সমলিঙ্গের প্রতি যৌন প্রবৃত্তি: থাকতে পারে নানা কারণ
মাহমুদুল হাসান উৎস।। একজন ব্যক্তি তার যৌনতা বা যৌনতার ধরণ মূলত জন্মগতভাবেই গ্রহণ করে। সমকামও তেমন এক স্বাভাবিক যৌন প্রবৃত্তি। আমরা যারা একে অস্পৃশ্য করে ফেলেছি তারা মূলত যৌন সংখ্যালঘুদের অধিকার এবং সামাজিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছি। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ বা বিষমকামিতা যেমনটা জন্মগত এবং পরিবেশগত তেমন সমলিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ বা সমকামিতাও জন্মগত এবং পরিবেশগতভাবে প্রভাবিত। যৌন প্রবৃত্তি বলতে শুধু বিষমকামিতাই বুঝায় না, এর সাথে সমকামিতা, রূপান্তরকামিতাও অন্তর্গত। যৌন প্রবৃত্তি অপরিবর্তনীয় নয়। পরিবেশগত পরিবর্তন হরহামেশাই হয়। তবে এই পরিবর্তন সবচে বেশি লক্ষণীয় উভকামী বা বাই-সেক্সুয়ালদের জন্য।
সমকাম বা সমপ্রেম বিষয়টা মোটামুটি গে, লেসবিয়ান, বাই-সেক্সুয়াল হিসেবেই আমাদের সমাজে পরিচিত। মূলত মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস নামক অংশটি মানুষের যৌন প্রবৃত্তি নির্ধারণে সাহায্য করে। একজন বিষমকামী মানুষের হাইপোথ্যালামাস আর সমকামী মানুষের হাইপোথ্যালামাসে বেশ পরিবর্তন দেখা যায়। যদিও এখন অবধি জেনেটিক্যালি সমকাম অন্তর্গত জিন পাওয়া যায়নি।
পরিবেশগতভাবে যৌন প্রবৃত্তি পরিবর্তিত হতে পারে। আমি কোনো বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে যাচ্ছি না। আমাদের বাংলাদেশের কথাই চিন্তা করুন। এক চাপা রক্ষণশীল সমাজে আমরা বেড়ে উঠছি যেখানে যৌন নিরাপত্তা নেই বললেই চলে। আমরা নিজেও এর সাক্ষী। এক সেক্সুয়াল ফ্রাস্ট্রেটেড জাতি আমরা, অথচ স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে জনসংখ্যা হয়ে গেছে তিনগুণ।
বাই-সেক্সুয়ালদের কথাই বলি। এদের ক্ষেত্রে যৌনতার প্রবৃত্তি সবচে বেশি পরিবর্তিত হয়। দেখা যায়, বিষমকামী হওয়ার জন্যে অনেক পুরুষ নারীর সান্নিধ্য পাচ্ছে না আবার অনেক নারী পুরুষের সান্নিধ্য পাচ্ছে না।এক্ষেত্রে যৌনতার ইচ্ছা পূরণের জন্য অনেক পুরুষ বাধ্য হয়েই সমলিঙ্গের প্রতি আকর্ষিত হয়। আবার পরিবেশ পরিবর্তন হলে যৌন তাড়না বা আকর্ষণ নারীর দিকেই ঝুঁকে যায়। উপরিউক্ত সমস্যা মূলত বাই-সেক্সুয়ালদের জন্য স্বাভাবিক। আমি মূলত এক্সেপশনাল এর কথা বলছি। আবার যারা সত্যিকার অর্থেই বাই সেক্সুয়াল তারা সবচে বেশি নিগৃহীত হয় আমাদের সমাজে। বাই সেক্সুয়াল মানুষ মূলত গে বা লেসবিয়ানদের মতো বিয়ে করে একটি সংসার করতে পারে না। আমরা যখন একটি সামাজিক সম্পর্কে জড়িয়ে যাই তখন নিশ্চিত রূপেই আমার পার্টনার অন্য কারো সাথে সেক্সুয়ালি মিলিত হোক সেটা নিশ্চয়ই চাইবো না। এই কাজ এমনিতেও নৈতিক নয়। কেননা, একটা সম্পর্কে জড়িয়ে থাকার পরও, পার্টনারের কনসেন্ট ছাড়া আপনি অন্য কোথাও কোনো সম্পর্কে জড়াতে পারেন না।
আবার গে’দের মধ্যে ভাগ আছে— টপ, বটম এবং ভার্সেটাইল। টপ মূলত পুরুষালি আচরণ করে আর বটম মূলত মেয়েলি আচরণ করে। আবার ভার্সেটাইল ব্যক্তি উভয় আচরণ করে। টপদের ক্ষেত্রে আমার নিজস্ব এক ধারণা আছে, যদিও এটা বৈজ্ঞানিক কিছু নয়, শুধুমাত্র সামাজিক বিশ্লেষণ। টপ যারা আছে তারা চাইলেই বিষমকামী হতে পারে। কেননা তারা ভার্সেটাইল ব্যক্তির মতো উভয় আচরণ করে না। সুতরাং, বেশিরভাগ টপ ব্যক্তিই শুধুমাত্র সেক্সুয়াল পার্টনারের অভাবে সমকামে জড়িয়ে পড়ে।
আমার ফ্রেন্ড সার্কেলের কথাই বলি। তাদের মধ্যে প্রচুর টপ। তাদের মনস্তাত্ত্বিক চিন্তাধারা এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিশ্লেষণ করলে দেখতে পারি বেশিরভাগ টপ ব্যক্তিই সমলিঙ্গের প্রতি আকর্ষিত হোন পার্টনারের অভাবে। রক্ষণশীল সমাজ যারা সমকামিতার বিরুদ্ধে সোচ্চার, তাদের উগ্র আচরণের জন্যও কিন্তু সমকামের প্রভাব দিন দিন বেড়েই চলছে।
ধর্মীয় দিক থেকেও সমকামের প্রচুর নিদর্শন আছে। আপনি যদি বলেন সমকাম মূলত পশ্চিমা বিশ্বের বিকৃত যৌনাচার তাহলে ভুল ধারণা। পশ্চিমা বিশ্বে সমকাম স্বাভাবিক হওয়ার বহু আগেই আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় সমকাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সেই গ্রীক দেবী ভেনাস আর প্রিয়াপাসের আরাধনা করতো তৎকালীন সমকামীরা। আবার হিন্দু ধর্মে শিবের অর্ধনারীশ্বর রূপও মূলত রূপান্তরকামীদের এবং উভকামীদের ইঙ্গিত করে।
সমকাম মূলত প্রাকৃতিক যৌন প্রবৃত্তির অংশ সেহেতু এটি কোনো রোগ নয়। প্রকৃতিতে সমকামের হাজার হাজার নিদর্শন আছে। প্রায় পনেরো হাজারেরও বেশি প্রাণীতে সমকামের ধারণা পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। প্রাকৃতিক ধ্যানধারণাকে যখন অপ্রাকৃত বলে আখ্যা করবেন তখন এমনিতেই প্রকৃতিতে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]