November 21, 2024
নারী'র খবরদেশ

গুগল ডুডলে জোহরা বেগম কাজী

ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টর ডেস্ক।। আজ বাংলাদেশ থেকে সার্চ ইঞ্জিন গুগলে প্রবেশ করলে দেখা যাচ্ছে একটি ডুডল। এই ডুডলটি এমন একজনের সম্মানে প্রকাশ করা হয়েছে যিনি আমাদের সমাজের রক্ষণশীলতাকে চরম আঘাত করে এগিয়ে গিয়েছিলেন। যিনি এগিয়ে গিয়ে মূলত অন্যদেরও পথ দেখিয়েছিলেন, এই আলোকবর্তিকা, সাহসের প্রতীক, অগ্রসরতার অগ্রদূত বিশিষ্ট বাঙালি মুসলিম নারী চিকিৎসক জোহরা বেগম কাজী। ভারতবর্ষে প্রথম মুসলিম নারী চিকিৎসক তিনি।

ভারতবর্ষে নারী শিক্ষার ইতিহাস অতি সাম্প্রতিক। আঠারো শতকের আগেও নারী শিক্ষা বলতে শুধু নাচ-গান শিক্ষাই বোঝানো হতো। রাজা-জমিদারদের মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যেই যে নারীদের নৃত্য ও সঙ্গীত চর্চায় উৎসাহ দেওয়া হতো তা স্পষ্ট। এর বাইরে নারীশিক্ষার যে কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে তা উপলব্ধি করার মতো সমাজ ব্যবস্থা ছিল না। তবে ব্যতিক্রম যে ছিলো না তা নয়, কিন্তু তাও অতি গোপন ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে।

ইংরেজদের আসার পর হাতেগোনা কিছু নারী শিক্ষার ব্যাপারে উদ্যোগী হলেন। তবে এসব শিক্ষা নিতান্তই প্রাথমিক। ছোটখাটো হিসেব-নিকেশ আর ধর্মগ্রন্থ পড়ার মতো বিদ্যালাভই যথেষ্ট ছিল। নারীরা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করবেন এমন প্রস্তাবে সায় দিতে শিক্ষিত সমাজও মোটেও প্রস্তুত ছিল না।

১৮৮১ সালে ডাক্তারি পড়ার জন্য কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায় নামক এক নারী কলকাতা মেডিকেল কলেজে আবেদন করেন। তবে ঐ মেডিকেল কলেজ তখন তার আবেদনে সাড়া দেয়নি। এর দুই বছর পর পুনঃআবেদনের পর কলকাতা মেডিকেল কলেজ এই নারীকে শিক্ষা দিতে রাজি হয়। কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায় ব্রাহ্ম সংস্কারক ব্রজকিশোর বসুর কন্যা। তার পরিবারের সমর্থন ও চাপে কলকাতা মেডিকেল কলেজ দুই বছর পর থেকে ডাক্তারি পড়ার সুযোগ দিতে বাধ্য হয়েছিল। তবে একজন নারী চিকিৎসাশাস্ত্রে অধ্যয়ন করছেন এটি তার কলেজের অধ্যাপকরা সহজভাবে নেননি। শিক্ষাজীবনে তাকে অধ্যাপকদের তরফ থেকে আসা নানা প্রতিবন্ধকতাকে জয় করতে হয়েছে।

নারী শিক্ষায় অপ্রস্তুত অধ্যাপকদের বাইরে তৎকালীন রক্ষণশীল বিদগ্ধজনরাও কাদম্বিনী দেবীর সমালোচনায় ছিলেন মুখর। বঙ্গবাসী পত্রিকা একবার তাকে বেশ্যা বলতেও ছাড়েনি।

কাদম্বিনী দেবী ডাক্তার হয়েছেন বটে, তবে আপামর নারীদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অবস্থা তখনও তথৈবচ। বিশেষত ধর্মীয় বাধা ছিল প্রবল। যদিও ১৮৯০ সালের দিকে বিদ্যালয়ে নারীদের যাতায়াত উল্লেখ করার মতো সংখ্যায় পৌঁছায় তবে লক্ষণীয় যে মুসলিম নারীরা এক্ষেত্রে পিছিয়ে ছিলেন। হাতেগোনা ব্যতিক্রম এক্ষেত্রেও যে ছিল না তা নয়, তবে ১৮৬৩ সাল থেকে প্রকাশিত নারীদের পত্রিকা বামবোধিনী’তে প্রথম ৪০ বছরে মাত্র একজন মুসলিম নারীর লেখা প্রকাশ হয়েছিল। এ থেকেই বোঝা যায় বিদ্যাচর্চায় মুসলিম নারীদের অবস্থান।

কাদম্বিনী দেবী যেখানে রক্ষণশীল সমাজের বাধা উপেক্ষা করে দাপটের সঙ্গে ডাক্তারি চর্চা করছেন তখন মুসলিম সমাজের নারীরা ন্যুনতম প্রাতিষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষা পেতে সংগ্রাম করছেন। উপমহাদেশের নারী আন্দোলনের প্রতিকৃতি বেগম রোকেয়া লেখাপড়া শিখেছিলেন ভাই ও স্বামীর উৎসাহে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কোনো উপায় ছিল না তার। ২০ শতক পর্যন্ত মুসলিম নারীরা প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষা থেকে যোজন যোজন দূরে ছিলেন।

এমন যখন পরিস্থিতি তখন ১৯১২ সালের ১৫ অক্টোবর মধ্যপ্রদেশের রাজনানগাঁওয়ে গ্রামে জন্ম হলো এক মুসলিম কন্যা শিশুর। তার পিতার নাম ডাক্তার কাজী আব্দুস সাত্তার ও মায়ের নাম আঞ্জুমান নেসা। তাদের আদি পৈত্রিক নিবাস বাংলাদেশের মাদারীপুর জেলার কালকিনি থানার গোপালপুর গ্রামে। শিক্ষিত পরিবারের মেয়ে জোহরা বেগম কাজী। তার বাবাও একজন চিকিৎসক। মা রাজনীতি করেন। পরিবারের সহযোগিতায় তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজকে উপেক্ষা করে উচ্চশিক্ষা লাভের পথ তৈরি করে নেন বেগম জোহরা কাজী। ১৯২৯ সালে আলিগড় মুসলিম মহিলা স্কুল থেকে প্রথম বাঙালি মুসলিম আলিগড়িয়ান হিসাবে এসএসসি পাশ করেন। পরে দিল্লীর লেডি হাডিং মেডিকেল কলেজ থেকে ১৯৩৫ সালে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে এমবিবিএস পাস করেন।

এমবিবিএস ডিগ্রি লাভের পর ইয়োথমাল ওয়েমেন্স হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন বেগম জোহরা কাজী। এরইমধ্যে মহাত্মা গান্ধীর তৈরি সেবাগ্রামে অবৈতনিক চিকিৎসকের কাজ করেন জোহরা বেগম কাজী। দেশবিভাগের পর তিনি বাংলাদেশ (তৎকালীন পুর্বপাকিস্তান) চলে আসেন এবং যোগ দেন  ঢাকা মেডিকেল কলেজ এবং হাসপাতালে। মিডফোর্ড মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি গাইনোকোলজি বিভাগের প্রধান ও অনারারি প্রফেসর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন৷ ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে কর্মরত অবস্থায় অবসর সময়ে তিনি সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে অনারারি কর্নেল হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন৷ পরবর্তীকালে তিনি বাংলাদেশ মেডিকেলে অনারারি অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেন।

মুসলিম নারীদের যেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উঠোন মাড়ানোতেও ছিল বাধা, সেখানে চিকিৎসাশাস্ত্রে অধ্যয়ন ছিল অবাস্তব-অকল্পনীয়। সেই সমাজব্যবস্থাকে লাথি দিয়ে জোহরা বেগম অকল্পনীয় ও অবাস্তবকে বাস্তব করেছেন। আজকের এই অতি অগ্রসর সমাজেও আমরা প্রায়ই দেখতে পাই নারীদের উচ্চশিক্ষার বিরুদ্ধে কুযুক্তি, কু-মতের পসরা। অথচ ইসলামে নারীদের শিক্ষা গ্রহণের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিষ্ঠিত যুক্তি কেউ উপস্থাপন করতে পারেনি। বরাবরই ইসলামি স্কলাররা দেখিয়েছেন, পুরুষরা যে শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারে সেই একই শিক্ষায় শিক্ষিত হতে নারীদেরও কোনো বাধা নেই। তবুও একশ্রেণির মতলববাজ লোক সমাজ ও রীতিনীতির দোহাই দিয়ে তাদের ব্যক্তিগত বাতিল মতবাদ ধর্মের নামে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা আজও সেই আগের মতোই করে যাচ্ছে।