার প্রত্যেকটা পর্যায়ে তাকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে – তোমাকে চোখ নামিয়ে কথা বলতে হবে। সেই মানব শিশু একদিন বড় হয়েছে মাত্র, অথচ তাকে সম্পূর্ণ ট্রেনিং করানো হয়েছে দাসত্ব মানতে। তার নিজস্বতা বাদ দিয়ে অন্যের কথা অনুযায়ী চলতে। এবং সে বড় হওয়ার পরে একরকম মুখস্ত চিন্তা ভাবনার অধিকারী এর বাইরের কোনো কিছুই নয়।

কয়েকটা কথা প্রচলিত আছে – মেয়ে মানুষের বেশি বুঝতে নেই তাতে ঝামেলা বাড়ে। আরও একটা কথা হচ্ছে – মেয়েমানুষকে হাতছাড়া করতে নেই, তাতে বিগড়ে যায়, হোক সে পড়াশুনার জন্য বা কাজকর্মের জন্য। এই যে বেশি বুঝতে পারা বা হাতছাড়া করতে এত এত, এ ভয় কিসের জন্য? কারন হচ্ছে, একটা মেয়েকে তার জন্মের পর থেকে ব্রেইন সেলে নিজস্ব ভাবনার কোনো সুযোগ দেওয়া হয় না। তাকে মূলত চালানো হয়। তার না থাকে নিজস্বতা,  না থাকে ভাবনা শক্তি। সে জানে ছোটবেলা থেকে যা দেখছে, বাবার রাজত্বে সে পরী, এর বাইরে কোনো রাজত্ব নেই। তো সে যখন বেশি বুঝতে শিখে যায় মানে নিজে যখন চিন্তা করতে শেখে তখন দেখে বাবার রাজ্য বাদেও তার নিজস্ব একটা রাজ্য আছে। তার আলাদা একটা জগৎ আছে। সে ভাবতে পারে সে আলাদা সত্তা। তার এই নিজস্বতা, এই ভাবনা শক্তি যখন কাজ করে তখন সে খুব সহজে কারো দাসত্ব করতে চায় না। তাকে পায়ের উপর পা তুলে স্বামী সেবাতে বসানো যায় না, কারণ সে বুঝতে শেখে অনেক কিছু। এই বেশি বুঝতে শেখায় মূলত ঝামেলা বাধায়।

আবার অনেকে বলে, পড়াশোনা কিংবা জব কিংবা অন্য কোনো কারণে মেয়ে মানুষ আলাদা রাখতে হয় না। কারণ মেয়েটা বের হয় একটা খোলস থেকে, সে বাইরে তাকিয়ে দেখে – আরেহ! আমি তো ছিলাম ঘরের কোনে। যা বলা হয়েছে তাই করেছি। আসলে তো এর বাইরেও অনেক বোঝাপড়া আছে। তো তাকে যে বৈষম্য দিয়ে ২০-২২ বছর গড়া হয়, সে যে ভাবতে শেখে বাবার চিন্তা, পরিবারের বড় ভাইয়ের চিন্তাই আমার চিন্তা, সেখানে বড় সড় একটা ফাটল ধরে। সে যখন বাইরে আসে তখন নিজেকে নিজের মতো ব্যালান্স করতে হয়। তখন সে দেখে ব্যালান্স করতে গেলে এত বছরের চিন্তা ভাবনায় আঁচড় লাগছে। মেয়েমানুষ রাতের আন্ধারে বাইরে যাওয়া যাবেনা যেখানে বলা হতো সেই মেয়টা গভীর রাতে তার আপনজনের অসুস্থতায় দৌঁড়াচ্ছে। সে আস্তে আস্তে অনুভব করে ছেলে-মেয়ে বলে আসলে জাত পাত নেই। ওটা শুধু জীব বৈচিত্র্য টিকিয়ে রাখতে তৈরি করা। এছাড়া এ বৈষম্য কোনো কাজে আসে না। ছেলেদের মতোই হাত-পা আছে তার।

এবং সে অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করে তার একটা মস্তিষ্ক আছে যা দিয়ে ঠিক তার বাপ ভাইয়ের মতোই বিপদের সময়ে কাজ করছে। তখন সে জানতে শুরু করে। এবং নিজের মতো করে সব কিছুতে সিদ্ধান্ত নিতে চায়। আর এদিকে যখন বাসার লোক দেখে মেয়ে নিজের মতো করেই সিদ্ধান্ত নিতে পারে তখন কপাল চাপড়িয়ে পাশের লোককে বলে – মাইয়া মানুষ বাইরে দিয়েন না, হাতছাড়া কইরেন না, বিগড়ে যায়।

One thought on “হাতছাড়া করলেই মেয়েমানুষ বিগড়ায়ে যায়!

  • পার্থ

    একটা অসাধারণ সত্ত্য ও বাস্তব একটা উপলব্ধি আপনার, আমরা সত্যিই মেয়েদের কে মেয়ে বানিয়ে রাখতে চাই, যাতে করে পুরুষ তাদের সুযোগ সুবিধা কায়েম করতে পারে। লেখাটি খুব সুন্দর হয়েছে। নিজের ভবিষ্যৎ সন্তান দের শিক্ষার বেপারে আশা রাখি কাজে দিবে আমার। ধন্যবাদ

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *