রাকিবকে ত্যাগ করায় তামিমাকে অভিনন্দন
শাহাদাত রাসএল।। ‘তামিমা আমার স্ত্রী ছিল’ কিংবা ‘পরীমনি আমার স্ত্রী ছিল’— এই দাবীগুলো এক প্রকার চটুল বিনোদন দিয়ে যাচ্ছে সমাজকে। নাসির-তামিমা-রাকিব এই ত্রিভুজ প্রেম বিয়ে নিয়ে আদালত আইনি কথা বলুক। আমি বরং ভাবছি তামিমার সাবেক স্বামী রাকিব ও পরীমনির কথিত সাবেক স্বামী সৌরভসহ এদের মনস্তত্ত্ব আসলে তাদের কিভাবে পরিচালিত করে।
তামিমার সাবেক স্বামী রাকিব। কে এই রাকিব? আপনি আমি তাকে চিনতাম? কেউ জানতাম তার নাম? সে কি দেশের আলোচিত কেউ? সংবাদমাধ্যমে তাকে নিয়ে কেন মাতামাতি? কেন এত এত মুখরোচক গল্পের কেন্দ্র হয়ে আলোচনায় রাকিব?
রাকিবের একমাত্র যোগ্যতা ও পরিচয় সে তামিমার সাবেক স্বামী। এর বাইরে রাকিবের কোনো পরিচয় আমরা জানি না। রাকিব এমন এক চরিত্র—যিনি এখন আইন আদালত থেকে শুরু করে সংবাদমাধ্যমের আলোচনার কেন্দ্রে। কে না থাকতে চায় আলোচনায়? রাকিব মূলত যোগ্যতাহীন একজন চরিত্র—যিনি তামিমার নাম বিক্রি করে ফোকাসটিকে এখন রসিয়ে রসিয়ে উপভোগ করছেন।
যেহেতু নাসিরকে বিয়ে করার মাধ্যমে আলোচিত হয়েছেন তামিমা, তাই তামিমার আলোয় কিছুটা আলোকিত হয়ে উঠছে প্রান্তিক একজন অক্ষম মানুষ।
মিডিয়া তো লুফে নেবেই, কেননা বর্তমান মিডিয়ার কাছে নৈতিকতার চেয়ে জরুরি কাজ হচ্ছে পাবলিকের বিনোদনের জোগান দেওয়া। সেটা যেকোনো ভাবেই হোক। আর বাঙালি পাঠক যে নারীর পরকীয়া বা বহুবিবাহ সংক্রান্ত বিষয়গুলোকে গোগ্রাসে চেটেপুটে খেয়ে নেয় সেটা তো আমরা জানিই। একজন নারীকে কোনোভাবে চরিত্রহীন প্রমাণ করে দিতে পারলেই সেই সংবাদ হাজার হাজার শেয়ার, হাজার হাজার কমেন্ট। নিউজ হিট। সংবাদদাতার পিঠ চাপড়ে দিচ্ছেন সম্মানিত সম্পাদক।
উল্টোদিকে বাঙালি একজন নারী অলিম্পিকে রৌপ্য পদক জয় করলেন কিংবা ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়াতে শিক্ষকতায় যোগ দিলেন। এই নিউজে সংবাদমাধ্যমের অনীহা। কারণ এসব নিউজে সর্বসাকুল্য আঠারোটা লাইক, তিনটা শেয়ার আর গোটা দশেক কমেন্ট। তার মাঝে তিনটা কমেন্টই ‘এসব ছেড়ে আলোর পথে আসো, বোরকা পড়ো’। সংবাদমাধ্যমও আসলে অসহায় হয়ে পড়েছে এই লাইক কমেন্টের ব্যবসায়।
যাইহোক, ধান ভানতে শিবের গীত গাইতে হলো। কারণ এই শিব ঠাকুরদের কারণেই আজকে ধান নামের চিটার দাম আকাশ ছোঁয়া। রাকিব-সৌরভ আসলে এই সমাজের আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভোগা চরিত্র, যাদের একটু আলো দরকার। যাতে তাদের মুখটা উঠে আসে পত্রিকার পাতায়। যাতে তাদের একটু পরিচিতি তৈরি হয়। আমার ধারণা, রাকিব বর্তমানে কোথাও গিয়ে পরিচয় দিতে নিজের বাবা মায়ের নাম বলেন না। বলেন, ‘আমি তামিমার সাবেক স্বামী’। এটাকে রাকিবের নবজন্ম বলা যেতে পারে।
‘ওই সুন্দরী মেয়েটি আমার বউ ছিল’ এই কথাটা ভাবতেই বাঙালি পুরুষের একধরণের চরম পুলক অনুভব হয়। যদিও তারা এতটা সভ্য ভাষায় বলে না। রাকিব বা সৌরভের মতো পুরুষদের জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে তারা তামিমা বা পরীমনির কাছাকাছি এসেছিল। তারা চায়ের দোকানের আড্ডা থেকে মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত সেই অর্জনের জাবর কাটে। সম্ভব হলে এরা মারা যারার পরে কবরে যখন যাবে খাটিয়ায় চড়ে তখনও খাটিয়াবাহীদের বলে যাবে, ‘জানেন ওই সুন্দরী মেয়েটার সঙ্গে শুয়েছিলাম’। এই সমাজে সুন্দরী নারীর সঙ্গে বিছানায় যাওয়াটাও অনেক বড় অর্জন ও গর্বের ব্যাপার। ব্যক্তিত্বহীন পরজীবী রাকিব মূলত সেই অর্জনটাকেই প্রচার করছে। ‘দেখ জাতীয় দলের ক্রিকেটার যার জন্য পাগল আমি সেই নারীর স্বামী’ এই দাবীটি করে মূলত নিজেকে কিছুটা নাসিরের সমান যোগ্যতার প্রচ্ছন্ন দাবীই করে থাকে রাকিবরা।
রাকিব এখন মিডিয়ায় খুব হাসি হাসি মুখে বলছেন যে, ‘তামিমা ফিরে এলে আমি এখনো তাকে হাসি মুখে গ্রহণ করব।’ এই কথাতে অনেকেই রাকিবকে মহান প্রেমিক বানিয়ে ফেলছেন, বাহ বাহ দিচ্ছেন। কী হাস্যকর ব্যাপার! রাকিবের মধ্যে কোনো প্রেম নেই, কোনো দায়বদ্ধতা নেই। রাকিবের মধ্যে যেটা আছে সেটা হচ্ছে ওর বাসার আসবাবপত্রের মতো একটা আসবাব হারিয়ে গেছে সেটাকে যেকোনো মূল্যে ফিরিয়ে এনে বেডরুমে সাজিয়ে রাখা। ওর কাছে তামিমা কোনো মানুষ নয়। তামিমার ইচ্ছা অনিচ্ছা বলে কিছু নেই। সে কার সঙ্গে জীবন কাটাবে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তার নেই। তামিমা রাকিবের সম্পত্তি— যা ওর যুক্তিতে দখল করেছে নাসির। অথচ যদি প্রেম ভালোবাসার কথাই আসে তবে নাসির তামিমা দুজন দুজনকে ভালোবেসেই বিয়ে করেছে। বৈধতা যদি দিতেই হয় তবে তো নাসির আর তামিমার বিয়েই বৈধ। রাকিবের দাবীটিই অবৈধ। কেননা প্রেম বা ভালোবাসাহীন দাম্পত্যই তো অবৈধ হবার কথা। যেটার দাবী তুলছেন রাকিব।
তামিমাকে সামাজিক মাধ্যমে বর্বরতম মন্তব্যের মাধ্যমে অপমান করে যাচ্ছে নেটিজেনরা। এখানে রাকিব দয়াবান উদার প্রেমিক। রাকিব তার ব্যর্থতার মিছিলে আরও কিছু ব্যর্থ পুরুষের নারী বিদ্বেষী গালাগাল শুনে মিডিয়ায় দাঁত ক্যালাচ্ছেন। অথচ তিনি ভুলে গিয়েছেন যে তার এই মিডিয়ায় দেখানো ক্যালানো দাঁতগুলোও তামিমার নামের কারণে ভিক্ষায় পাওয়া।
মনে পড়ে গেলো Bette Davis এর একটি কথা—”When a man gives his opinion, he’s a man. When a woman gives her opinion, she’s a bitch.” আমাদের সমাজে একজন নারীর চলার পথে পথেই এমন গালি শুনতে হবে। বেশ্যা বলে সম্বোধিত হতে হবে। তবুও মাথা উঁচু করেই তামিমাদের তাদের মতামত প্রকাশ করতে হবে। নারীর কণ্ঠে চিৎকার যতো বাড়বে আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কান ততই সাফ হবে। তাই এই সমাজে নারীকে যখন গালি দেওয়া হয় বুঝতে হবে যে পুরুষতন্ত্রের কোথাও না কোথাও সেই নারীটি আঘাত করেছে।
তামিমার অতীতের জন্য দুঃখ হচ্ছে। তবুও সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়াটাই বড় কথা। শেষ পর্যন্ত তামিমা যে রাকিবের মতো একজন ফেইমসিকারকে ছেড়ে আসতে পেরেছেন সেজন্য আমি তাকে অভিনন্দন জানাই।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]
এতো সুন্দর করে লেখা লিখেছেন
ধন্যবাদ আপনাকে দাদা।
অনেকবার পড়লাম।